আদম সেজদার রহস্য
আদম সেজদার রহস্য কি? ইবলিসের অনুসারী কে? -এই নিয়ে আলোচনা:
আল্লাহ বলেন, আদমের নিমিত্তে সেজদা কর (আরাফ ১১ আয়াত) (বাকারা, ৩৪ আয়াত), (হিজর, ২৯ আয়াত), (বনি ইসরাইল, ৬১ আয়াত), (কাহফ, ৫০ আয়াত), (ত্বাহা, ১১৬ আয়াত), (সাদ, ৭২ আয়াত)। অনেকেই মনে করে এই সকল আয়াতে আদম সত্তাকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে ফেরেস্তারা ব্যক্তি আদমকে সেজদা দিয়েছে। এই বুঝটা ঠিক নয়। কারণ সেজদা একমাত্র আল্লাহর হক (৪১ঃ ৩৭)। আল্লাহ ছাড়া সেজদা হারাম। অর্থাৎ সকল সেজদা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে (জিন ১৮ আয়াত)। সেক্ষেত্রে ব্যক্তি আদম সেজদা পাওয়ার অধিকারী এমন বিশ্বাস করলে আদমের নিমিত্তে সেজদার আয়াতগুলোর সাথে জিন ১৮ আয়াত পরস্পর বিরোধী বলে গণ্য হয়, কিন্তু না এই কোরআনের কোনো আয়াত অন্য কোনো আয়াতের সাথে পরস্পর বিরোধী নয়, অর্থাৎ এই কোরআনের এক আয়াত আরেক আয়াতের পরিপন্থি নয় বরং এক আয়াত আরেক আয়াতের পরিপূরক এতে কোনো সন্দেহ নেই।
অনেকেই মনে করে যে, আদম হয়ত ফেরেস্তাদের থেকে উত্তম ছিল, তাই ফেরেস্তারা ব্যক্তি আদমকে সেজদা দিয়ে শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে আদমকে। কিন্তু কথাটা ঠিক নয়, কারণ যদি আয়াতে বলা হত, ওয়াসজুদুলি ইনসানা তাহলে ফেরেশতা ও জিন থেকে ইনসান শ্রেষ্ঠ আর তাই ইনসানকে সেজদা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু না, কিন্তু এখানে এমন আয়াত নেই বিধায় শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে আদমকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ঐ সেজদার হুকুম ছিল না এটা নিশ্চিত। আদম ফেরেস্তার দলভুক্ত হওয়ার আশায় ইবলিসের ধোঁকায় পড়ে নিষিদ্ধ বৃক্ষ থেকে ভক্ষণ করেছিল (আরাফ ২০ আয়াত)। এতে বুঝা যায় যে, আদম নিজেকে ফেরেস্তা থেকে উত্তম মনে করে না। তা ছাড়া ইবলিস নিজেকে আদম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দাবী করেছে (আরাফ ১২ আয়াত)। এই মর্মে আল্লাহ বলেন, সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব তারাই, যারা ইমান আনে এবং সৎকর্ম করে (ব্যানিয়া, ৭ আয়াত)। পক্ষান্তরে নিকৃষ্ট জীব তারাই, যারা কাফির, অতঃপর ইমান আনে না (আনফাল, ৫৫ আয়াত)।
কাজেই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বা নিকৃষ্ট এটা জন্মগত বা সৃষ্টিগত ব্যাপার নয়, এটা কর্মফলের ব্যাপার। কাজেই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ বা নিকৃষ্ট বুঝাবার লক্ষে আদমের নিমিত্তে সেজদার হুকুম হয় নি এটা নিশ্চিত। বরং আদম সেজদার অন্য কারণ আছে, সেটা হচ্ছে এই যে, আদমের মধ্যে দুইটি স্বত্তার অস্তিত্ব স্থাপন করা হয়েছে। (১) ব্যক্তি আদম সত্তা, যেটাকে নফ্স নামে অভিহিত করা হয়েছে। আদমের মধ্যে যখন নফ্স সত্তা স্থাপন করা হয়েছিল তখন সেজদার হুকুম হয় নি, কারণ প্রত্যেক নফসের মৃত্যু আছে (আনকাবুত, ৫৭ আয়াত)। ২য়টি হচ্ছে সৃষ্টার নিজস্ব সত্তা যেটাকে রুহু নামে অভিহিত করা হয়। আসলে রুহু প্রভু স্বত্তা (বনি ইসলাইল, ৮৫ আয়াত)।
