অন্তরে ইশক বা প্রেম পয়দার উপায়।
ইশক বা প্রেম পয়দা করা যায় না, বরং প্রেম নিজ থেকেই জাগ্রত হয়, অর্থাৎ প্রেম করা যায় না; প্রেম হয়ে যায়। তাই প্রশ্নটা হবে এমন যে, “ইশকের অনল হৃদয়ে প্রজ্বলিত হয় কিভাবে? কিসের প্রভাবে? কি কি উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে প্রেম জাগ্রত হতে পারে? সুপ্ত প্রেমকে জাগ্রত হতে কি সবার হৃদয়ে একই মাত্রার অনুভূতি প্রয়োজন হয় নাকি একেক জন্যের জন্য একেক মাত্রার অনুভূতি দরকার? ইত্যাদি ইত্যাদি।”
বিষয়টি সহজে বুঝার জন্য উদাহরণ স্বরূপ সাধারণভাবে আমাদের জীবনের প্রেম-ভালবাসার সাথে ইশকে মিলাচ্ছি। কারণ প্রশ্নটি মূলত প্রভুর প্রতি প্রেম-ভালবাসা নিয়েই এসেছে। প্রেমের উদয় নানা ভাবে হতে পারে। কখনো দর্শনে, কখনো শ্রবণে, আবার কখনো সঙ্গে, আবার অপরের কাছে গুণ শুনেও প্রেম-ভালবাসা জাগতে পারে। যেমন- কোনো সুদর্শন নারী-পুরুষ একে অপরের রূপ দেখে প্রেমে পড়ে, কখনো কন্ঠ শুনে, আবার একই বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সময় বা একই কর্মস্থলে কাজ করার ফলে বা যেকোনো কারণেই হোক একে অপরের সাথে থাকতে সঙ্গ দিতে দিতে একজনের প্রতি অপরজনের বা পরস্পরের হৃদয়েই প্রেম জেগে উঠে।
আবার দেখা যায় অন্যদের কাছে কারো প্রশংসা শুনে নিজের অজান্তেই তার প্রতি প্রেম জাগ্রত হতে থাকে। তাছাড়া আরও নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে একে অপরের প্রেমে পতিত হয়। আবার এমনও দেখা যায় যে, এর পিছনে কোনো কারণই থাকেনা, কারণ ছাড়াই অন্যের প্রতি প্রেম জাগ্রত হয়, যার কোনো ব্যাখ্যাও থাকেনা। কারণ একেকজনের হৃদয়ে প্রেমের অনুভূতি একেক রকম বা একেকমাত্রায় অনুভূত হয়। তাই কারো কারো হৃদয়ে প্রেম জাগ্রত হতে দর্শন, শ্রবণ, গুণ ও গুণকীর্তন সবকিছুরই প্রয়োজন হয়। তবে হ্যা, সবার ভিতরেই প্রেম সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কেউ প্রেমহীন হয় না। প্রেমের অনূভুতির মাত্রা একেকজনের একেকরকম হয়ে থাকে মাত্র।
আমরা যারা সাধারণ মানুষ আছি, তারা সরাসরি প্রভুকে না দেখতে পাই, না তাঁর কন্ঠ শুনতে পারি। ফলে দর্শন ও শ্রবণে প্রভুর প্রতি প্রেম জাগ্রত হওয়ার বিষয়টা আমাদের মধ্যে একেবারেই কাজ করে না। আবার তিনি সবত্র বিরাজমান হওয়া সত্বেও উপলব্ধির অভাবে তাঁর সঙ্গও পাচ্ছি না, কারণ আমরা ত তাঁর দর্শন ও শ্রবণ হতে বঞ্চিত আগে থেকেই। তাহলে ত দর্শন বা শ্রবণ থেকেই প্রেম জাগ্রত হতো। বাকী থাকে গুণ শুনে প্রেমে পড়ার বিষয়টি। প্রভুর প্রেম জাগ্রত হওয়াএ ক্ষেত্রে এই বিষয়টা আমাদের দ্বারা সম্ভব। অর্থাৎ অন্য কারো নিকট প্রভুর গুণাগুণ শুনে প্রভুর প্রতি প্রেম জাগ্রত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
