বিদায় কালে পথিমধ্যে মুরিদকে পরিক্ষা।
একজন মুরীদ তাহার পীরের দরবারে ১২ বছর খেদমত করিলেন। বার বছর অন্তে পীর ছাহেব তাহাকে বিদায় দিলেন। বিদায় দেওয়ার সময় একটি সুতীক্ষ্ণ ধারালো ছোরা মুরীদের হস্তে প্রদান পূর্বক বলিলেন, “বাবা, তুমি এক যুগ খেদমত করিলে, তোমাকে কি দিব, তুমি এই ছোরাটা লইয়া যাও।” মুরীদ বিনীত ভাবে পীর ছাহেবের নিকট জানিতে চাহিলেন যে, ছোরা দিয়া তিনি কি করিবেন? পীর ছাহেব তাহাকে ফরমাইলেন, “কোথাও একটি উচু গাছের নীচে তুমি ছোরাটি উল্টাভাবে গাড়িবে; এমন ভাবে গাড়িবে যেন ধারালো অগ্রভাগ মাটি হইতে বেশ কিছু উপরে থাকে। অতঃপর তুমি সেই উচু গাছের উপরে উঠিয়া একটি ডাল হইতে সেই ছোরার তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ লক্ষ্য করিয়া লাফ দিয়া পড়িয়া মরিয়া যাইবে।” এই আশ্চর্যজনক কথা শুনিয়া মুরীদ ছোরাসহ বিদায় হইলেন। তিনি পথ চলিতেছেন, আর অশ্রু বিসর্জন করিতেছেন। কারণ পীরের নির্দেশ প্রতিপালন মানেই টাটকা মরণ। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরে একটা উচু গাছ দেখিয়া তিনি বসিয়া পড়িলেন। পীরের নির্দেশ মত অগ্রভাগ উপরে রাখিয়া ছোরাটিকে মাটিতে গাড়িলেন।
তৎপর গাছের উচু ডালে উঠিয়া যেইমাত্র নীচের দিকে তাকাইলেন, তৎক্ষণাৎ ভয়ে তাহার হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল। তিনি নীচে নামিয়া অনেকক্ষণ বসিয়া কাঁদিলেন। একদিকে পীরের আদেশ পালন; অন্য দিকে মৃত্যুর ভয়। তিনি আবার গাছে উঠিয়া আবারও নীচের দিকে তাকাইয়া প্রাণ ভয়ে আবারও নামিয়া কিছুক্ষণ অঝরে কাঁদিলেন। ভাবিতে লাগিলেনঃ পীরের নির্দেশ পালন না করিলে ১২ বছরের খেদমত বৃথা যায়; ইহকাল-পরকাল বরবাদ হয়। এই চিন্তা করিয়া তিনি আবারও গাছে উঠিলেন; কিন্তু নিম্নে ছোরার অগ্রভাগের দিকে তাকাইয়া শিহরিয়া উঠিলেন। জানিয়া শুনিয়া কিভাবে মরিবেন? তিনি নীচে নামিয়া আসিলেন। এইভাবে একবার, দুইবার, তিনবার তিনি পীরের নির্দেশ প্রতিপালনের জন্য গাছে উঠিলেন কিন্তু জীবনের মায়ায় নামিয়া আসিলেন। চতুর্থবারে মনে মনে ভাবিলেন, “মরিতেতো একদিন হইবেই।
মৃত্যুর ভয়ে পীরের নির্দেশ প্রতিপালন না করিলে দীন ও দুনিয়া-উভয়ই হারাইতে হইবে। কাজেই আমি গাছে উঠিয়া চক্ষু বন্ধ করিয়া ছোরার দিকে না তাকাইয়া লাফ দিয়া মারা যাইব।” তিনি প্রাণের মায়া ত্যাগ করিয়া দৃঢ় চিত্তে পীরের নির্দেশ পালনে গাছে উঠিয়া উঁচু ডাল হইতে ছোরার অগ্রভাগ সোজাসুজি চক্ষু বুজিয়া ঝাপ দিলেন। কিছুক্ষণের জন্য তিনি অজ্ঞান হইয়া পড়িলেন। জ্ঞান ফিরিলে তিনি দেখিলেন, প্রকৃত প্রস্তাবে ছোরা তাহার বুকে বা শরীরের কোথাও প্রবেশ করে নাই। যেখানে ছোরাটি ছিল, সেখানেও নাই।
ভাবিলেন, হয়তো ছোরাটি দেহের চাপে মাটিতে গাড়িয়া গিয়াছে। মাটি খুড়িলেন, কিন্তু ছোরাটি পাইলেন না। পীরের মহব্বতে হৃদয় তাহার ভরিয়া গেল। তিনি মোরাকাবায় বসিলেন। পীরের দিকে দেলকে মোতাওয়াজ্জুহ করিলেন। সংগে সংগে তাহার দেলের পর্দা উন্মোচিত হইল; আল্লাহর নূরে ভরিয়া গেল। তিনি শুনিতে পাইলেন, আল্লাহপাক তাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিতেছেন, “হে আমার বান্দা! তোমার আর কোন চিন্তা নাই।”
উল্লিখিত এই কাহিনী হইতে বুঝা যায় যে, আল্লাহতায়ালাকে পাইতে হইলে আদব, বুদ্ধি, মহব্বত ও সাহস-এই চারটি গুণের পরিপূর্ণতা প্রয়োজন। উক্ত মুরীদের আদব পুরাপুরিই ছিল, মহব্বতও পূর্ণমাত্রায় ছিল কিন্তু বুদ্ধি ও সাহসিকতার ঘাটতি থাকায় পীরের নির্দেশ প্রতিপালনে মুরীদের বিলম্ব হইতেছিল। অবশ্য আল্লাহপাকের দয়ায় কিছুক্ষণেই মুরীদের গুণাগুণের পূর্ণতা আসে; ফলে সে পীরের হুকুম পালনে তৎপর হয় এবং নির্দেশমত গাছের উঁচু ডাল হইতে ছোরার উপরে লাফ দিয়া হয় পড়ে। ফলে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, খোদাতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জিত।
সূত্রঃ খোদাপ্রাপ্তিজ্ঞানের আলোকে- শাহসূফী হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃ ছেঃ আঃ) ছাহেবের “নসিহত” ১ম খন্ড (বিষয়ঃ আদাবুল মুরীদ)-এর অংশ বিশেষ।