আদমের মধ্যে যখন আল্লাহর নিজ রুহু তথা প্রভু সত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল তখনই সেখানে সেজদার হুকুম হয়েছিল (হিজর, ২৯ আয়াত) এবং (সাদ, ৭২ আয়াত)। তাহলে দেখা গেল, ফেরেস্তারা আদমকে কেবলা করে ব্যক্তি আদম সত্তাকে বিলীন করে বরং আল্লাকেই সেজদা দিয়েছে বিধায় আদমের নিমিত্তে সে সকল সেজদার হুকুম ছিল সেটা ছিল আল্লাহর উদ্দেশ্যই সেজদা, তাই এই সকল সেজদাও দ্বীনি সেজদা। কারণ সেজদার ব্যবহার বা প্রয়োগ কখনো দুনিয়াবি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বরং সেজদার ব্যবহার বা প্রয়োগ সবসময়ই হবে দ্বীনের ক্ষেত্রে। যেহেতু দ্বীনের সকল বিষয় একমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য (যুমার, ৩ আয়াত)।
সেহেতু আদমের নিমিত্তে যে সেজদা ছিল, সেটাও নিশ্চয়ই আল্লাহর উদ্দেশ্যে। তবে এখানে আর একটি বিষয় পরিষ্কার ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন যে তিনটি কারণে আল্লাহ আদমের নিমিত্তে সেজদা দিতে বলেছিল তা নিম্নরূপঃ আল্লাহর নিজ রুহু আদমের মধ্যে ফুৎকার করা হয়েছিল। (হিজর, ২৯ আয়াত) এবং (সাদ, ৭২ আয়াত)। আল্লাহর সুন্দর আকৃতি ও প্রকৃতি অনুসারে আদমকে সৃষ্টি করা হয়েছে (ত্বীন, ৪ আয়াত), (রুম, ৩০ আয়াত)। আদম আল্লাহর খলিফা। (বাকারা, ৩০ আয়াত)। এই আয়াতে খলিফা শব্দ এসেছে, খলিফা শব্দের অর্থ স্থলাভিষিক্ত করা। আরবি অভিধান, পৃ. ১২৬৬)।
উপরিউক্ত ৩টি কারণে ফেরেস্তারা আদমকে কেবলা করে আল্লাহকে সেজদা দিয়েছে বিধায় উপরিউক্ত আয়াতগুলোকে আদমের নিমিত্তে যে সেজদার হুকুম ছিল, তা মূলত আল্লাহকেই সেজদা। ফলে ঐসকল আদম সেজদার আয়াতগুলি জিন এর ১৮ আয়াতের পরিপন্থী হয়নি বা পরস্পর বিরোধী হয়নি। এখানে উল্লেখ্য যে, জন্ম সূত্রে সকল আদম সন্তানই খলিফা নয়। বরং পৃথিবীতে যারা ইমান আনবে এবং সৎ কর্ম করবে তাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা তাকে আল্লাহ খলিফা নির্ধারণ করেন (নূর, ৫৫ আয়াত)।
এইজন্য আল্লাহ বলেন, যাকে ইচ্ছা তাকে তিনি রিসালাতের ভার অর্পণ করেন (আনআম, ১২৪ আয়াত)। রিসালাতের ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণই হচ্ছে রসূল। আর রসূলগনের কাবায় বনি আদমগণ সেজদা দিয়েই মমিন হবেন। এই বিষয়টা প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যেই পবিত্র কোরআনে আদমের নিমিত্তে সেজদার জন্য উপরিউক্ত আয়াতগুলিতে বার বার নির্দেশ এসেছে। অনেকেই মনে করেন, এই সকল আয়াতগুলি শুধু