খাজা মাওলানা ছাইফুদ্দীন শম্ভূগঞ্জী (র.) এর জীবন ও কর্ম
গবেষক, বিশ্লেষক ও সাহিত্যিক- কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী।
বাংলা ও আসামের প্রখ্যাত অলিয়ে কামেল, হজরত মাওলানা শাহ্সূফি খাজা ছাইফুদ্দীন নক্সবন্দি-মুজাদ্দেদি (র.) বাংলাদেশের একজন সুপ্রসিদ্ধ সূফি-সাধক, গবেষক, বিশ্লেষক, দার্শনিক, গ্রন্থ প্রণেতা, সাহিত্যিক ও মরমি কবি। বিংশ শতাব্দীতে যেসকল সুফিয়ানে কেরাম ইসলামের সুবিশাল খেদমতের আঞ্জাম দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে তিনি এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। জ্ঞানীদের কাছে তিনি ছিলেন, চেতনার ও প্রেরণার বাতিঘর। তাঁরই হাত ধরে সত্যের দিশা পেয়েছেন অসংখ্য জ্বীন ও ইনসান। শৈল্পিক ও নান্দনিক শব্দের গাঁথুনি দিয়ে লিখেছেন একাধিক অনবদ্য রচনা সমগ্র, এরই স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৪ সালের ১৯ ই অক্টোবর ‘বাংলাদেশ লেখক সমিতি’ এবং ‘আন্তর্জাতিক সাহিত্য সমাজ’ তাঁকে সংবর্ধনা ও স্বর্ণপদক সম্মাননায় ভূষিত করেন।
খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) যমুনা নদীর তীরবর্তী সিরাজগঞ্জ এনায়েতপুর গ্রামে ৭ই জানুয়ারী ১৯২০ ইংরেজী, বুধবার, বিকেল ৪—৫ ঘটিকার সময় জন্মগ্রহণ করেন। খাজা ছাইফুদ্দীন (র.)’র পিতার নাম খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (র.) এবং মাতার নাম গোলেনূর (মহিলা কবি)। দাদার নাম মৌলানা শাহ্ আব্দুল করিম (র.) এবং দাদীর নাম মোছাম্মৎ তাহমিনা বেগম (র.)। বংশপরম্পরায় তাঁর ঊর্ধ্বতন মুরুব্বিয়ানে কেরাম ছিলেন পরহেজগার ও বুযুর্গ প্রকৃতির।
খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) প্রাথমিক ধর্ম পাঠ শিক্ষা নেন, জুনিয়ার মাদ্রাসা থেকে। এন্ট্রান্স (এস.এস.সি সমমান) পাশ করেন, সিরাজগঞ্জ স্থল পাকড়াশী ইন্সটিটিউশন স্কুল এন্ড কলেজ থেকে। উচ্চ মাধ্যমিক (এইচ.এস.সি সমমান) এবং বি.এ অনার্স (দর্শন) পাশ করেন, সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে। কুরআন, হাদিস, তফসির, ফিকাহ ও অন্যান্য ধমীর্য় পাঠ শিক্ষা নেন, মাও. নেয়ামত উল্লাহ (রহ.)’র কাছ থেকে। ইলমে মারিফত শিক্ষা নেন, পিতা মাওলানা খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (র.)’র কাছ থেকে।
খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) ছোটবেলা থেকে লেখাপড়া ও ইবাদত বান্দেগীর প্রতি প্রবল আগ্রহী ছিলেন। পাঞ্জেগানা নামাজের সাথে সাথে অধিকহারে নফল ইবাদত আদায় করতেন। অবসর সময়ে পারিবারিক পাঠাগারে মূল্যবান কিতাবাদি অধ্যয়ন করতেন। খুবই সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। প্রায় সময় আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবীব হজরত মুহাম্মদ (দ.)’র প্রেমে আত্মভোলা থাকতেন। খাওয়া—দাওয়া, পোশাক—পরিচ্ছেদ এবং ঘর—সংসারের প্রতি উদাসীন ছিলেন। ক্বলব ও জবান সর্বদায় আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূল (দ.)’র জিকিরে অবিশ্রান্ত থাকতো। অনুকরণীয় চারিত্রিক গুণাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি— (১) যুহুদ (দুনিয়া বিমুখতা), (২) তওবা (নিজকৃত পাপকার্য হতে আল্লাহ তা’আলার কাছে ফিরে আসা), (৪) তাক্বওয়া, (৫) পরহেজগারিতা, (৬) শোকর (কৃতজ্ঞতা), (৭) ছবর (ধৈর্য্য), (৮) তাওয়াক্কুল (নির্ভরশীলতা), (৯) খওফ (খোদাভীতি), (১০) রেজ্বা/রেদ্বা (সন্তুষ্ট), (১১) ইয়াক্বীন (বিশ্বাস), (১২) এখলাছ (একনিষ্ঠতা), (১৩) তাছলীম (শান্তি), (১৪) তাকমীলুল ইয়াক্বীন (দৃঢ়তার সাথে পরিপূর্ণ বিশ্বাস)।
খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) নবম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে ‘আদর্শ মুর্শিদ’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। বইটি দেখে পিতা খাজা ইউনুস আলী (র.) বলেছিলেন, ‘খাজা ছাইফুদ্দীন; ইলমে মারিফতের দরিয়া মন্থন করে আউলিয়া হয়ে গেছে; তাঁর আত্মা আর রাসূলুল্লাহ (দ.)’র আত্মা একাত্মা হয়ে মিশে গেছে’।
খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) অনার্স শেষ করে খন্ডকালীন শিক্ষকতা করেন, সিরাজগঞ্জ হাই স্কুলে। ফুড ইন্সপেক্টরের সরকারি চাকুরী করেন, চট্টগ্রাম শহরে। চট্টগ্রাম শহরে থাকাকালীন নন্দনকানন নিজস্ব বাসায় থাকতেন। সুতার ব্যবসা করতেন, ঢাকা নারায়ণগঞ্জে। নারায়ণগঞ্জ থাকাকালীন নারায়ণগঞ্জ ভাগ্যকুল জমিদারের ১৪, এস.এম রায় রোডস্থ শীতলক্ষ্যা নদীর তীর ঘেঁষা খাজা মঞ্জিলে বসবাস করতেন।