প্রভুর গুণ কারা বর্ণণা করতে পারেন? যারা প্রভুর সম্পর্কে ভাল মত জানেন। যারা প্রভুর দর্শন পেয়েছেন এবং প্রভুকে শুনতে পান, প্রভুর অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম, তারাই শুধুমাত্র সঠিকভাবে প্রভুর গুণাগুণ বর্ণণা করতে পারেন। তাহলে এই বিষয়টা ত স্পষ্ট যে, প্রভুর প্রতি ইশক বা প্রেম জাগ্রত করতে হলে আমাদের এমন ব্যক্তির নিকট থেকে প্রভুর গুণকীর্তন শুনতে হবে, যে ব্যক্তির হৃদয়ে প্রভুর প্রেম জাগ্রত আছে এবং যিনি প্রভুকে উপলব্ধি করেছেন। অর্থাৎ আমাদের প্রয়োজন নিয়মিত সাধুসঙ্গ বা ওলী-আউলিয়ার সহবত৷
সাধুসঙ্গ করলে বা ওলী-আউলিয়ার সহবতে থাকলে আমরা প্রতিনিয়ত প্রভুর গুণাগুণ শুনবো ও ধীরে ধীরে প্রভাবিত হতে থাকবো এবং আমাদের হৃদয়ে প্রেম একটু একটু করে জাগ্রত হতে থাকবে। কারণ সব সময় অগ্নি একা একা জ্বলে না, বরং অন্য কোনো অগ্নি থেকেই অগ্নি প্রজ্বলিত করতে হয়। একা একা জ্বলার বিষয়টি সম্ভব হলেও, এটি খুব ব্যতিক্রম বা অলৌকিক ও অস্বাভাবিক। তাই আমাদের কাষ্ঠের ন্যায় হৃদয়কে প্রেমের আগুন দিয়ে প্রজ্বলিত করতে অবশ্যয়ই অন্য কোনো অগ্নিকুণ্ডের সংস্পর্শ আবশ্যক।
সহজভাবে বলতে গেলে এটাই বলতে হয় যে, সাধারণ ব্যক্তিদের হৃদয়ে প্রভুর ইশক বা প্রেম জাগ্রত করলে হলে একজন প্রভুর প্রকৃত আশেকের আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় ইশক বা প্রেম জাগ্রত হওয়া প্রায় অসম্ভব। এজন্যেই ধর্ম গ্রন্থে সৎ ব্যক্তিদের সঙ্গী হওয়ার উপদেশ পাওয়া যায়। তাছাড়া অনেক সাধু-মহৎও সাধুসঙ্গের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যেমন পবিত্র কুরআনে আছে- “তোমরা সাদেকীন বা সত্যবাদীদের সঙ্গী হও।”
তাছাড়া লালন সাঁইজির পদেও পাওয়া যায় যে-
“যদি ত্বরিতে বাসনা থাকে
ধর রে মন সাধুর সঙ্গ
সাধুরও গুণ যায় না বলা
শুদ্ধ চিত্ত অন্তর খোলা,
সাধুর দরশনে যায় মনের ময়লা
পরশে হয় প্রেমতরঙ্গ”
যখন প্রেম জাগ্রত হতে শুরু করবে, তখন আমরা ধীরে ধীরে প্রভুর নৈকট্য অর্জন করতে থাকবো। আপন থেকেও আপন হতে থাকবো। নিজের মাঝে প্রভুর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারব। উপলব্ধি হতে থাকবে, প্রভুর শব্দ শ্রবণ হতে থাকবে, অতঃপর পরমের দর্শন বা সাক্ষাতও লাভ হবে। প্রেমের এক পর্যায়ে আশেক আর মাশুক আলাদা থাকে না, আমি আর তুমি থাকে না; বরং এক হয় যায়।
হে দয়াময় প্রভু! তুমি আমাদের হৃদয়ে তোমার প্রেম জাগ্রত করে দাও। আমাদের হৃদয়কে ভিন্নমুখী না করে তোমার দিকে ফিরিয়ে দাও। আমরা যেন তোমার প্রকৃত আশেকদের সঙ্গ বা সহবত অর্জন করে তোমাকে লাভ করতে পারি, সেই তাওফিক দান করো।
লেখাঃ DM Rahat