ফেরেস্তারাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল, বনি আদম এর জন্য প্রযোজ্য নয়। তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি— এই আয়াতের ব্যবহার বা প্রয়োগ শুধু ফেরেস্তাদের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিলনা, কারণ ইবলিস জিন জাতীয় (কাহফ, ৫০ আয়াত)। ইবলিস জিন হওয়া সত্বেও যখন আদমকে সেজদা না দিয়েই কাফের, এতে প্রমাণ হয় ঐ সকল আয়াতগুলি জিনদের জন্য প্রযোজ্য ছিল।
বেহেশতের মধ্যে আদমের সাথে তাঁর স্ত্রীও উপস্থিত ছিল। (সূরা বাকারা : ৩৫) আর ইবলিস ব্যতীত উপস্থিত সকলে সেজদা করল। (সূরা বাকারা : ৩৪) তাতে প্রমাণ হয় যে, বেহেশতের মধ্যে মা হাওয়া আ. আদম আ. কে সেজদা দিয়েছে। আর তাই বনি আদমের মধ্যেও এই সেজদার প্রয়োগ ও ব্যবহার এসেছে ইউসুফের ১০০ আয়াতে, ইউসুফকে সেজদা দিয়েছিল, তার ১১ ভাই এবং পিতা মাতা। তারপর যদি কেউ বলে এই আয়াতগুলো রহিত করা হয়েছে। কিন্তু না, কারণ কোরআনের কোনো আয়াত রহিত হয় নি। (বাকারা, ১০৬ আয়াত)।
তারপরও যদি কেউ বলে এই আয়াতের ব্যবহার ও প্রয়োগ আদম থেকে ইউসুফ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু না, আল্লাহর বিধান সকল বনি আদমের জন্য একই। এই উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন, হে মোহাম্মদ, তোমার পূর্বে যে সকল রসূল এসেছে, তাদের ক্ষেত্রে যেরূপ নিয়ম ছিল, তোমার ক্ষেত্রেও তাই। আমার নিয়মের কোনো পরিবর্তন নেই। (বনি ইসরাইল, ৭৭ আয়াত)।
মা হাওয়া আদম (আঃ)কে সেজদা দিয়েছে। বেহেস্তের ভিতরে আল্লাহ ফেরেশতাদের বললেন, আদমকে সেজদা কর। সকলেই সেজদা করিল একমাত্র ইবলিশ ব্যতিত। সে অহংকার করিল এবং কাফের হয়ে গেল। এবং আল্লাহ বলিলেন হে আদম, তুমি ও তোমার স্ত্রী একসাথে জান্নাতে বসবাস কর (সূরা- বাকারা-৩৪) (সূরা- বাকারা-৩৫) এবং ইবলিশকে বলিলেন, তুমি এখান থেকে বাহির হয়ে যাও, তুমি বিতাড়িত। (সূরা- হিযর-৩৪), (সূরা-সাদ-৭৭)। এই ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, বেহেস্তের ভিতরে মা হাওয়া আদম আঃ-কে সেজদা দিয়েছে। কারণ আয়াতে এসেছে, মা হাওয়া বেহেস্তের ভিতর উপস্থিত ছিল (সূরা- বাকারা-৩৫)। আর বেহেস্তের ভিতরে যারা ছিল তারা সকলেই সেজদা করিল একমাত্র ইবলিশ ব্যতিত। (সূরা-বারাকা-৩৪)।
কাজেই এক ইনসান আরেক ইনসানকে আল্লাহর খলিফা হিসাবে কেবলা করে সেজদা দিতে পারবে না এই কথার কোন ভিত্তি নাই। অনেকেই বলে সেজদার হুকুম ছিল, ফেরেস্তা ও জ্বীন সম্প্রদায় ইনসান সম্প্রদায়কে সেজদা করবে, তাদের এ কথা ঠিক নহে, কারণ ওয়াস যুদুলী ইনসানা, তোমরা মানুষকে সেজদা কর এমন আয়াত আসে নাই। যদি এমন আয়াত আসত, তাহলে মা হাওয়া যেহেতু ইনসান, সেহেতু তিনি সেজদাকারীর আওতাভুক্ত হইতেন না, বরং তিনি সেজদাযোগ্য হইতেন। যেহেতু আয়াতে এসেছে, ওয়াস যুদুলী আদামা, তোমরা আদমকে সেজদা কর, সেহেতু মা হাওয়া ইনসান হওয়া সত্ত্বেও যদি আদমকে সেজদা না দিতেন তা হলে ইবলিশের মত কাফির হয়ে বহিস্কৃত হইত এটা নিশ্চিত। অনেকেই বলে, আদম আঃ-কে সেজদার হুকুম শুধু ফেরেস্তাদের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল, এটা অন্য কোন সম্প্রদায়ের জন্য ছিলনা।