বায়হাকি গ্রন্থের শুআবুল ঈমান পরিচ্ছেদে এসেছে, হজরত আনাস ইবনে মালেক হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিয়ে করল সে তার অর্ধেক ইমান (দ্বীন) পূর্ণ করে ফেলল। অতএব, বাকি অর্ধেকাংশে সে যেন আল্লাহকে ভয় করে।’ খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) জীবন্নেছা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, ১৯৪৮ সালের ২১ ই এপ্রিলে।
খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (র.) বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গের রাজশাহী বিভাগের সিরাজগঞ্জ জেলার একজন সু-প্রসিদ্ধ অলি—আল্লাহ। পাক-ভারত উপমহাদেশে ধর্ম-প্রচারে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। তাঁর এ খেদমতের স্রোতধারা বিশ্বব্যাপী এখনো প্রবাহমান। তাঁরই হাতধরে এ উপমহাদেশে বহু পীর—আউলিয়া, ফকীর—দরবেশ, গাউছ, কুতুব, আবদালের জন্ম হয়েছে। তন্মধ্যে— সর্বসেরা যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন, মেজো ছেলে খাজা ছাইফুদ্দীন (র.)। তাঁর খোদাপ্রদত্ত গুণের কথা জন্মের বহু আগে বহু অলি—দরবেশ ভবিষৎ বাণী করেছিলেন। সৈয়দ ওয়াজেদ আলী মেহেদিবাগী (র.) শিষ্য খাজা ইউনুস আলী (র.) কে একদা বলেছিলেন, “বাবা ইউনুছ! এরপর তোমার একটি মহান পুত্ররত্ন জন্মগ্রহণ করবে। তখন আমি দুনিয়ার হায়াতে থাকব কিনা জানি না। তাই আজকেই তাঁর নাম রেখে দিলাম— খাজা ছাইফুদ্দীন। এ পুত্র রত্নটি বহুবিদ খোদাপ্রদত্ত গুণের অধিকারী হবে”।
খাজা ছাইফুদ্দীন (র.)’র যৌবনের ফুল সুবাস ছড়াবার আগেই স্কুলের প্রচলিত সিলেবাসের বাইরে এক নতুন দুনিয়ার সাথে পরিচয় হয়েছিলেন। যা সম্পূর্ণই আলাদা ও স্বতন্ত্র। অধ্যাত্মিক জগতের এ জীবন্ত কিংবদন্তি পিতা হতে বেলায়াতের অফুরন্ত নিয়ামত অর্জন করে আল্লাহ প্রদত্ত অধিক ঐশী জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত হয়ে—ফায়য (দয়া, প্রশান্তি), ফানা (আল্লাহতে বিলীন হয়ে যাওয়া), বাকা (আল্লাহর স্মরণে বেেঁচ থাকা), উরূজ (আরোহণ), সাইর (ভ্রমণ), দায়রা (বৃত্ত), দায়রায়ে বেলায়েতে কোবরা, দায়রায়ে বেলায়েতে উলিয়া, বেলায়েতে কামালাতে নবুয়াত, বেলায়েতে জামিয়ে কামালাতে রেছালাত, কামালাতে উলুল আযম মিনার—রাসূল, সেফাতে কাইউমিয়ার দায়রা, দায়রায়ে হকিকতে ঈছাবী, হকিকতে ইব্রাহীমি, দায়রায়ে হকিকতে মোহাম্মাদী, হকিকতে আহাম্মদী মাহবুবিয়াতে খালেছা, দায়রায়ে লা—তাইয়েন হকিকতে কাবা, হকিকতে মুহব্বত, দায়রায়ে হকিকতে সাইফুল্লাহ প্রভৃতি সমুদয় দায়রাস্থিত সকল সলুক ও মোকামাদি হাছিল করে আল্লাহর খাছুল খাছ অলিগণের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যান।
নেসবতে মুজাদ্দেদীয়ার উল্লেখিত চব্বিশ দায়রা, নেসবতে নকশবন্দীয়া, নেসবতে কাদেরিয়া, নেসবতে চিশতীয়া, নেসবতে মাদারিয়া, নেসবতে সোহরাওয়ার্দিয়া, নেসবতে কাবরূইয়া, নেসবতে মোসাফিয়া, নেসবতে হজরত রাসূল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল আছহাব ও আজওয়াজে মোতাহহারাত আয়ত্ব করে হজরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম—এর খাছ মোকামের উরূজ, ছায়ের, ফানা বাকা ও নেছবতে জামেয়ার সমস্ত ছলুক আয়ত্ব করে পিতার যাবতীয় অধ্যাত্মিক মিরাছের অধিকারী হয়ে কামেল মোকাম্মেল পীরের উচ্চাসনে সমাসীন হন। একদা খাজা ইউনুস আলী (র.) পুত্র খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) কে সৈয়দ ওয়াজেদ আলী (র.)’র পাগড়ি মুবারক পরিয়ে দিয়ে তরিক্বতের খেলাফত বখশিশ করেন। পূর্ববর্তী মাশায়েখগণ খলিফাদের খেলাফত প্রদানের নমুনা/নিদর্শন স্বরূপ খেলকা, জুব্বা, লাঠি, টুপি, পাগড়ী, তসবিহ সহ নানান বরককময় জিনিসপত্র প্রদান করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় খাজা ইউনুস আলী (র.) পুত্র খাজা ছাইফুদ্দীন কে পাগড়ী পরিয়ে দিয়ে তরীক্বতের ইয়াজত (অনুমতি) ও খেলাফত (প্রতিনিধিত্ব) অর্পণ করেছিলেন।
