আধ্যাত্মিক সাধনা ও আত্মপরিচয়ের পথ
“আমি”-র অন্তর্গত একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শিখন রয়েছে—কীভাবে আমাদের চিত্ত ও মনোজগতের পরিস্কারতা, পবিত্রতা ও অস্থিরতা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। পাঠকের জন্য ব্যাপক উপলব্ধি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে আমরা বিষয়গুলো আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে পারি।
অর্জন এবং বর্জন
সৃষ্টির পরিপূর্ণতা, পবিত্রতা অর্জনের জন্য আমরা যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করি তা একযোগে অর্জন এবং বর্জনের পথ। অর্জন হলো পবিত্রতা, যা বাহ্যিক শুদ্ধতা ও অভ্যন্তরীণ বিশুদ্ধতা তৈরি করার প্রক্রিয়া। এটা অভ্যন্তরীণ কলুষতাকে পরিহার করে আমাদের চিত্তকে সুনির্দিষ্ট, একাগ্র এবং নিঃশব্দ করে তোলে। বর্জন হলো ওইসব অবাঞ্ছিত বা অপ্রয়োজনীয় অনুভুতি, চিন্তা এবং চরিত্রের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যা আমাদের জীবনকে অপবিত্র করে ফেলে। এটি কেবল চিত্তের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে না, বরং আত্মিক বিকাশের পথেও বাধা সৃষ্টি করে।
পবিত্রতা অর্জন ও অপবিত্রতার বোধ
অপবিত্রতা হলো এক ধরনের অন্তর্নিহিত বিশৃঙ্খলা বা অস্থিরতা, যা মানুষকে তার আসল সত্তা থেকে বিচ্যুত করে। বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ অবস্থা যদি নিয়ন্ত্রণহীন হয়, তখন চিত্ত অস্থির এবং অনুভুতি অসংলগ্ন হয়ে ওঠে। তবে, যখন আমরা প্রতিদিনের চর্চা বা সাধনার মাধ্যমে এই অপবিত্রতাকে দূর করার চেষ্টা করি, তখন আমরা পবিত্রতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকি।
এই পবিত্রতা শুধুমাত্র বাহ্যিক কর্মে সীমাবদ্ধ নয়, বরং অন্তর্নিহিত মনের, চিন্তার, দৃষ্টিভঙ্গির এবং অনুভূতির পরিস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মানসিক শক্তির সুস্থতা, স্নিগ্ধতা এবং একাগ্রতা পবিত্রতা অর্জনের মূল উপাদান। কেবল বাহ্যিক কর্ম, যেমন স্নান করা বা শুদ্ধভাবে খাওয়া, যথেষ্ট নয়, বরং পবিত্রতা অর্জনের জন্য হৃদয় ও মনকে শুদ্ধ করার ওপরও একইভাবে গুরুত্ব দিতে হবে।
অস্তিত্বের ক্রিয়া
আমি-র সাথে যে ক্রিয়া সংঘটিত হয় তা মূলত গৃহকরণ এবং বৃজকরণ। গৃহকরণ হলো গ্রহণের প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যক্তি সঠিক চিন্তা, আত্মবিশ্বাস এবং পরিশুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে নিজের মধ্যে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে। বৃজকরণ হলো অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকারক বিষয় থেকে বর্জন করার প্রক্রিয়া। আমরা যদি কোনো কিছু গ্রহণ করি, তবে তা আত্মিক ও মানসিক বৃদ্ধি প্রদান করে, আবার যদি আমাদের মধ্যে কিছু অপ্রয়োজনীয় বা ক্ষতিকর বস্তু প্রবেশ করে, তা আমাদের অস্থির করে তোলে, অপবিত্র করে।
ছানা ও ছানার জল উদাহরণটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেভাবে দুধ থেকে ছানা উৎপন্ন হয় এবং ছানার জল আলাদা করা হয়, সেভাবেই আমাদের আত্মিক জীবনেও কিছু বিষয় গ্রহণযোগ্য আর কিছু অপ্রয়োজনীয়। এখানে ছানা এক ধরনের বিশুদ্ধতা বা নির্মলতা প্রতীক, যেখানে বর্জনীয় বিষয়গুলি আমাদের মনের অশুদ্ধতা ও দুশ্চিন্তা গুলো ছানার জল হিসেবে প্রতীকিত। সেই জল দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেই পবিত্রতা বজায় থাকে। এই উদাহরণে বলা হচ্ছে, যে কোনো কর্মকে সম্পূর্ণভাবে অর্জন করার জন্য আমাদের কিছু বিষয় বর্জন করতে হয়।
আধ্যাত্মিক সাধনা ও আত্মপরিচয়ের পথে
এই প্রসঙ্গের অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো, সত্যিকার আত্মপরিচয় বা সত্তার উপলব্ধি করার জন্য আমাদের নিজেদের অপ্রয়োজনীয় অনুভূতি, অভ্যাস এবং চিন্তা দূর করতে হবে। অর্থাৎ, আদর্শ ও উচ্চতর আধ্যাত্মিক অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য নিজের মনোজগতের শুদ্ধতা অর্জন করা গুরুত্বপূর্ণ।
যখন এই পবিত্রতা অর্জিত হয়, তখন চিত্ত শান্ত হয়ে উঠে, অহংকার, হিংসা, দ্বেষ, এবং ক্ষোভের মতো নেতিবাচক অনুভূতি দূর হয় এবং তাতে অভ্যন্তরীণ শांति এবং প্রফুল্লতা আসে। যা ব্যক্তির সাধনা বা ধর্মপথে অগ্রসর হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে।
শেষ কথা
এটি একটি গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধি, যা আমাদের মনে এবং জীবনে সম্যক পরিবর্তন আনতে পারে। পবিত্রতা অর্জন একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা সচেতনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং নিরন্তর সাধনার মাধ্যমে পাওয়া যায়। বর্জন আর অর্জনের মধ্য দিয়ে আমরা সত্তার ঐক্য, মানবিকতা এবং আধ্যাত্মিক সম্পূর্ণতার দিকে এগিয়ে চলি।
—ফরহাদ ইবনে রেহান