তাদের এই কথা ঠিক নহে, কারণ ইবলিশ ছিলেন জ্বীন জাতি (সূরা-ক্বাফ -৫০)। ইবলিশ জ্বীন জাতিয় হওয়া সত্ত্বেও যখন আদমকে সেজদা না দিয়ে কাফের (সূরা-বারাকা-৩৪)। তাতে প্রমাণ হয় যে, সেজদার হুকুম শুধু ফেরেস্তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলনা, বরং সকল সৃষ্টির জন্য ছিল। বিধায় মা হাওয়া ঐ সেজদার আওতাভুক্ত ছিল, এতে কোন সন্দেহ নাই। কারণ সেজদার হুকুম ছিল আল্লাহর খলিফাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, আর আদমকে আল্লাহ খলিফা হিসাবে নির্ধারণ করেছিলেন। (সূরা- বাকারা-৩০)। যেহেতু মা হাওয়া খেলাফত প্রাপ্ত নহে, তাই তিনি ইনসান হওয়া সত্ত্বেও ঐ সেজদা না করে অপরাধি হইতেন, এটা নিশ্চিত। কারণ জমিনের বুকে আল্লাহ খলিফা পাঠিয়েছেন সকল সৃষ্টির উপর তিনি প্রতিনিধিত্ব করবেন এই উদ্দেশ্যে। শুধু ফেরেস্তা ও জ্বীনদের উপর আদম আঃ প্রতিনিধিত্ব করবেন এমন নহে, বরং ফেরেস্তা, জ্বীন ও ইনসানদের উপরও আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে আদম আঃ দায়িত্ব পালন করবেন।
জন্মসূত্রে কিন্তু সকল বনি আদম খলিফা নহে, পৃথিবীতে যারা ঈমান আনবে এবং সৎ কর্ম করবে, তাদের মধ্য থেকে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন। (সূরা-নূর-৫৫)। যাকে আল্লাহ খেলাফত দিবেন, তিনি প্রতিনিধিত্ব করবেন, বাকী বণি আদমের উপর। তাই বেহেস্তের ভিতরে আদম আঃ শুধু ফেরেস্তা ও জ্বীন সম্পদায়ের জন্যই খেলাফত ছিলেন না, বরং মা হাওয়ার উপর ও তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আর তাই মা হাওয়া আল্লাহর খলিফা হিসাবে আদম আঃ কে মেনে নিয়েই সেজদা দিয়েছেন এটা নিশ্চিত। আর তাই দুনিয়াতে সকল স্ত্রীগণ তাদের স্বামীর আনুগত্য করে আসছে।
তারপরও প্রিয় পাঠক আপনাদের জেনে রাখা ভাল যে, যদিও সকল সৃষ্টির জন্য আদমকে সেজদার হুকুম ছিল, তবে কেন আয়াতে ফেরেস্তাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, এক সময় আল্লাহ ফেরেস্তাদের অবগতির জন্য ঘোষণা করেছিলেন যে, জমিনের বুকে আমি প্রতিনিধি নির্ধারণ করিব। (সূরা- বাকারা-৩০)। তখন শুধু ফেরেস্তারা দ্বি-মত পোষণ করেছিল, (সূরা- বাকারা-৩০)। অন্য কোন সম্প্রদায় দ্বিমত পোষণ করে নাই বিধায় সেজদার সময় ফেরেস্তাদের কথা উল্লেখ করে বলেছে, যেন কোন ভাবেই কোন অযুহাতে ফেরেস্তারা এই সেজদা থেকে বিরত না থাকে। যদিও বেহেস্তের ভিতরে আদম সেজদার ঘটনা ঘটিয়েছে, কিন্তু এর কার্যকারিতা বেহেস্তের ভিতরেই সীমাবদ্ধ নহে বরং দুনিয়াতে বনি আদমদের মধ্যে প্রচলিত আছে, যেমন ইউসুফ আঃকে সেজদা করল তার এগার ভাই। (সূরা- ইউসুফ-১০০)। সকল নবীগণের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন, প্রত্যেক সেজদার সময় তোমাদের নিজের চেহারা প্রতিষ্ঠিত কর। (সূরা- আরাফ-২৯)। কাজেই আদম কাবায় আল্লাহকে সেজদা করাই ইবলিশ মুক্তির একমাত্র পথ।
আসলে আদমের নিমিত্তে সেজদার আয়াতগুলি দিয়ে খলিফা আদমকে সেজদার মাধ্যমে পরবর্তীতে রিসালাতের ভারপ্রাপ্ত রসূলগণকে কেবলা করে আল্লাহকে সেজদা করার বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল আদম সেজদার মূল রহস্য বা উদ্দেশ্য। যারা বর্তমানে যে কোনো কারণে আদম কাবায় সেজদা থেকে দূরে থাকে, তারা ঐসকল আয়াতগুলো অর্থাৎ আদমের নিমিত্তে সেজদার আয়াতগুলির উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করার সামিল বলে গণ্য হবে। কিন্তু আল্লাহর কোনো আয়াতের উদ্দেশ্য কেউ ব্যর্থ করতে পারবে না (হুদ, ২০ আয়াত)। কাজেই আল্লাহ পাকের কোনো আয়াতের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে, এমন বুঝ অন্তরে পোষণ না করাই ভাল। তারপরও যারা আল্লাহর আয়াতের উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করে তাদের জন্য কঠিন শাস্তি জাহান্নাম (হজ, ৫১ আয়াত)। যারা রসূলগণের মাধ্যমে আদম কাবায় সেজদা করে নি তারাই ইবলিসের অনুসারী, কাফের। কারণ ইবলিস আদম কাবায় সেজদা না দিয়েই কাফের (বাকারা, ৩৪ আয়াত)। ইবলিস এবং ইবলিসের অনুসারীগণ মোমেন নয়।
এরা বলে আমরা আল্লাহ ও আখিরাত বিশ্বাস করি (বাকারার ৮ আয়াত), এবং আরো বলে আমরা আল্লাহ বিশ্বাস করি ও রসূল ও বিশ্বিাস করি (নুর, ৪৭ আয়াত)। এরা আরো বলে আমরা আল্লাহর আনুগত্যও রসূলের আনুগত্য স্বীকার করি (নুর, ৪৭ আয়াত)। কিতাবিদের দল বিশেষের মধ্যে ইবলিসের অনুসারী আছে (ইমরান, ১০০ আয়াত)। অর্থাৎ ইবলিস ও তার অনুসারীগণও কিতাব বিশ্বাস করে। ইবলিস জান্নাত ও জাহান্নামও বিশ্বাস করে। কারণ তাকেতো জান্নাত থেকেই বহিষ্কার করা হয়েছিল (বাকারা, ৩৬ আয়াত) এবং (ত্বাহা, ১২৩ আয়াত)। ইবলিস ফেরেস্তাও বিশ্বাস করে, কারণ তাকে তো ফেরেস্তাদের সাথেই আদম সেজদার হুকুম দেওয়া হয়েছিল, (হিজর, ৩০ আয়াত)। ইবলিস পুনরুত্থান দিবসও বিশ্বাস করে (সাদ, ৭৯ আয়াত)। ইবলিস ও ইবলিসের অনুসারীদের জন্য কঠিন শাস্তি জাহান্নামের দুর্ভোগ নিদৃষ্ট, যদিও তারা লোক দেখানো সালাত আদায় করে (মাউন, ৬ আয়াত)। যেহেতু ইবলিস জিন জাতীয় (কাফ, ৫০ আয়াত) সেহেতু ইবলিসও আল্লাহর ইবাদত করে (জারিয়া, ৫৬ আয়াত)। ইবলিস আল্লাহকে প্রভু বলে (হিজর, ৩৬ আয়াত)।
