সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহ.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।

সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহ.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।

হযরত সুরেশ্বরী (রহ.)-এর পীর ও মুর্শীদ ক্বিবলা হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহ.)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী।

মা’শূকে এলাহী হযরত আহমদ আলী ওরফে জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী (রহ.)-এর মুর্শীদ ক্বিবলা সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম ওলী, গাউস এবং কুতুবদের অন্যতম। এই মহান ওলীর আলোচনায় একটি বিরাট গ্রন্থ রচিত হইতে পারে। আমরা তাঁহার সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করিব মাত্র।

তাঁহার পূর্ণ নাম হযরত সাইয়্যেদ শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহ.)। তিনি চট্টগ্রাম জেলার চুনতি গ্রামে ১৮২৫ খৃষ্টাব্দ মোতাবেক ১২২৩ বঙ্গাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ ওয়ারেস আলী শহীদ। তিনি হুগলী জেলার জগত বেড়পুর থানার অন্তর্গত বিখ্যাত উর্দু মাদ্রাসার সর্বোচ্য ডিগ্রী লাভ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শেষে তিনি চট্টগ্রামের নিজামপুর নিবাসী সুবিখ্যাত ওলী হযরত শাহ্ সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরীর (রহ.) নিকট মুরিদ হন। তিনি নকশবন্দিয়া-মুজাদ্দেদিয়া, চিশতীয়া এবং কাদেরিয়া তরিকার খেলাফত প্রাপ্ত ছিলেন। অপরদিকে তিনি ওয়াইসীয়া তরিকারও ওলীয়ে মুকাম্মেল এবং সিদ্ধ পুরুষ ছিলেন।

‘দিওয়ানে ওয়াইসী’ নামক গ্রন্থে হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী (রহ.) সম্পর্কে তাহার সংক্ষিপ্ত জীবনীতে লিখা হইয়াছে, “বিশ্ব বরেণ্য ফার্সী মহাকবি রাসুলে নোমা আল্লামা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়্যেদ ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহ.) এর পূর্ব পুরুষগণের আদি নিবাস ছিল আরব দেশের পবিত্র মক্কা নগরীতে, তিনি সাইয়্যেদেনা হযরত হোসাইন (রহ.) ও গাউসুল আযম হযরত বড়পীর মহীউদ্দিন আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) এর বংশধর। তাহার প্রথম পুরুষ ছিলেন কুরাইশ সম্প্রদায়ের হাসেমী গোত্রভুক্ত। কালের প্রবাহে তাহার পূর্ব পুরুষের প্রধান শাখা আরব হইতে ইরাকে এবং সেখান হইতে ইরানে হিজরত করেন। সেখানে কয়েক পুরুষ বসবাস করিবার পর মূখ্য একটি শাখা প্রথমে গজনী অতঃপর দিল্লীতে বসতি স্থাপন করেন। প্রপিতামহের ইহধাম হইতে বিদায় গ্রহণ করিবার পর হযরত ওয়াইসী পীর ক্বিবলা (রহ.) এর পিতামহ দিল্লী পরিত্যাগ পূর্বক বাংলাদেশের বন্দর নগরী চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত আমিরাবাজার নামক স্থানে বসতি স্থাপন করেন। এই গ্রামেই তাহার পিতা ক্বিবলা জন্ম গ্রহণ করেন।

হযরত শাহ্ সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী (রহ.) বাংলাদেশের বন্দরনগরী চট্টগ্রামের আমিরাবাজারে ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে শুভ জন্ম গ্রহণ করেন।” হযরত ওয়াইসী বাবা (রহ.) আরবী ও ফার্সী ভাষা এবং সাহিত্যে অসীম ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন কবি ছিলেন। ওয়াইসী ছন্দ নামে তাঁহার বহু কবিতা প্রকাশিত হইয়াছে। ‘দেওয়ানে ওয়াইসী’ নামে ফার্সী ভাষায় লিখিত তাঁহার একটি সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ রহিয়াছে। ১৯৩৫ সনে তাঁহার জনৈক পৌত্র গ্রন্থটি প্রকাশ করেন।

“ওয়াইসীয়া” আল্লাহ্ প্রাপ্তির অতীব উত্তম তরিকা। আধ্যাত্মিক ও রুহানী জগতে এই তরিকার গুরুত্ব ও স্বীকৃতি সর্বাধিক। এই তরিকার সিদ্ধি লাভের জন্য অন্যান্য তরিকার মত মাধ্যম প্রয়োজন হয় না। চিশতীয়া, কাদেরীয়া, নকশবন্দীয়া-মুজাদ্দেদীয়া কোন তরিকাতেই তামাশুরে শাইখ তথা মুর্শীদের মাধ্যমে ও সদয় তওয়াজ্জুহ্ ছাড়া মুরিদ বা সাধক সিদ্দি লাভ করিতে পারে না। ওয়াইসীয়া তরিকায় আশিকের ইশকের জোরে প্রেমবাণ মা’শূকের প্রেমময় হৃদয় পটে সরাসরি আঘাত করে। তখন মা’শুক আশিকের আকুল আকুতিতে সাড়া না দিয়া পারেন না।

