মুয়াবিয়ার প্রতি মাওলানা ভাসানীর দৃষ্টিভঙ্গি।
কারবালার করুণ ও হৃদয়বিদারক ঘটনার ২১ বছর আগে রমজান মাসের এক ফজরের ওয়াক্তে গুপ্ত ঘাতকের ছুরিকাঘাতে হযরত আলী (রাঃ) আহত হন। আহত হয়েই তিনি বলে উঠেছিলেনঃ “ফুযতু ওয়া রাব্বিল কা’বাতে।”-“কাবার প্রভূর কসম! আমি সফলকাম হয়েছি।” প্রশ্ন জাগে, এ কোন্ সাফল্য? এর জবাব কারবালাতেই নিহিত। হক আর বাতিল একাকার হয়ে যেতে পারে না। সে জন্য যে লড়াই বাঁধে তা জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মোকাবিলা করে যেতে হয় এবং এ লড়াইয়েরও শেষ নেই।
জীবন-সংগ্রামের প্রতি এ জীবনবোধই প্রথম কারবালার জন্ম দিয়েছে এবং বারবার এর পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হার কারবালা কে বা’দ’- ইতিহাসের এ অমোঘ ধারা অত্যন্ত সুকৌশলে অন্তত সাধারণ্যে গোপন রাখা হয়েছে। যে কোন যুগে এ ইতিহাস মহিমান্বিতরূপে ফুটে উঠলে শাসক-শোষক-রাজন্য কারও নিস্তার নেই-এ সত্যটুকু উপলব্ধি করতে পেরেই কারবালার ইতিহাস নিয়ে শাসকবর্গের মধ্যে এত ষড়যন্ত্র। উমাইয়া শাসকগণ ইতিহাস ধামাচাপা দিতে চেষ্টা করেছেন।
আব্বাসীয় শাসকেরা এ ইতিহাসের পারিবারিক আবেগের ফায়দাটুকু লুটে এর উপরই আঘাত হেনেছেন। এরপর আধুনিক ইসলামী জগত ও পাশ্চাত্য পণ্ডিতবর্গ উমাইয়া-আব্বাসীয় শান-শওকতের সাফল্য তুলে ধরে কারবালার ধারাকে ম্লান করে দেখিয়েছেন। সব একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। কারবালায় কেন এমন ঘটলো? এমন কি পটভূমি সাজানো হয়েছিল যে এর ব্যতিক্রম ঘটতে পারলো না? তখনো তো সাহাবীদের কেউ কেউ জীবিত ছিলেন। মাত্র ৫০ বছর কেটেছে নবী করিমের (সাঃ) তিরোধান ঘটেছে।
হেজাজের হাওয়ায় নবী অনুসন্ধানীর জন্য তখনো সুঘ্রাণ রয়েই গেছে। এই সময়টুকুর মধ্যেই এমন নির্মমকাণ্ড ঘটতে পারলো? কারবালার সূত্রপাত হযরত ওসমানের (রাঃ) খেলাফতের শেষার্ধ থেকেই। নবী করিম (সাঃ) কর্তৃক নির্বাসিত মারওয়ান বিন হাকাম মদীনায় এসে জেঁকে বসলো। মুনাফেক নওমুসলিম আবদুল্লাহ ইবনে সাবা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করলো। ওদিকে বসরা ও কুফায় মুগিরা ইবনে শোবা এবং সিরিয়ায় মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ান পারসিক ও রোমান আদলে শাসন কায়েম করলো।
হযরত ওমরের (রাঃ) ভূমি রাজস্ব নীতি তাদের মনঃপূত ছিল না। হযরত আবুজর গিফারীর (রাঃ) আন্দোলন তাদের অসহ্য হয়ে দাঁড়ালো ও ‘ঈসা ইবনে মরিয়মের মত এই সত্যবাদীকে’ নির্বাসনে যেতে হল। এ সবের মধ্যেই কারবালার বীজ জন্ম নিল। সমাজে সামান্ত প্রভাব দেখা দিল। জীবনাচারে মূল্যবোধেরও অবক্ষয় দেখা দিল। এর পরিণতিতেই শালীনতার মূর্ত প্রতীক হযরত ওসমানকে (রাঃ) নিজ গৃহেই শাহাদাতের স্বাদ গ্রহণ করতে হল।
এবার এমন এক ইন্ধন জুড়ে দেয়া হল যা নস্যাৎ করার জন্য আগমন ঘটেছিল ইসলামের। উমাইয়া ও হাশেমীয় গোত্রীয় কোন্দল উস্কে দেয়া হল। মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান, মারওয়ান বিন হাকাম, আমর ইবনুল আস, মুগীরা ইবনে শোবা এই চার প্রভাবশালী ব্যাক্তি হযরত আলীর (রাঃ) খেলাফতকে হাশেমী শাসন হিসাবে চিহ্নিত করলেন। জাহেলিয়াত আমলের মত গোত্রচর্চা সর্বত্র শুরু হল।