বহু নবী—রাসূল (আ.) এবং পীর—আউলিয়াগণ দ্বীন প্রচারের স্বার্থে জন্মভূমি ত্যাগ করে ভিনদেশে হিজরত করেছেন। দয়াল নবী হজরত মুহাম্মাদ (দ.) ইসলাম প্রচারের জন্য মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে জন্মভিটা এনায়েতপুর ত্যাগ করে স্ব—পরিবারে ময়মনসিংহ সদরের অদূর শম্ভুগঞ্জের লালকুঠিতে হিজরত করেছিলেন, সময়টা ছিলো ১৯৬৩ সালের ২২ই নভেম্বর রাত ২ টা। পরবতীর্তে লালকুঠি দালানটির নামকরণ করা হয় লালকুঠি পাক দরবার শরীফ। তৎকালীন সময়ে— ময়মনসিংহের ধমীর্য়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থা ছিলো খুবই নাজুক।
১৯৬৪ সালের লালকুঠি দরবার শরীফের ওরছ মাহফিলের একটা ঘটনা। জাকেরানের পদচারণায় মুখরিত দরবার শরীফ। জিকিরে, হালে, মুরাক্বাবায়, মুশাহেদায়, ফানা—ফিশ শায়খ—ই সকলি আত্মভোলা। একই দিনে ময়মনসিংহ শহরের সার্কিট হাউজ মাঠে ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খানের জনসভা। জনসভায় অসন্তোষজনক লোকের সমাগম ঘটেছিল। সন্তোষজনক জনসাধারণ প্রোগ্রামে উপস্থিত না হওয়াকে ইস্যু করে এক শ্রেণীর কুচক্রীমহল আইয়ুব খানকে জানালো যে, আপনার জনসভায় লোক কম হওয়ার কারণ হলো, নদীর ওপারে শম্ভুগঞ্জের এক পীর আপনার বিরুদ্ধে পাল্টা সভা করে অসংখ্য লোক আটকিয়ে রেখেছেন। আইয়ুব খান— সি.আই.ডি পরিদর্শককে বিষয়টির তদন্ত ও সত্যতা যাঁচাইয়ের জন্য পাঠালে সি.আই.ডি পরিদর্শক হুজুর কেবলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঘটনার সত্যতা যাচাই পূর্বক; হুজুর কেবলা ও পবিত্র অনুষ্ঠানের কথা জানালে আইয়ুব খান বলেন— আমাদের দেশ অলি—আল্লাহদের দোয়া—ই স্বাধীন হয়েছে। আমরা এখনো তাঁদের দোয়া কামনা করি।
খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) স্বাধীনতা যুদ্ধে স্ব—শরীরে অংশগ্রহণ না করলে—ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অসামান্য অবদান রেখেছেন। ত্রিশলক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা—বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পাওয়া লাল—সবুজের পতাকা। এ লাল—সবুজের পতাকার সাথে জড়িয়ে আছে, হাজারো পীর—আউলিয়ার রক্তঝরা ইতিহাস। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং আল—বদর ও আল—শামস বাহিনীর হাত থেকে এ দেশের মাঠি ও মানুষকে মুক্ত করতে যেভাবে ত্রিশ লাখ শহীদ আত্মদান করেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অসংখ্য নেতাকমীর্ প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছেন; অনুরূপে খাজা ছাইফুদ্দীন (র.)—ও মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং যু্দ্ধ পরবতীর্ সময় কালীন সময়ে প্রাণনাশের ভয় কে আল্লাহর শক্তিতে রূপান্তর করে স্বাধীনতার যুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
বঙ্গবন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণের পর থেকে মুক্তিকামী মানুষেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে। “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) তাঁর অনুসারীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন; সাথে নগদ অর্থ প্রদান এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পরিবারে আর্থিক অনুদান পাঠান।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে খাজা ছাইফুদ্দীন (র.)’র অবদান সম্পর্কে জানতে চাইলে, মুঠোফোনে মো.আবদুল হাকিম (বীর প্রতীক) জানান, “মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে খাজা ছাইফুদ্দীন (র.)’র অবদান ছিলো অবর্ণনীয়। ১৯৭১ সালে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার পদে চাকুরী করা পর—ও সেনা বিদ্রোহ করে তাঁর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ নির্দেশনায় আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। তাঁর দোয়া না থাকলে আমি যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করতাম!” খাজা ছাইফুদ্দীন (র.)’র অনুরক্ত ১১ সেক্টরের প্রবীণ বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মো.ফরিদুজ্জামান। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মহাসচিব— মুহাম্মদ গোলাম মুস্তফা ভুঁইয়াসহ আমি ০৬/০৭/২৪ ইংরেজী তারিখে দুপুর বেলায় আলোচ্য বিষয়ে স্বাক্ষাৎকারে তাঁর বাসায় (জলিমন, ১৯/৬, বাবর রোড়, মুহাম্মদপুর, ঢাকা) গেলে তিনি আমাদের জানান, ৭১ সালের এপ্রিলের শুরুতে আমি (মো.ফরিদুজ্জামান) আর বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইদুল ইসলাম বাদশা, লালকুঠি পাক দরবার শরীফে উপস্থিত হই এবং আমাদের পরম দরদি আপনজন খাজা ছাইফুদ্দীন (র.)’র সাথে স্বাক্ষাৎ করি। আমাদের দেখে তিনি ভীষণ খুশি হয়ে কিছুক্ষণ আলাপ করলেন এবং ভাত খাওয়ালেন। এরপর তিনি বললেন, “তোমরা দেশের স্বাধীনতার জন্য চলে যাও, তোমাদের আল্লাহ ও রাসূল (দ.)’র হাতে সপে দিলাম’। বিদায় বেলায় দু’জন কে ৫০ কিংবা ১০০ টাকা হাতে দিলেন।