এইজন্য মা’শুকের সাথে আশিকের দেখা-সাক্ষাৎও প্রয়োজন হয় না। হযরত ওয়াইস ক্বরণী (রহ.) ইহার সুপরিচিত উদাহরণ। হযরত ওয়াইস ক্বরণী (রহ.) এবং আল্লাহর হাবীব রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর মধ্যে বাহ্যিকভাবে কখনও দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই। তবু উহুদের যুদ্ধে প্রিয় নবী মা’শুকের দান্দান শাহাদাতের সংবাদ পাইয়া নিজের সব কয়টি দন্তই ফেলিয়া দিয়াছিলেন। অপরদিকে মহানবী (সা.) নিজের একটি জোব্বা মোবারক তাঁহার জন্য প্রেরণ করিয়াছিলেন। দেখা নাই, সাক্ষাত নাই, কোন মাধ্যমও নাই। অথচ আশিক মা’শুকের প্রেম বিনিময় অবারিত। ইহাই ওয়াইসীয়া তরিকার বৈশিষ্ট্য।

বাণীটি নূরেহক্ব গঞ্জেনূর কিতাবের।

হযরত সূফী বাবা ফতেহ্ আলী ক্বিবলা (রহ.) ওয়াইসীয়া তরিকার মুকাম্মাল ওলী এবং সিদ্ধপুরুষ ছিলেন বিধায় মহান ওলীদের দরবারে তাঁহার উচ্চাসন ছিল। শুধু তাহাই নহে, রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর সাথে তাঁহার অহরহ দীদার হইত। এজন্য তিনি ‘রাসুলেনোমা’ হিসাবে সকলের নিকট সুপরিচিত ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে, ওয়াইসীয়া ছাড়া অন্যান্য তরিকার ওলীগণের বেলায়েত বা প্রভাব স্ব-স্ব তরিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু ওয়াইসীয়া তরিকার প্রভাব সব তরিকায় বিস্তৃত।

এই জন্য ওয়াইসীয়া তরিকাকে সব তরিকার মূলাধার বলা হয়। হযরত সূফী ফতেহ আলী, ‘ওয়াইসী’ এবং ‘রাসুলেনোমা’ হওয়ার অনন্য গৌরব ও সাফল্যের বদৌলতে কাদরীয়া, চিশতীয়া, নকশবন্দীয়া-মুজাদ্দেদীয়া এবং ওয়াইসীয়া চারটি তরিকারই খেলাফত প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। বলা বাহুল্য যে, হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলাও তাঁহার মুর্শীদ ক্বিবলার নিকট হইতে চারটি তরিকার ফয়েজ ও বেলায়েত লাভ করিয়াছিলেন। উল্লেখ্য যে, হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কা’বা তাহার দিব্যজ্যোতিময় সিদ্ধগুরুর উসিলায় আরও চারটি তরিকার বেলায়েতের অধিকারী হইয়াছিলেন। তরিকা গুলির নাম যথাক্রমেঃ সারওয়ারদীয়া, মাছুমীয়া, কলন্দরীয়া এবং শাজলীয়া।

‘রাসুলেনোমা’ হযরত সূফী ফতেহ্ আলী ওয়াইসী ক্বিবলা (রহ.) বাংলা-ভারত পাকিস্তান তথা অবিভক্ত ভারত বর্ষের বহু সুবিখ্যাত হাদীয়ে জামান, ওলীয়ে মুকাম্মাল এবং মুর্শিদে বরহক্ব-এর মুর্শীদ ছিলেন। তাঁহার মুরিদদের মধ্যে তাঁহার অন্যতম প্রধান এবং প্রিয়তম শিষ্য হযরত সাইয়্যেদ শাহ্ সূফী আহমদ আলী ওরফে জানশরীফ শাহ্ সুরেশ্বরী ক্বিবলা ছাড়াও অন্যান্য খলিফাদের মধ্যে মশহুর ছিলেন হযরত মাওলানা আবুবক্কর সিদ্দিক (রহ.), হযরত মাওলানা সূফী আমজাদ আলী (রহ.), কলিকাতা মাদ্রাসায়ে আলিয়ার মুদাররেস কুদ্সিয়া তরিকার ইমাম হযরত মাওলানা ওয়াজেদ আলী (রহ.), হযরত মাওলানা গোলাম সোলাইমান (রহ.) এবং মুর্শীদাবাদের হযরত মাওলানা ইক্রামুল হক প্রমুখ। ইহারা প্রত্যেকেই বেলায়েতের এক একজন দিকপাল ছিলেন। এই মানব শ্রেষ্ঠ কুতবে ইরশাদ রাসুলে নোমা হযরত ওয়াইসী (রহ.) তাঁহার ভক্তদের কাঁদাইয়া ১৮৮৬ খৃঃ ৬ই ডিসেম্বর মোতাবেক ২০ শে অগ্রহায়ণ ১২৯৩ বাংলা হইধাম ত্যাগ করেন। তখন তাহার বয়স হইয়াছিল ৬৩ বৎসর। কলিকাতার মানিকতলায় মুন্সিপাড়া লেন, লালা বাগানে তাঁহার রওজা মোবারক অগনিত তরিকত পন্থীর জিয়ারতস্থান। প্রতি বৎসর ২৬ শে রমজান এই স্থানে তাঁহার উরস মোবারক উদযাপিত হয়।

তথ্যসূত্রঃ হযরত সুরেশ্বরী ক্বিবলা কাবা’র পবিত্র জীবনীগ্রন্থ- পৃষ্ঠা নং: ২৭
গ্রন্থটির লেখক: সাইয়্যেদ শাহ্ সূফী বেলাল নূরী আল সুরেশ্বরী। তিনি মহান সুরেশ্বর দরবার শরীফের বর্তমান গদিনশীন পীর ও মুর্শীদ ক্বিবলা।

সুফি ফতেহ আলী ওয়াইসী সম্পর্কিত আরো পড়ুন:-

 

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel