মনসুর আল-হাল্লাজ এর (নব্যুয়তের প্রদীপ)
১. দেখা দিল একটি প্রদীপ অলক্ষ্যের আলাে থেকে। দৃশ্যমান হলাে এবং ফিরে গেল, এবং ছাপিয়ে গেল অন্যান্য প্রদীপকে। সে-ই তাে ছিল শাসক চাঁদ, অন্য সব চাঁদের মাঝে নিজেকে যে প্রকাশ করে উজ্জ্বলভাবে। সে ছিল একটি তারা যার জ্যোতির্লোকীয় ঘর এমপাইরিয়ানে। আল্লাহ তার নাম দিলেন “অনক্ষর” তার ব্যাকুল মনস্কামনার পূর্ণ নিবিষ্টতার জন্য, এবং নাম দিলেন “পবিত্রীকৃত” তার আশীর্বাদের মহিমার কারণে, এবং “মক্কী” পরমপ্রভুর নৈকট্যে বসবাসের কারণে।
২. তিনি বুক প্রসারিত করলেন এবং জাগালেন তার ক্ষমতা, এবং তার থেকে তুলে নিলেন বােঝা ‘ভার চাপিয়ে যা তার পিঠকে কুঁজো করে দিয়েছিল’, এবং তিনি আরােপ করলেন তার কর্তৃত্ব। আল্লাহ যখন তার মুখ (বদর) বার করলেন যেন তার পূর্ণ চাঁদ জেগে উঠল ইয়ামামার মেঘের ভেতর থেকে এবং তার সূর্য জেগে উঠল তিহামার (মক্কা) পাশে, এবং তার প্রদীপ দীপ্তি ছড়াল সমস্ত স্বর্গীয় দানের উৎস থেকে।
৩. তিনি তার মর্মের দেখার বাইরে বর্ণনা করেন নাই কিছুই, এবং তিনি তার করণ-সত্যের নিরিখ ছাড়া অন্য কোনাে দৃষ্টান্ত অনুসরণের আদেশ দেন নাই। তিনি ছিলেন আল্লাহর উপস্থিতির ভেতর, অতঃপর অন্যদেরকে আনলেন পরমের উপস্থিতির দিকে। তিনি দেখলেন, অতঃপর বুঝলেন কী তিনি ছিলেন। একজন পথ-প্রদর্শক হিসাবে পাঠানাে হয়েছিল তাকে। তাই তিনি আচরণের সীমানা চিহ্নিত করে দেন।
৪. নিষ্ঠাবানেরা ছাড়া কেউই তার সত্যিকার তাৎপর্য বুঝতে সক্ষম নয়, যেহেতু তিনি এর বৈধতা নিশ্চিত করেন, এবং অতঃপর তার সঙ্গ নেন যাতে তাদের মধ্যে কোনাে অসমকক্ষতার অবশেষ আর না থাকে।
৫. কোনাে গুপ্তজ্ঞানী কখনাে জানতে পারেননি তাকে যিনি তার সদগুণ সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন না। তার গুণ কেবল তাদের কাছেই স্পষ্টতা পায়, আল্লাহ যাদের কাছে তা খােলাসা করার জামিন গ্রহণ করেন। ‘যাদের কাছে আমি এই কিতাব নাজিল করেছি, তারা (এই প্রত্যাদেশের বিষয় ) জানে যেমন তারা চিনতে পারে তাদের সন্তানদের আর তাদের একটি দল নিশ্চয়ই এই সত্য জেনে গােপন করেছে।’ (২.১৪৬)
৬. নবুয়তের নুর জন্ম নেয় তার আলাে থেকে এবং তার আলাে আসে দিব্যরহস্যের আলো থেকে সকল আলাের মধ্যে মহত্ত্বের প্রভুর এই আলােকদীপ্তির চেয়ে এত উজ্জল, এত প্রকাশিত, অসৃষ্টত্বের-চেয়ে-অসৃষ্ট আর কিছু নাই ।
৭. তার মনস্কামনা অন্য সকল মনস্কামনার পূর্ববর্তী, তার অস্তিত্ব অনস্তিত্বের পূর্ববর্তী, তার নাম ‘অক্ষরের’ (pen) পূর্ববর্তী কেননা তিনি আগে থেকেই ছিলেন।
এই দিগ্বলয়ে, দিগ্বলয়ের বাইরে কিংবা দিগ্বলয়ের নিচে কেউই কখনাে ছিলেন না এই পদে যিনি আছেন তার চেয়ে অধিক দয়াল, মহৎ, জ্ঞানী, অধিকতর ন্যায়পরায়ণ, স্নেহশীল, অধিকতর ঈশ্বর-ভীত কিংবা বেশি স্বহৃদয়। তার পদবী হলাে সৃষ্টির প্রভু এবং তার নাম আহমদ এবং তার বিশেষণ হলাে মুহাম্মদ। অধিকতর নিশ্চিত তার আদেশ, অধিকতর নিরুপম তার সারসত্তা এবং তার বিশেষণ আরও গৌরবময় এবং তার মনস্কামনা অনন্য।
৮. হে বিস্ময়! কী আর আছে এত মূর্ত, এত দৃশ্যমান, এত মহত্তর, এত বিখ্যাত, এত উজ্জল, এত ক্ষমতাশালী কিংবা এত আলাদা তার থেকে? তিনি আছেন এবং ছিলেন এবং জ্ঞাত ছিলেন সৃষ্ট বস্তু, অস্তিত্ব ও সত্তাসমূহের আগে। স্মরণ করা হতাে তাকে এবং এখনাে স্মরণ করা হয় পূর্বের পূর্বে এবং পরের পরে, এবং দ্রব্য ও গুণসমূহের আগে। তার দ্রব্য সম্পূর্ণত আলাে, তার বার্তা প্রফেটিক, তার জ্ঞান গাগনিক, তার প্রকাশ-প্রণালী আরবি, তার জাতি ‘প্রাচীর’ও নয় ‘অবাচী’রও নয় (২৪.৩৫), তার বংশকুল পিতৃতান্ত্রিক, তার মিশন সহৃদয়তা অর্জন এবং তার পদবী হয়েছে ‘অনক্ষর।