বস্তুত— আমরা যে, স্বাধীনতার জন্য ঘর থেকে বেরিয়েছি তা আমাদের—ও পরিবারকে—ও আমরা জানায়নি এবং খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) কে—ও স্বাক্ষাতে বলিনি। কিন্তু তিনি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য উৎসাহ দিলেন এবং সাথে টাকা—ও দিলেন। বিষয়টি আমাদের কাছে খুবই রহস্যসময় মনে হলো। তবে আমরা পূর্ব থেকে জানতাম তিনি কাশ্ফধারী অলি—আল্লাহ। খাজা ছাইফুদ্দীন (র.)’র যেসমস্ত অনুরক্ত স্বাধীনতার যুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন তাঁদের নাম সমূহ— (১) মো.আবদুল হাকিম— বীর প্রতীক, (২) ইঞ্জিনিয়ার মো.ফরিদুজ্জামান, (৩) বাহা উদ্দীন, (৪) সাইদুল ইসলাম বাদশা, (৫) মো. হামিদুর রহমান, (৬) ইউসুফ আলী, (৭) দেলোয়ার হোসেন, (৮) মো.জালাল উদ্দীন, (৯) আবদুল ওহাব, (১০) মো. আবদুল আজিজ, (১১) মো.শাহজাহান আলী, (১২) মো.সিরাজুল ইসলাম, (১৩) সিকান্দার আলী, (১৪) সোহরাব আলী, (১৫) মৃত দেলোয়ার হোসেন, (১৬) হরমুজ আলী, (১৭) জালাল উদ্দীন আহমদ, (১৮) মো.আমজাদ হোসেন, (১৯) শাহজাহান আলী, (২০) মো. মোয়াজ্জেম হোসেন, (২১) মো.আবদুস সামাদ, (২২) আবদুল কুদ্দুস, (২৩) মো. খলিলুর রহমান, (২৪) মো.শামসুল হক, (২৫) মো.মোখেলছুর রহমান, (২৬) সিরাজুল হক, (২৭) আবু আহমদ সিদ্দিকী। এ তালিকা সংগ্রহে আমাকে সহযোগিতা করেছেন, মো.আবদুল হাকিম— বীর প্রতীক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মো.ফরিদুজ্জামান এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হামিদুর রহমান।
১৭ ই এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয়— মুজিবনগর সরকার (বাংলাদেশের প্রথম সরকার)। একই দিনে ময়মনসিংহ শম্ভুগঞ্জের গোদারা ঘাটে বিমান হতে বোমা বর্ষণ ও মেশিনগান ফায়ারিং করা হয়। ফলে গোদারা ঘাটে ৩টি বাস ও একটা ট্রাকে আগুনে ভস্মিভূত হয়। এতে আট জন মৃত্যুবরণ করে শাহাদাত বরণ করেন, অনেক লোক আহত হন এবং সাথেসাথে পাক বাহিনী লালকুঠি পাক দরবার শরীফের চারিপার্শ্বে বিমান হতে গোলাবর্ষণ শুরু করে। আল্লাহর অপার কুদরতির শক্তির মহিমায় লালকুঠি পাক দরবার শরীফে অবস্থানরত সকলি রক্ষিত ছিলো।
এ ঘটনা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী পীরপুত্র খাজা আলাউল হক অলি সাহেব বলেন, “লালকুঠি ধ্বংস করার জন্য হানাদার বাহিনীর দুটি জঙ্গি বিমান আনুমানিক ৫০০ ফিট লেভেন হাই থেকে লালকুঠিতে গোলাবর্ষণ শুরু করে। আমি পাইলট এবং বন্দুকধারীদের সু-স্পষ্টভাবে দেখেছি। এ বিপদ অবস্থা দেখে পীরপুত্র খাজা আবদুর রউফ খসরু লাইসেন্সধারী আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ফায়ারিং করার প্রস্তুতি নিলে আব্বাজান বারণ করেন। গোলাবর্ষণের ফলে লালকুঠির টিন গুলো ছিদ্র হয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে একটি গুলি—ও আমাদের পরিবার—পরিজনের গায়ে লাগেনি”। তিনি আরো—ও বলেন, “এ কঠিন মুহূর্তে আব্বাজান লালকুঠির দ্বিতীয় তলা থেকে নিচতলায় নেমে উত্তর—পূর্ব কোণের আঙ্গিনার একটি গাছের নিচে বসে আল্লাহর কুওয়তের ফয়েয (আল্লাহর ক্বাহারিয়াতের ফয়েয) জারি করার জন্য মোবাক্বাবায় ধ্যানমগ্ন হলেন। তৎক্ষণাৎ দেখতে পেলাম, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং একটি ঘূণিঝড় শুরু হয়ে সর্বদিকে অন্ধকার নেমে আসে। এ অবস্থা দেখে জঙ্গি বিমান দ্রুত লালকুঠি দরবার শরীফ এরিয়া ত্যাগ করে। এভাবে আল্লাহ তা’আলা আমাদের পুরো পরিবারকে হেফাজত করেছেন”। প্রকৃত আউলিয়াগণ আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করেনা। কারণ আল্লাহ তা’আলা হাদীসে কুদসীতে বলেন, “হে আদম সন্তান! কারো ক্ষমতাকে কখনো ভয় করবেনা। যতক্ষণ আমার ক্ষমতা (রাজত্ব) থাকবে। আর আমার ক্ষমতা কখনো নিঃশেষ হবেনা”।
খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) স্বপ্নে দেখতে পেলেন, “তরিক্বতের উর্ধ্বতন মাশায়েখগণ ময়মনসিংহ লালকুঠি দরবারে তশরিফ আনলেন, তন্মধ্যে— (১) হজরত সৈয়দ আহমদ শহীদ রায়ব্রেলভী, (২) হজরত সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসি বর্ধমানী, (৩) হজরত সৈয়দ ওয়াজেদ আলী মেহেদিবাগী, (৪) হজরত খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী। খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী উপস্থিত জাকেরানদের জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের হুজুর কোথায়”? উত্তরে জাকেরানগণ বললেন, তিনি উপর তলায় আছেন। এনায়েতপুরী (র.) জাকেরানদের তরিক্বতের উর্ধ্বতন মাশায়েখে কেরামদের সাথে পরিচয় করে দিলেন। তৎপর পীরানে তরিক্বতগণ লালকুঠির উপর তলায় তশরিফ নিলেন এবং মিলিটারির পোশাক পরিধান করে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম দিকে মুখ করে কামান ফিট করে স্ব—স্ব আসন গ্রহণ করলেন এবং তৎক্ষণাৎ দক্ষিণ দিক হতে একটি বোমার শব্দ শুনতে পান তাঁরা।
সাথে সাথে তাঁরা—ও গোলাবর্ষণ শুরু করেন। গোলাবর্ষণের ফলে চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়। ১ ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পর অন্ধকারাচ্ছন্ন কেটে যায়; তৎপর খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (র.) জাকেরানদের বললেন, ‘‘তোমরা তোমাদের হুজুরকে (খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) সরিয়ে নিয়ে যাও, আমরা বাড়ী এবং মাজহাব হেফাজত করব”। এখানে একটি বিষয় বলে রাখা দরকার, হজরত মাওলা আলী (রাদ্বি.) যুদ্ধের ময়দানে বিপক্ষ শক্তির বিরুদ্ধে কোনসময় সর্বপ্রথম তলোয়ার চালাননি, শত্রু পক্ষের আক্রমনের পর তিনি তলোয়ার চালিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে মাওলা আলীর প্রতি রাসূলে পাক (দ.)’র নির্দেশনা—ও ছিলো। হাদীসে শরীফে— ভাল স্বপ্নকে সত্য বলে সত্যায়িত করেছেন। হজরত আনাস (রাদ্বি.) থেকে বর্ণিত, ‘‘নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মুমিনের স্বপ্ন নবুয়তের ছেচল্লিশ ভাগের এক ভাগ’’। (বুখারী পর্ব ৯১ অধ্যায় ১০ হাদীস নং ৬৯৯৪; মুসলিম ৪২ হাঃ ২২৬৪)।
স্বপ্নের পর খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) স্ব—পরিবারে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে তৎপর নেত্রকোনার চরপাড়া গ্রামের সুরুজ মিয়ার বাড়ীতে চলে আসেন, সেখানে তিনি স্ব—পরিবারে একমাস অবস্থান করে পুনরায় শম্ভূগঞ্জ লালকুঠি পাক দরবার শরীফে প্রত্যাবর্তন করেন। কিছুদিন পর শম্ভূগঞ্জ হতে স্ব—পরিবারে পৈত্তিক জন্ম ভিটা সিরাজগঞ্জ এনায়েতপুর পাক দরবার শরীফে চলে যান। কিছুদিন পর এনায়েতপুর পাক দরবার শরীফ হতে স্ব—পরিবারে পুনরায় লালকুঠিতে চলে আসেন। ৭১ এর এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর মাসের প্রতিটি ক্ষণে ক্ষণে তিনি স্বাধীনতার যুদ্ধের চিন্তায় বিভোর ছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ মুক্তিযোদ্ধাগণ দিকনির্দেশনা ও দোয়া নেওয়ার জন্য তাঁর কাছে ছুটে আসতেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সৎ সাহস, বুদ্ধি ও পরামর্শ দিতেন এবং সাথে শুকনো খাবার এবং নগদ টাকা দিয়ে দিতেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী পরিবারের খোঁজখবর নিতেন এবং নগদ টাকা, চাউল, খাদ্যদ্রব্যসহ সকল প্রকার সাহায্য—সহযোগিতা করতেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এনায়েতপুর পাক দরবার শরীফে অবস্থানকালে খাজা ছাইফুদ্দীন (র.)’র বুযুর্গ স্ত্রী হজরত জীবন নেছা (র.) পদার্ অন্তরালে থেকে লাইসেন্সধারী আগ্নেয়াস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এভাবে এ মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের সাহসী স্ত্রী—ও স্বাধীনতার যুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
মুরিদ সন্তানগণ যুদ্ধে অংশগ্রহণকালে এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে লালকুঠিতে আগমন করলে তাঁদের নগদ অর্থসহ শুকনা জাতীয় খাবার প্যাকিং করে দিতেন ছাইফুদ্দীন (র.) ও তাঁর বুযুর্গ স্ত্রী। উত্তাল একাত্তরে খোদা তা’আলার দরবারে খাজা মাওলানা ছাইফুদ্দীন এনায়েতপুরী শম্ভূগঞ্জী (র.)’র ফরিয়াদ ছিলো নিরন্তর। ১৬ ই ডিসেম্বর পীর—আউলিয়াদের দোয়ার বরকতে এবং জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের আত্মদানের বিনিময়ে আমরা পেলাম— লাল—সবুজের একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র; বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে একটি ময়ূরের স্মৃতির কথা স্বরচিত গ্রন্থে লিখেছেন— সখিন আর্কিটেক্টর, সাহিত্যিক, সাবেক বিমান পাইলট, খাজা আলাউল হক অলি। তিনি তাঁর গ্রন্থে লিখেছেন, “প্রয়াত মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী—তিনটি ময়ুয়ের বাচ্চা নিয়ে আব্বাজানের সমীপে হাজির হন। বহুদিন আগের কথা। পূর্ব পাকিস্তানের শেষের দিকে যখন স্বাধীনতা সংগ্রামের শক্তি ক্রমশঃ এ দেশবাসীর হৃদয়ে দানা বাঁধছিল। বাচ্চাগুলো সাহজিক ভাবে মুক্ত পরিবেশে হাঁস— মুরগীদের সংগে বড় হতে থাকে। কিছুদিন পর অবশ্য দু’টি বাচ্চা আসুস্থ হয়ে মারা যায়। বেঁচে থাকে শুধু একটি যা পরবর্তী সময়ে আমরা পূর্ণাঙ্গ পুরুষ ময়ুর রূপে দেখতে পাই। ময়ুরটির যেমন ছিল রূপ তেমনি ছিল ক্ষিপ্রতা। যে কেউ এর রূপ এড়াতে পারতো না। মাটিতে বিচরণ করতো। সাপ, ব্যাঙ— পোকামাকড় আহার করতো দিনভর। স্বাধীন মুক্ত পরিবেশে পেখম তুলে নৃত্য করতো কেকা তীব্র ডাকে চমকিত করতো অভিনব শব্দে। শব্দ অনুসরণ করে গিয়ে দেখতাম একদল মানুষ পাখিটিকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুগ্ধ নয়নে। এমন রাজশ্বিক পাখিটি কার না ভাল লাগে! দূর—দূরান্ত থেকে বহু লোক আসতো এ অসামান্য রূপবান পাখিটিকে দেখতে। আব্বাজান লালকুঠির উত্তরের কাঠের বারান্দায় যখন বসতেন ময়ূরটি পূর্বদিকের শিমূল গাছের উচু ডাল থেকে উড়ে এসে রেলিং—এ বসতো। তখন তিনি পাখিটির ঝুঁটিমূল আঙ্গুল দিয়ে বিলি কেটে দিতেন। এ মিথক্রীয়ায় ময়ূরটি আপনত্বের স্পর্শে চোখ বন্ধ করে মাথাটি তার প্রভুর দিকে প্রসারিত করতো। নিয়মিত ভাবে পাখিটিকে কলা—বুট—বাদাম হাতে তুলে খাওয়াতেন। এভাবে তিনি ভালবাসার বন্ধনে বুনো পাখিটিকে বন্দী করেছিলেন”।
খাজা ছাইফুদ্দীন (র.)’র জীবনদর্শন সমূহের মধ্যে— আযিযি, ইন্তেজারি, আদব, খওফ, তাক্বওয়া, সাধনা, নম্রতা, বিনয়ীতা, শ্রদ্ধা, ভক্তি, মেহমানদারিতা, মুহাব্বত, দান—খয়রাত, মানবতা, উপহার প্রদান, মানবসেবা, সমাজসেবা, জীবপ্রেম উল্লেখযোগ্য। তিনি দরবারের চারপাশে অসংখ্য পাখির বাসা বেেঁধ পাখিদের থাকার ব্যবস্থা করতেন এবং নিয়মিত খাবার—ও প্রদান করতেন।
ছাইফুদ্দীন (র.) এতই মানবিক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন যে, তা লেখায় প্রকাশ করার মত না। শীতকালে তিনি চার কোণা বিশিষ্ট তেলের টিনে ডিম ওয়ালা শিং এবং মাগুর মাছ ব্রহ্মপুত্র নদে অবমুক্ত করে মাছের উৎপাদন বাড়াতেন। তিনি নিজেই দরবারের চারপাশে ফলের গাছ রোপন করতেন এবং লোকজনের মাঝে গাছের চারা বিতরণ করতেন। মেহমানদের জন্য তিনবেলা থাকা—খাওয়ার সু—ব্যবস্থা করতেন, যা এখনো—ও চালু আছে। ফকির—মিসকিন ও গরীবদের অকাতরে সাহায্য—সহযোগিতা করতেন, তা—ও চালু আছে। মাঝেমধ্যে ৫—৭ জন ফকিরের দল লালুকঠিতে আসতেন এবং সুরেসুরে গজল গাইতেন। এঁরা সবাই অঙ্গহানি বিশিষ্ট ছিলেন। তিনি তাঁদেরকে নাজরানা পেশ করতেন। তবে তাঁর ওফাতের পর ফকিরের দলটি আর দরবারে আসেনি বলে জানান পীরপুত্র খাজা আলাউল হক অলি।
আকাঈদের কিতাবে বলা হয়েছে, কারামাতুল আউয়িয়ে হাক্কুন। খাজা ছাইফুদ্দীন (র.)’র ছেলের ঘরের নাতি খাজা আমির ফয়সাল ২০০০ সালে মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল হাসপাতালের ৭ নং শিশু ওয়ার্ডে মৃত্যু শয্যা অবস্থায় ছিলেন। ডাক্তারের হাল ছাড়া অবস্থা দেখে পীরপুত্র খাজা অলি সাহেব পিতার কাছে ছুটে এসে বললেন, “বাবা! ফয়সালের বিষয়ে আপনার হস্তক্ষেপ প্রয়োজন”। এ কথা শুনে তিনি হুজুরাতে ঢুকে পড়েন এবং কামরার ভেতরের দরজা লক করে দেন। কিছুক্ষণ পর কামরা থেকে বের হয়ে বললেন, “জিন্দা পীরের দোয়া ও বরকতে ফয়সালের বালা (মুসিবত) দূর হয়ে গেল”। ফয়সাল সাহেব এখনো হায়াতে বর্তমান।
খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) বিশ্ব দরবারে তরিক্বত প্রচারে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তন্মধ্যে— বাংলাদেশ ও ভারতে (আসাম, কলকতা)। বিশ্বের নানা প্রান্তে তাঁর অসংখ্য রূহানী সন্তান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তিনি রূহানী সন্তানদের ঔরসজাত সন্তান থেকে—ও প্রাধান্য দিতেন। তিনি পিতা খাজা ইউনুছ আলী (র.) থেকে তরিক্বতের শিক্ষা যেভাবে পেয়েছেন, সেভাবে তরিক্বা প্রচার ও তরিক্বার শিক্ষা অব্যাহত রেখেছিলেন। কালের আবর্তনে, সময়ের পরিবর্তনে বিভিন্ন তরিক্বা—ই সংযোজন ও বিয়োজন ঘটেছে। কিন্তু শম্ভুগঞ্জী পীর সাহেবের সন্তানদের কাছে তরিক্বা—ই নক্সবন্দি ও মোজাদ্দেদী এখনো—ও অবিকৃত অবস্থায় আছে। তরিক্বতের পাঠাদান ও শিক্ষা পদ্ধতিতে সংযোজন ও বিয়োজন ঘটলে রূহানিয়াতের মধ্যে বিঘ্নতা ঘটে। প্রকৃত সাধকগণ— কথা বলে কম, খায় কম, ঘুমায় কম এবং বিনয়ী হয়। তাঁদের জবান থেকে মুখনিসৃত কথা মানুষকে মধ্য আকর্ষণ শক্তির মত প্রভাবিত করে তুলে। তাঁদের চেহরার মধ্যে নূরে মুহাম্মাদি (দ.)’