ইবলিস আল্লাহকে সেজদা করে (রাদ, ১৫ আয়াত)। ইবলিস আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে (ইমরান, ৮৩ আয়াত)। ইবলিস আল্লাহরই পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করে (হাদীদ, ১আয়াত) এবং (হাশর, ২৪ আয়াত)। উপরিউক্ত বিশ্বাস অনুসারে উপরিউক্ত কর্মগুলো করার পরও ইবলিস একমাত্র আদমকে সেজদা না দেওয়ার কারণেই কাফের (বাকারা, ৩৪ আয়াত) এবং (সাদ, ৭২ আয়াত)। ঠিক একই ভাবে যারা উপরিউক্ত বিশ্বাস অনুসারে উপরিউক্ত কর্মগুলো করার পরও একমাত্র সম্যক গুরুর সঙ্গ ধারণ করে আদম কাবায় সেজদা দেয়না তারাই ইবলিসের অনুসারী হবে। যেহেতু পূর্ব আলোচনায় আমরা বুঝলাম খেলাফত যেখানে, সেজদা সেখানে। খেলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সেজদা। খেলাফত প্রাপ্ত খলিফাগণই সম্যক গুরু। আর সম্যক গুরুগণই বর্তমান রসূল। মোমেনগণ বলেন, আমরা এই বর্তমান রসূলেরই অনুসরণ করি (ইমরান, ৫৩ আয়াত)। এই রসূলগণ তোমাদের পবিত্র করবেন, কারণ প্রত্যেক বনি আদমের সাথে ইবলিস যুক্ত আছে (ত্বাহা, ১২৩ এবং যুখরুফ ৩৬ আয়াত)।
এই ইবলিস মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কেউ পরিত্রাণ পাবে না (শুআরা, ৮৯ আয়াত)। আর যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ সম্যক গুরুর কাবায় সেজদা না দেবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে ইবলিস মুক্ত হতে পারবে না। যখনই কেউ সম্যক গুরুর কাবায় সেজদা দিবে, তখনই সে ইবলিস মুক্ত হবে। কারণ ইবলিস কখনো আদম কাবায় সেজদার শামিল হবে না (হিজর, ৩০ আয়াত)। আর সম্যক গুরুর কাবায় সেজদার মাধ্যমেই ইবলিসকে দেহ মন থেকে দূরীভূত করার একমাত্র উপায় আর এটাই হচ্ছে সালাত। এইজন্য আল্লাহ বলেন, সালাত হচ্ছে সেই কাজটি যা করলে ইবলিস দূরীভূত হয় (আনকাবুত, ৪৫ আয়াত)। এই আয়াতে নাহাইয়া শব্দ এসেছে, নাহাইয়া শব্দের অর্থ হচ্ছে দূরীভূত করা। অভিধান (পৃ. ২৩৮৩)। এই আদম কাবায় সেজদা না দিয়ে যারা প্রচলিত প্রক্রিয়ায় লোক দেখানো সালাত নিয়মিত ভাবে আদায় করে, সালাতের সময় তাদের মন স্থির থাকে না। কারণ ঐসময় তাদের দেহ মনের সাথে ইবলিস শামিল থাকে ফলে আনকাবুত, ৪৫ আয়াতের প্রয়োগ তাদের ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়। আল্লার কোনো আয়তকে কেউ ব্যর্থ করতে পারবে না (হুদ, ২০ আয়াত)।
পক্ষান্তরে যারা আদম কাবায় সেজদা করে তাদের সাথে ইবলিস যুক্ত থাকেনা বিধায় সালাতে তাদের মন একনিষ্ঠ হয়। তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন, এদের উপর ইবলিসের কোনো ক্ষমতা থাকবে না (হিজর, ৪০ আয়াত)। এই আদম কাবায় সেজদা দেওয়াই হচ্ছে সেরাতুল মুস্তাকিম, যা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে (হিজর, ৪১ আয়াত)। আর ইবলিস এই সিরাতুল মোস্তাকিমেই উৎ পাতিয়া বসিয়া আছে, এখান থেকে সকলকে পথ ভ্রষ্ট করার জন্য (আরাফ, ১৬ আয়াত)। যে কায়দায় ইবলিস