সাধারণভাবে মুসলমানদের বুঝানো হল যে, এই সংঘাত ইসলাম নিয়ে নয়, নিতান্তই ব্যক্তিগত বা বংশভিত্তিক। অথচ হযরত আলী (রাঃ) এই সংঘাতে খেলাফতের ন্যায়-নীতিকেই বিপদাপন্ন দেখতে পেয়েছিলেন। ন্যায়-নীতি শুধু বিপদাপন্নই থাকল না, পদদলিতও হল। সিফফীনের যুদ্ধের আট মাস পর পবিত্র রমজান মাসে ‘দুমাতুল জন্দল’ নামক স্থানে ইসলামের ইতিহাসে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পরিচ্ছেদও সংযোজিত হল।
শঠতার বেড়াজালে সিরিয়ায় আমীর মুয়াবিয়ার ক্ষমতা টিকে গেল। সাহাবীগণ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। গভীর দুঃখবোধ কেউ কেউ ব্যাক্তিগত উদ্যোগে সমাজের অবক্ষয় রোধকল্পে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়লেন, কেউবা দেশই ছেড়ে দিলেন। পারস্যবিজয়ী বিশিষ্ট সাহাবী হযরত সাদ বিন আবি ওক্কাস (রাঃ) জঙ্গলে গিয়ে বকরী চরিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন। এই অবস্থায়ই হযরত আলী (রাঃ) শহীদ হন।
তাঁর শাহাদাতের পর আমীর মুয়াবিয়া প্রায় ২০ বৎসর জীবিত ছিলেন এবং দোর্দণ্ড প্রতাপে শাসন চালান। এদিকে এই দুই দশকের মধ্যেই ইসলামের নীতি, আদর্শ ও ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে এমন সর্বনাশ সাধিত হয়েছে আজও যার জের চলছে। কারবালার পটভূমি বিশেষভাবে এই দুই দশকেই রচিত হয়েছে। হযরত আলীর (রাঃ) বিরুদ্ধে তাঁর জীবদ্দশাতেই উমাইয়ারা নানা কুৎসা ছড়াতে শুরু করেছিল। তাঁর শাহাদাতের পর এর মাত্রা ও পরিধি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। বহুদিন পর আবার গোত্রীয় কাব্যচর্চা শুরু হয়।
জুমার খুতবায় সুপরিকল্পিতভাবে হযরত আলী (রাঃ) তাঁর বংশের চরিত্র হননমূলক অপপ্রচার সংযোজন করে দেয়া হয়। এভাবেই নতুন প্রজন্মের দৃষ্টি থেকে বিদ্যা নগরীর তোরণ আলী, খায়বার বিজয়ী আলী আড়াল হয়ে গেলেন। নবীর কাঁধের সওয়ারী হাসান-হোসাইন উমাইয়া বংশীয়দের সাজানো প্রচারে সমাজের আর দশজনের কাতারে শামিল হয়ে গেলেন এবং সে জন্যই কারবালার ময়দানে উপরোল্লিখিত সাহাবা সাদ বিন আবি ওক্কাসের (রাঃ) পুত্র আমরকেও ইমামের বিরুদ্ধে সৈন্য পরিচালনা করতে দেখা যায়।
পাশাপাশি দেখানো হল, প্রচার করা হল, খলিফা যিনিই হোন, মুসলমান হলেই হল। আচার-অনুষ্ঠান পালনে কোন কমতি নেই। বাহ্যিক খোদাভীতিতে কোন ঘাটতি নেই। তাহলে তাকে খলিফা মেনে নিতে এত অনীহা কেন? ইতিহাসে দেখি-আমীর মুয়াবিয়া ছিলেন অন্যতম সফল শাসক। কিন্তু পাশাপাশি এও দেখি, তিনিই কৌশলে ঘোরতর চাপ সৃষ্টি করে ইমাম হাসানকে (রাঃ) তাঁর সাথে সন্ধিমূলক চুক্তি করতে বাধ্য করছেন এবং পরে তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যার সব আয়োজনও তিনিই সম্পন্ন করছেন।