র নূর চমকায়। তাঁরা সবসময় মৌনতা অবলম্বন করে। তাঁদের হালের মধ্যে মাঝেমাঝে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। কিছুক্ষণের জন্য তাঁরা নিশ্চুপ হয়ে আনমনা হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। আউলিয়াদের বড় কারামত হচ্ছে, জীন ও ইনসানকে হেদায়াতের পথে নিয়ে আসা।
প্রখ্যাত এ সুফিতত্ত্ববিদ শুধুমাত্র পীর—মুরিদী, ধর্মপ্রচার আর মানবসেবা মূলক কর্মকান্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন না। সাহিত্য জগতে তিনি অবিস্মরণীয়ভাবে অবদান রেখেছেন। তিনি স্ব—হস্তে লিখেছেন বহু কিতাবাদি। রচনা সমগ্র— (১) আদর্শ মুর্শিদ, (২) ঈদ—ই মিলাদুন্নবী (দ.) আ মৌলুদে খায়রুল বারিয়াহ, (৩) সূফি দর্শন ও সূফী দার্শনিক, (৪) তাছাউফের ওজিফা বা মারেফতের তত্ত্ব, (৫) রাজনৈতিক কোন্দলের আবর্তে নির্যাতিত নবী বংশ, (৬) গায়েবী এলম ওয়াছিলা অন্বেষণ, (৭) ইসলামে তাছাওউফ বা মারেফাত তত্ত্ব, (৮) আহলে বাইত ও শহীদে কারবালা, (৯) সেজরায়ে মোবারক, (১০) হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.)’র জীবনী গ্রন্থ, (১১) ফাজায়েলে জেয়ারতে মাযার, (১২) ওরছ প্রসঙ্গ। বানী চিরন্তর— (১) ইসলাম শুধু শরিয়ত নহে। শরিয়ত, তরিক্বত, মারিফত ও হাকিকতের সমন্বয়ে পূর্ণ ইসলাম, (২) মুমিন ও মুসলমান এক কথা নহে, (৩) যে আহলে বায়াতের বা নবী বংশীয়দের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও মুহাব্বত পোষণ করে না; সে প্রকৃত মুমিন নহে, (৪) আইনুল একিন ও হাক্কুল একিন ব্যতিরেখে ঈমানের আলা দরজা লাভ করা যায় না।
খাজা ছাইফুদ্দীন (র.) ১৯৮৭ সালের দিকে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোড়ের ৩৫৬ নং বাসার ২য় তলায় স্নেহধন্য সন্তান খাজা অলিউল হক অলি সাহেবকে ডেকে বললেন, ‘লাখ—বাগ কী’? সোজা—সাপটাভাবে উত্তরে তিনি বললেন, বাবা! আমি জানিনা। উত্তরে তিনি বললেন, মোঘল বাদশারা এক লক্ষ আম গাছের যে বাগান সৃষ্টি করে তাঁকে ‘লাখ—বাগ’ বলা হয়। সেসময়ে অলি সাহেব ছিলেন, বিমান পাইলট (ইন্সটেক্টর— গোলাম মতুর্জা, প্রশিক্ষক— ক্যাপ্টেন আহসান)। পিতার ‘লাখ—বাগ’ কথা শুনে তিনি নিজের চিন্তার জগতকে পরিবর্তন করতে শুরু করেন এবং গাছ রোপন ও গাছ বিতরণ কর্মসূচি হাতে নেন। পরবতীর্তে অলি সাহেব ২০০০ সালে ‘লাখ—বাগ’ নামে একটি নাসার্রি প্রতিষ্ঠা করেন লালকুঠি পাক দরবার শরীফে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ অবধি তিনি এক লক্ষাধিক লিচু, আম, রঙ্গিন কাঠালসহ নানান ফলজ গাছের চারা বিতরণ করেছেন।
লালকুঠি দরবার শরীফের চারপাশে নানান ফল গাছ, মসলা গাছ, আচারের গাছসহ বিভিন্ন দেশী—বিদেশি গাছের সমারোহ দেখলে মনে হয় এটি একটি ফলের বাগান। দরবারের চারপাশে রয়েছে— আম, লিচু, কাঠাল, সাদা জাম, লুকলুকি বা টিপাফল, করমচা, দারো চিনি, তেজপাতা, এভোকাডো, চালতা গাছসহ আরো—ও নাম না জানা গাছ—গাছালি। দরবারের চাষাবাদী জমিনে ধান চাষ—ও করা হয়।
দরবার শরীফের পক্ষ হতে প্রতি শীতকালে বিনামূল্যে ৪ হাজার মাছের পোনা বিতরণ করা হয় সর্বসাধারণের মাঝে। লালকুঠি দরবার থেকে এ উৎপাদিত পণ্য—সামগ্রী বৃহৎ ময়মনসিংহ এর সিংহভাগ মানুষের চাহিদা পূরণ করে থাকে। এ দরবারে রয়েছে একটি মাদ্রাসা ও একটি এতিমখানা মাদ্রাসা। ছাত্রদের খাবার পরিবেশন দেখে খুবই মুগ্ধ হলাম। কারণ— আমি নিজে—ও ১২ বছর মাদ্রাসার হোস্টেলে কাটিয়েছি এবং বিভিন্ন দরবার সংশিষ্ট এতিমখানা পরিদর্শন করেছি। সেসমস্ত প্রতিষ্ঠানে খাবারের মান খুবই নিম্মমানের। আর এখানে দেখলাম ভিন্ন চিত্র। ছাত্রদের জন্য খাবার রান্না করা হয় আলাদাভাবে আর মেহমানদের জন্য রান্না করা হয় আলাদাভাবে। ছাত্রদের জন্য প্রতি বেলায় ভাল মানের ও সুস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন করা হয়। পীরপুত্র অলি হুজুরের একটি কথা আমাকে ভাবিয়ে তুলে— “আমি বিমান পাইলট ছিলাম, আমার বন্ধুরা আজ সবি প্রতিষ্ঠিত; দামি গাড়ী ও বাড়ীর মালিক! আমি আমার পিতার অধ্যাত্মিক দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে বাদশাহী জীবন ছেড়ে ফকিরি জীবনে এসেছি। কানাডা যাওয়ার মত সুবর্ণ সুযোগ—ও ত্যাগ করেছি। শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূল (দ.)’র সান্নিধ্য লাভের আশায়। ঢাকা শহর কখন গিয়েছি ভুলে গিয়েছি। গরীব জাকেরদের সাথে মিশে থাকতে আমার বেশ ভাল লাগে। এজন্য আমার কোন অনুশোচনা নেই। আমি মারিফতের এ অতল সাগরে ডুব না দিলে ধ্বংস হয়ে যেতাম (অথার্ৎ— আল্লাহর ও রাসূলের দর্শন পেতাম না)। এজন্য আমার পরম পিতার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি”।