বিভ্রান্তিতে পতিত হয়েছিল ঠিক একই ভাবে মানুষকেও বিভ্রান্তি করবে (আরাফ, ১৬ আয়াত)। আর ইবলিস এই সেজদা থেকেই মানুষকে বিরত রাখার চেষ্টা করে (নামল, ২৫ আয়াত)। সম্যক গুরুতে যারা বিশ্বাসী তারাই মোমেন, আর মোমেনদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন, তোমরা সেজদা কর (ঐ সেজদা, যে সেজদা ইবলিস করে নি) (হজ, ৭৭ আয়াত)। কাজেই সম্যক গুরুর সঙ্গ ধারণ করে আদম কাবায় সেজদা দেওয়াই হচ্ছে ঈমানের পথ আর এর বিপরীত অর্থাৎ আদম কাবায় সেজদা না দেওয়া হচ্ছে ইবলিসের পথ। ইবলিসের পথে যারা থাকবে তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই মর্মে আল্লাহ বলেন একমাত্র ইমান এবং সৎ কর্ম ব্যতীত সকল মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত (আসর, ১ আয়াত)। এইজন্য আল্লাহ বলেন, তোমরা ইবলিসের অনুসরণ করোনা, ইবলিস তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু (বাকারা, ২০৮ আয়াত)।
বরং তোমরা অনুসরণ কর তাদের যারা সঠিক পথে আছে (ইয়াসিন, ২১ আয়াত)। সঠিক পথ বলতে ইবলিসের বিপরীত পথ। এটা হচ্ছে সম্যক গুরুর সঙ্গ ধারণ করে আদম কাবায় সেজদার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করা। এই জন্য আল্লাহ বলেন, তোমরা আত্মসমর্পণ না করে মরিও না। (ইমরান, ১০২ আয়াত)। যারা সম্যক গুরু তথা এই রসূলের সঙ্গ ধারণ না করে মৃত্যুবরণ করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং সেই দিন তারা নিজের হস্ত দংশন করে আফসোশ করে বলবে, হায়, আমরা যদি এই রসূলের সঙ্গ ধারণ করে ঐ সৎ পথটা গ্রহণ করিতাম (ফুরকান, ২৭ আয়াত)। কাজেই যারা সম্যক গুরুর সঙ্গ ধারণ করে আদম কাবায় সেজদা না দিয়ে প্রচলিত প্রক্রিয়ায় সকল ইবাদত বন্দেগী করল তার পরও তারা ইবলিসের অনুসারী। কাজেই একজন সম্যক গুরুর সঙ্গ ধারণ করে আদম কাবায় সেজদা দেওয়াই হচ্ছে মুক্তির পথ। এটাই হচ্ছে পবিত্র কুরআনের বুঝ, এটা যারা অপছন্দ করেন তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন, আমি যা নাযিল করেছি তা যারা অপছন্দ করেন তাদের কর্মফল বিনষ্ট হবে (মোহাম্মদ, ৯ আয়াত)।
আদম সেজদার রহস্য এবং উদ্দেশ্য অনুধাবন করে আদম কাবায় সেজদা করে ইবলিসের অনুসরণ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখাই মানবমুক্তির পথ।
[সূত্রঃ পবিত্র কোরআন থেকে বিষয় ভিত্তিক আলোচনা— ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৪৪–৫০ —হাসিবুল হক চিশতি।]
এম.এ (আরবী), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়,
এল.এল.বি (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়),
বি.এস.সি (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়),
বি.এস.সি (সার্টিফিকেট কোর্স ভূগোল)
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা