শামস তাবরীজের দর্শন
শামস তাবরিজ ছিলেন একজন প্রখ্যাত সুফি সাধক এবং মাওলানা রুমির গুরু। তিনি তার জীবন এবং শিক্ষা দিয়ে আধ্যাত্মিকতার নতুন এক অধ্যায় সৃষ্টি করেছিলেন। তার দর্শন বা চিন্তা প্রাচীন সুফি দৃষ্টিভঙ্গির থেকে একটি গভীর এবং নতুন দিক উন্মোচন করে, যা মানুষের অন্তর্দৃষ্টির প্রবাহকে চ্যালেঞ্জ করেছে। শামস তাবরিজের দর্শন মূলত প্রেম, আত্মসচেতনতা, আত্মসমর্পণ এবং একত্ব*কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল।
শামস তাবরিজের দর্শনের মূল বিষয় ঈশ্বরের প্রেম:
শামস তাবরিজের দর্শন মূলত ঈশ্বরের প্রেমের উপর ভিত্তি করে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃত প্রেম হল ঈশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্কের সবচেয়ে গভীর, শক্তিশালী এবং আধ্যাত্মিক রূপ। ঈশ্বরের প্রেমের মাধ্যমে একজন মানুষ আত্মজ্ঞান লাভ করে এবং তার জীবনে আধ্যাত্মিক মুক্তি আসে। শামস বলতেন, “প্রেমই ঈশ্বরের একমাত্র ভাষা।”
আত্মসমর্পণ:
শামস তাবরিজের মতে, আত্মসমর্পণ বা “তাওবা” আত্মার শুদ্ধির জন্য অপরিহার্য। তিনি বলতেন, মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে সমর্পণ করবে না, ততক্ষণ সে ঈশ্বরের সত্যকে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে না। আত্মসমর্পণ মানে নিজেকে পুরোপুরি ঈশ্বরের হাতে সঁপে দেওয়া এবং তার নির্দেশনা অনুযায়ী জীবনযাপন করা।
একমাত্রিকতা (Oneness) বা ওয়াহদাতুল উজুদ:
শামস তাবরিজ তার দর্শনে একত্ব বা ওয়াহদাতুল উজুদ ধারণাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। এর মানে হচ্ছে, ঈশ্বর এবং সৃষ্টি একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। শামস বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বরই সৃষ্টির মূল, এবং সব কিছু তারই প্রতিফলন। আধ্যাত্মিক দর্শন অনুযায়ী, যখন একজন সাধক প্রেম এবং আত্মজ্ঞান লাভ করেন, তখন তিনি ঈশ্বরের সাথে একাত্মতা অনুভব করেন। এখানে, আল্লাহ এবং সৃষ্টির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই; তারা একে অপরের মধ্যে বিদ্যমান।
সত্যের সন্ধান:
শামস তাবরিজ বিশ্বাস করতেন, সত্য শুধুমাত্র বাইরের জগৎ থেকে শোনা বা পড়া তথ্যে পাওয়া যায় না, বরং এটি একজনের অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান এবং আত্ম-অনুভূতির ফল। ঈশ্বরের সত্য শুধুমাত্র হৃদয়ে পাওয়া যায়, যেখানে মন এবং আত্মা এক হয়ে যায়। শামস বলতেন, “সত্য তখনই প্রকাশিত হয় যখন তুমি নিজের ভেতর দিয়ে তাকাও।”
বিরোধিতা ও দ্বন্দ্বের মধ্যে একতা:
শামস তাবরিজের মতে, পৃথিবী এবং পৃথিবীর সমস্ত কিছুই একটি বিরোধিতা বা দ্বন্দ্ব থেকে তৈরি। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব কখনোই বিভাজন সৃষ্টি করে না; বরং, এর মাধ্যমে সৃষ্টির একতা প্রকাশ পায়। যেমন, দিন এবং রাত, ভালো এবং মন্দ, শীত এবং গরম—এইসব দ্বন্দ্ব একে অপরকে পূর্ণ করে এবং সব কিছু একের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে। শামস বিশ্বাস করতেন, এই বিরোধিতার মধ্যেও গভীর একতা রয়েছে যা ঈশ্বরের পরিপূর্ণতা।
মৃত্যু এবং জীবনের অস্তিত্ব:
শামস তাবরিজ জীবনের মহত্ত্ব এবং মৃত্যুর ভয়ের ওপরে অতীত দেখতেন। তার মতে, মৃত্যু কেবল একটি পরিবর্তন, যা কোনো এক পরিসমাপ্তির নয় বরং একটি প্রক্রিয়া। তিনি বলতেন, “মৃত্যু তোমার প্রকৃত জীবনকে আরও গভীর এবং পুরোপুরি উপলব্ধি করার উপায়।” একজন সত্যিকারের সাধক কখনোই মৃত্যুকে ভয় পায় না, বরং সে মনে করে এটি একটি চিরন্তন পরিবর্তন যা প্রকৃতির নিয়ম।
ভালোবাসা (Love) ও আত্মজ্ঞান (Self-Knowledge):
শামস তাবরিজের মতে, ভালোবাসা এবং আত্মজ্ঞান একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্য। একজন মানুষ যত গভীরভাবে ভালোবাসবে, তার আত্মসচেতনতা তত বেশি প্রসারিত হবে। ভালোবাসা শুধুমাত্র অন্য মানুষ বা ঈশ্বরের প্রতি নয়, বরং নিজের প্রতি একটি গভীর শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার জায়গা থেকেই আসে। ভালোবাসা শুদ্ধ আত্মাকে প্রকাশিত করে এবং তাকে নিজের প্রকৃত উদ্দেশ্যে পরিচালিত করে।
গুরুর ভূমিকা:
শামস তাবরিজ গুরু এবং ছাত্রের সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। তিনি মাওলানা রুমিকে তার গুরু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং রুমির জীবন এবং দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। শামস বলতেন, “গুরু হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি তোমাকে তোমার নিজের সত্তা ও সত্য জানাতে সাহায্য করেন।”
শামস তাবরিজের দর্শনের মুল বক্তব্য:
- ভালোবাসা ঈশ্বরের প্রতি সম্পর্কের ভিত্তি।
- আত্মসমর্পণ হল আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতার পথে প্রথম পদক্ষেপ।
- প্রকৃতির একতা এবং সৃষ্টির সাথে ঈশ্বরের সম্পর্ক।
- জীবন এবং মৃত্যুর প্রকৃতি, যেখানে মৃত্যু শুধুমাত্র একটি পরিবর্তন।
গুরুর শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের আধ্যাত্মিক বৃদ্ধি ও প্রেমের সত্য উপলব্ধি।
শামস তাবরিজের দর্শন আধুনিক যুগেরও অনেক ভ্রান্ত ধারণা এবং আত্মিক সংকোচনগুলোকে সরিয়ে আধ্যাত্মিক মুক্তির পথ প্রদর্শন করে। তার চিন্তা ও শিক্ষাগুলি মানুষের হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে এবং তার জীবনকে একজন আত্মজ্ঞানী ও প্রেমময় ব্যক্তিতে পরিণত করে।
—ফরহাদ ইবনে রেহান