আমার বাবা সত্যিকারের আল্লাহর অলি ছিলেন। এ কথা শুনে ভাবতে ভাবতে আমি নিজকে বললাম— ‘তুমি সত্যকে দর্শন করো, মিথ্যাকে ছাড়ো, তবে নাজাত মিলবে”। স্ব—শরীরে দরবার শরীফ পরিদর্শন করে দেখলাম, উৎপাদিত মসলা আর লাকড়ি মজুদ করে রাখা হয়েছে। বড় বড় ডেকসিতে রান্না করা হচ্ছে মেহমানদের জন্য সুস্বাদু খাবার। খাদ্য রান্নাঘর আর খাবার পরিবেশন ঘর খুবই গুছালো এবং পরিপাটি। খাজা ছাইফুদ্দীন (র.)’র একটি নান্দনিক পারিবারিক ঘরকে ছাত্রদের ছাত্রাবাসে রূপান্তর করা হয়েছে, সেখানে ছাত্ররা থাকেন। এ দরবারে বিভিন্ন সময়ে সর্বসাধারণের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে শিক্ষা—সামগ্রীসহ বই—ও বিতরণ করা হয়। গরীব ভক্ত—মুরিদানদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা হয়, এ ঘটনা এ দরবারের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। মানবতা কাকে বলে? ইসলামের প্রকৃত দর্শন কী লালকুঠি দরবারে গেলে বুঝা যায়। আমি মাদ্রাসায় পড়েছি, কলেজে পড়েছি— শুধু বই—পুস্তকে ধর্ম কে জেনেছি। বাস্তব ইসলাম ধর্মকে দর্শন করতে পারিনি। আল্লাহর অলিদের জীবনাদর্শন আমাদের অনুরকরণ করা দরকার; অনুসরণ নয়।
মাজার জেয়ারত করতে গিয়ে কিছু অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে হলাম। দেখতে পেলাম, রওজার চারপাশে ঘূর্ণায়মান চৌবাচ্চায় রংবেরং এর সুন্দর মাছ গুলো রওজার চারপাশে প্রদক্ষিণ করছে। রওজার চারপাশে অসংখ্য পশু—পাখির কিচিমিচির শব্দ, গাছের পাতার মর্মর শব্দ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নান্দনিক কারুকার্য শোভিত শিল্পকার্য। রওজার উত্তর ও দক্ষিণ পাশে দুটি ভেন্টিলেটরে দুটি চড়–ই ২৪ ঘন্টা অনবরত কিচিমিচি শব্দের গুনগুনানীতে প্রাণবন্ত। রওজার চারপাশে চারটি ফ্যান অনরত চলছে আর পাখিরাও মনের আনন্দে ডানা মেলে উড়ছে কিন্তু কোন পাখি হতাহত হতে দেখিনি। রওজার ভেতরে ও বাইরে দেখলাম ফ্ল্যাট বাসার মত বক্স আকারে অসংখ্য পাখির বাসা ও খাদ্যদানি নিমার্ণ করে রাখা হয়েছে আর সেখানে পাখিরা বসবাস করছে। রওজার চারপাশে চারটি মিনার; নিচ থেকে সরু হয়ে উপরের দিকে প্রশস্ত হয়ে নির্মিত। এ ধরণের স্থাপনা সচরাচর অন্যান্য মাজার বা ধমীর্য় স্থাপত্যশৈলীতে দেখা যায়না; এ ডাইমেনশনের বিষয়ে আর্কিটেক্টর, সাহিত্যিক, সাবেক বিমান পাইলট— খাজা আলাউল হক অলি সাহেব থেকে জানতে চাইলে তিনি আমাকে বলেন— আল্লাহ অসীম, তাই ডাইমেনশনটি রূপক অর্থে অসীমের নিদর্শন।
আল্লাহর এ মহান অলিয়ে কামেল— ১৯৯৫ সালের ১৫ ই অক্টোবর, রবিবার ১—৪৫ মিনিটে বেছালে হক্ব লাভ করেন। ইন্তেকালের সময়ে দরবারের সমস্ত পশু—পাখি কিচিমিচি শব্দে সুরে কান্নার রোল তুলেছিলো। এ ঘটনা এটাই প্রমাণ করে যে, তাঁর হৃদয়ে কতই না প্রেম ছিলো জীবাত্মার প্রতি।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন,
‘জীবে প্রেম করে যেই জন
সেই জন সেবিছে ঈশ্বর’
বিশ্বের বহু জ্ঞানীগুণী, রাজনীতিবিদ, অধ্যাত্মবিদ নানা প্রান্ত থেকে শোকবাতার্ জ্ঞাপন করেছেন। বেছারে হক্বের পরও শরীর তুলতুলে নরম ও গরম ছিলো। চেহারা ছিলো পূর্ণিমার চাঁদের মত সমুজ্জ্বল। হে আল্লাহ! আপনার এ মহান অলিয়ে কামেলে পদাঙ্ক অনুসরণ ও অনুকরণের তৌফিক দিও। আমিন।
‘এনায়েতপুরের চাঁদ’
কবি: কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী
মুহাম্মাদি জ্যোতি নিয়ে
নূর এসেছে এনায়েতপুরে
গান ধরেছে একই সুরে
বিশ্ব জাকের মাতাল হালে।
রৌদ্র দুপুর বিকেল বেলা
দ্বীনের অসি সন্ধ্যা বেলা
তাবাস্সুমে গাউছুল ওয়ারা।
বিশ এসেছে যমুনা তীরে
ফুল ফুটেছে রূহ জগতে
আলো ছড়ায় বিশ্বজুড়ে।
ছয়ের ঘরে তিন ভেসেছে
ছুটছে ইমাম শম্ভূগঞ্জে
জ্বলছে প্রদীপ লালকুঠিতে।
ছিয়াত্তরের আশ্বিন মাসে
বিশ্বজাহান শোকবিধুরে
বুক ফেটেছে অশ্রম্নজলে
থাকিয়ে আছো নূরি হালে
বদন দিলাম স্বর্গপানে
বেঁচে আছো গহীন মনে।