৯. তার সব চিহ্ন, গুপ্তরহস্য এবং স্বয়ংসত্তাগুলাে দিয়েই খুলে গিয়েছিল সকল চোখ। আর সেই সব প্রত্যক্ষিত হয়েছিল সেখানে তার থাকার ফলেই। আল্লাহই তাকে পরমশব্দ দিয়ে করেছিলেন স্বতােপ্রকাশ, এবং নিজেই তার প্রমাণ হিসাবে নিশ্চিত করেছিলেন তাকে। আল্লাহই তাকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি প্রতিপাদন এবং তিনিই প্রতিপন্ন। নিদারুণ তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের তৃষ্ণার প্রশমন ঘটান তিনি, তিনিই সেই যিনি আনেন অসৃষ্ট শব্দাবলি যারা স্পর্শিত নয় এমন কিছুর দ্বারা যা সেসবকে স্পর্শ করতে পারে, যা উচ্চারিত নয় জিহ্বার দ্বারা, যা নয় সৃষ্ট। তা আল্লাহর সঙ্গে যুক্ত এবং কোনাে বিভক্তি নাই এবং যা কিছু উপলব্ধিগম্য সেসবকে তা ছাপিয়ে যায়। তিনিই সেইজন যিনি ঘােষণা করেন অন্তকে এবং অন্তসমূহকে এবং অন্তের অন্তসমূহকে।
১০. তিনি উর্ধে তুলে আনলেন মেঘ এবং নির্দেশ করলেন পবিত্র ঘরকে তিনিই সীমানা এবং তিনিই বিরচিত যোদ্ধা। তিনিই সেই যিনি পেয়েছিলেন প্রতিমা ভাঙার নির্দেশ এবং তিনিই সেই যাকে মানুষের কাছে পাঠানাে হয়েছিল। ওইসবকে শিকড়চ্যুত করার জন্য।
১১. তার উপরে একটি মেঘ ঝাপট দিলাে বিদ্যুচ্চমকের আর তার নিচে আলােকবজ্র দিয়ে গেল ঝাপটা, আলাে আসলাে, বৃষ্টি হলাে তাতে এবং ফল জন্ম নিলাে। সমস্ত জ্ঞান তার সমুদ্রেরই একেকটি ফোঁটা, এবং সমস্ত প্রজ্ঞাই তার ঝর্নাধারার একেকটি আঁজলা এবং সমস্ত কাল তার জীবনের একেকটি প্রহর।
১২. আল্লাহ আছেন তার সঙ্গে এবং তার সঙ্গে আছে বাস্তবতা। যুক্ত হবার দিক থেকে তিনিই প্রথম এবং তিনিই সর্বশেষ তাদের মধ্যে যারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছেন নবী হিসাবে- ভেতরের দিকটা বাস্তবতা দ্বারা, এবং বাইরের দিকটা গুপ্তজ্ঞানের দ্বারা।
১৩. কোনাে পন্ডিত আজ অব্দি অর্জন করতে পারেননি তার জ্ঞান, পারেননি অবগত হতে তার বােধকে আজ অব্দি কোনাে দার্শনিক।
১৪. আল্লাহ সমর্পণ করেননি (তার বাস্তবতাকে) তার সৃষ্টির কাছে কেননা তিনি হলেন তিনি এবং সেখানে তার সত্তা হলেন তিনি, এবং তিনিই হলেন তিনি (he is He)।
১৫. মহমদ-এর ম থেকে কোনােকিছুই আসেনি, এবং কোনােকিছুই প্রবেশ করেনি তার হ-এর ভেতর, এবং তার হ তার দ্বিতীয় ম এর অনুরুপ, এবং তার দ প্রথম ম-এর অনুরূপ। তার দ হলাে তার বিরামহীনতা, তার ম হলাে তার পদমর্যাদা, তার হ হলাে তার চিন্ময় অবস্থা যেমনটা তার দ্বিতীয় ম।।
১৬. আল্লাহ তার উক্তিকে প্রকাশ করলেন, এবং বর্ধিত করলেন তার চিহ্নকে এবং তার প্রমাণকে জানিয়ে দিলেন। তিনি ফুরকান নাজিল করলেন তার উপর, তিনি তার বাকশক্তিকে প্রাচুর্য দিলেন, এবং তার হৃদয়কে আলােকদীপ্তি দিলেন। তিনি তার সমসাময়িকদের অসমর্থ করলেন (কোরআনের অনুকরণ করতে)। তিনি তার সুম্পষ্টতাকে প্রতিষ্ঠিত করলেন এবং উচ্চে স্থাপন করলেন তার বিজয় গৌরবকে।
১৭. যদি তুমি তার রাজ্য থেকে পলায়ন কর, হে পীড়িতজন, পথপ্রদর্শক ছাড়া কোন্ পথ গ্রহণ করবে তুমি? দার্শনিকদের প্রবচনগুলাে তার প্রজ্ঞার কাছে গলে যেতে থাকা বালির স্তুপের তুল্য।
মূল: মনসুর হাল্লাজ, কিতাব আল-তাওয়াসিন
ভাষান্তর ও সম্পাদনা: রায়হান রাইন