হযরত আলীর (রাঃ) বিশ্বস্ত সেনাপতি মালিক আশতারকে গুপ্তঘাতক দ্বারা এবং মহাবীর খালেদের পুত্র সিরিয়ার অত্যন্ত জনপ্রিয় সেনাপতি আবদূর রহমানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করার নির্দেশ তিনিই দান করছেন। তিনিই মৃত্যুর আগে ইয়াজিদকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করছেন এবং সর্বত্র তা মেনে নিতে বাধ্য করাচ্ছেন। তার জোরজবরদস্তি সত্ত্বেও ইয়াজিদকে খলিফা হিসাবে মেনে নিতে রাজী হন নাই সে যুগের বিশিষ্ট চার ব্যক্তিত্ব- ইমাম হোসাইন ইবনে আলী (রাঃ), হযরত আবদূর রহমান ইবনে আবু বকর (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রাঃ)।
মেনে না নেয়া থেকেই কারবালার উদ্ভব। একে তো মূল চুক্তিই ভঙ্গ করা হয়েছে, তদুপরি প্রকারান্তরে খেলাফতকেই উৎখাত করা হয়েছে। খেলাফতের বৈশিষ্ট্য বিকৃত অর্থে জনসাধারণের সম্মুখে পেশ করা হয়েছে। আল্লাহ্র পালনবাদের স্থলে মানুষের শাসনবাদ কায়েম করা হয়েছে। রাজতন্ত্রের জুলুম, সামন্তবাদের শোষণ সবই জীবন কাঠামোয় স্বাভাবিক রূপ নিতে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় কি করা যেতে পারে? ইমাম হোসাইন (রাঃ) সমাজের অবক্ষয় বুঝলেন। আমীর মুয়াবিয়ার শাসনের এমন দাপট যে, ইয়াজিদের মনোনয়নে মক্কা-মদীনায় সুসংহঠিত কোন বিদ্রোহ দেখা দিল না, ইয়াজিদের মুকাবিলায় ইমাম কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন, তাতেও তেমন কোনো ইতিবাচক সাড়া নাই।
এই বাস্তবতার প্রেক্ষিত ইমাম অনুধাবন করতে পারলেন। কিন্তু ইসলামের প্রাণ তথা খেলাফতের প্রশ্নের সমাধান তাঁকে করতেই হবে এবং তাই কুফার পথে কারবালায় তাঁকে পৌঁছতে হল, জীবনও দিতে হল। কারবালার পরপরই সমগ্র হেজাজে বিদ্রোহ দেখা দিল। সিরিয়ার ভাড়াটে বাহিনী মদীনাবাসীর বিদ্রোহ নির্মমভাবে দমন করল। হালাকু খানের সেনাবাহিনী বাগদাদে, নাদির শাহের সেনাবাহিনী দিল্লীতে যেরূপ আচরণ করেছিল, সিরীয় বাহিনী মদীনায় তাই করল। বিজিত মদীনায় তিন দিনব্যাপী যথেচ্ছ হত্যা আর লুণ্ঠণ চলল। মসজিদুন নববীতে জামাত বন্ধ হয়ে গেল। একমাত্র সাহাবী বয়োবৃদ্ধ হযরত সাইদ ইবনে মুসাইবকে (রাঃ) মসজিদে ঢুকতে দেয়া হল। এর পর বছর মক্কাতেও আক্রমণ চালানো হলো।
পবিত্র কাবাও রেহাই পেল না। হাজরে আসওয়াদ ত্রিখণ্ডিত হল। বিদ্রোহ দমনের নামে কাবাতে অগ্নিসংযোগ পর্যন্ত করা হল। মক্কা-মদীনার জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। এ সবই ইয়াজিদের আমলে ঘটে গেল। সাড়ে তিন বছরের শাসন শেষে তার মৃত্যু হলো। কিন্তু কারবালার শেষ হলো না। তারপর থেকে মুসলিম জাহানে কারবালার ধারা অব্যাহতই রয়ে গেছে এবং কোনদিনই শেষ হল না। কারণ কারবালার মধ্য দিয়ে খেলাফতের উপর কেবল রাজনৈতিক ও সামাজিক আঘাতই আসেনি, সামাজিক-ধর্মীয় আঘাতও এসেছিল এবং তা দিনে দিনে এমনভাবে শিকড় গেড়ে বসেছিল যে, মানুষ ইসলামের মর্মবাণী থেকে বিচ্যুত হয়ে জাগতিক ও পারলৌকিক দুই জীবন আবিষ্কার করে ব্যক্তিগত কিংবা বড়জোর পারিবারিক চিন্তা-ভাবনায় অভ্যস্ত হয়ে গেল।
সূত্র: [কারবালার পর কারবালা (আংশিক); সৈয়দ ইরফানুল বারী]