হযরত শাহ্জালাল (রহঃ) এর ১টি কারামত।
শাহ জালালের সুযোগ্য মাতুল অলী আহমদ কবীর (রহঃ) কামালিয়তের উচ্চস্তরে আসীন ছিলেন, সুতরাং কামেল অলীর যত রকমের যেগ্যতা তাঁর মধ্যে সবই পুরামাত্রায় ছিল।
জীবনে তিনি বহু অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর কারামত প্রদর্শন করেছিলেন। তাঁর নিকট বাতেনি ফায়েজ হাসিল করে ভাগিনা জালাল ও অতি অল্পদিনে বোযর্গী এবং কারামত লাভে সক্ষম হয়েছিলেন। যে ধরনের কারামত বা অলৌকিক শক্তি তিনি এত অল্প সমড়য়ের ভিতর অর্জন করেছিলেন, সচরাচর তা কুত্রাপি দেখা যায় না। তার জীবনের সর্ব প্রথম কারামতই একটি অদ্ভুত ও অবিশ্বাস্য ঘটনা। এ ঘটনার মধ্য দিয়েই অনুমান করা চলে যে একান্ত বাল্য বয়সেই তিনি কি পরিমাণ অলৌকিক ক্ষতার অধিকারী হয়েছিলেন। একদা হযরত আহমদ কবীর (রহঃ) তাঁর হুজরাখানায় যিকির আযকার হতে কেবলমাত্র ফাররগ হয়েছেন।
নিকটে তাঁর প্রিয় শিষ্য ভাগিনা জালালও উপবিষ্ট ছিলেন। এমনি সময় অত্যন্ত ব্যস্তত্রস্তভাবে দৌড়িয়ে একটি হরিণী এসে তার হুজরার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম করে বলল, হে আল্লাহর অলী! আমি চরম বিপদে পড়ে আপনার শরনাপন্ন হয়েছি। মেহেরবানী করে আমাকে বিপদমুক্ত করুন। আমার ছোট তিনটি শাবক ছিল। তাদেরকে একটি স্থানে রেখে আমি খাবার অন্বেষণে বের হয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে দেখি, একটি ব্যাঘ্র এসে আমার একটি শাবক খেয়ে ফেলে প্রত্যাবর্তন করতেছে। আমি চুপে চুপে জীবিত শাবক দু’টির নিকট পৌছে তাদের নিয়ে অন্যত্র রেখে আপনার কাছে ছুটে এসেছি। হুজুন, আপনি নিশ্চয় বুঝবেন, আমার শাবকটি হারিয়ে আমি কি শোক যাতনা অনুভব করছি। তারপর এখন আরওবিপদের কথা হচ্ছে যে, আমার বাচ্চা খেয়ে বাঘটির যে লোভ জেগেছে তাতে সে নিশ্চয়ই কিছু পরে আমার বাকী বাচ্চা দু’টিকে ও খেতে আসবে।
যদি এভাবে তারাও বাঘের পেটে যায় তা হলে আমি আর কি নিয়ে বেঁচে থাকব? আমার জীবন তখন একেবারেই মিথ্যা হয়ে যাবে। আমার মনে হচ্ছে বাঘটি আর এখন দুরে যাবেনা। পুনরায় অতি শীঘ্রই সে রক্তমাংস খাওয়ার লোভে ফিরে আসবে। অতএব অনুগ্রহপূর্বক আপনি সে বাঘটিকে শাসন করে দিলে আমি আপনার কাছে চীর কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব।
বলা বাহুল্য, আল্লাহর আউলিয়াগণ পরম ঐশী শক্তি বলে পশু-পক্ষী প্রভৃতি সকল জীবেরই ভাষা বুঝতে পারেন। হযরত আহমদ কবীর (রহঃ) পশুটির মিনতি শুনে ও শোকাভিভূত ব্যাকুল চিত্তের ভীতি-ত্রস্ততা সম্যক প্রত্যক্ষ এবং উপলব্ধি করে বিগলিত হয়ে গেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিকট উপবিষ্ট ভাগিনা শাহ জালালকে বললেন, বাবা জালাল! শীঘ্র এর সঙ্গেযাও তো। গিয়ে বাঘটিকে শায়েস্তা করে আস। মাতুলের নির্দেশে শাহ জালাল কোন কিছু ভাবনা চিন্তা না করে তন্মুহুর্তে হরিণীকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন। বলতে কি বিপদাপন্ন হরিণীর মুখে ঘটনা শুনে তাঁরও কোমল চিত্ত বিগলিত হয়ে গিয়েছিল এবং তাকে আশু বিপদ হতে উদ্ধারের চেষ্টা করা নিজের জন্য তিনি কর্তব্য মনে করেছিলেন।
এদিকে কিন্তু হরিণীর বিপদ মোচনকল্পে ভাগিনাকে পাঠিয়ে দিয়ে হযরত আহমদ কবীর পূর্বাপর নানা চিন্তায় লিপ্ত হলেন। তাঁর হৃদয়ে উদয় হল জালালকে ব্যাঘ্র শায়েস্তা করতে পাঠালাম বটে কিন্তু কিভাবে এবং কোন ধরনের শাসন তাকে করে আসবে তাতো তাকে কিছুই বলে দিলাম না। তার ভিতরে যোগ্যতা আছে নিশ্চয় কিন্তু এখনও সে কচি বয়সের বালক মাত্র, ক্রোধবশে ব্যাঘ্রটিকে সে মেরে ফেলে তাতো সীমাতিরিক্ত হবে। কেননা ব্যাঘ্র তো বনের পশু, হরিণ ওবনের পশুর জন্য আল্লাহ বন্য পশুই আহার্যস্বরূপ নির্দিষ্ট করেছেন।
সেদিক দিয়ে বিচার করলে বাঘটিকে তত দোষী ও করা যায় না। তারপর আরও এক কথা যে, যদি ও তাকে দোষী করিলাম, তবু এটাতো সত্য যে হরিণছানা সে খেয়ে ফেলেছে তার ক্ষতিপূরণ তো বাঘটির মৃত্যুর দ্বারাও হবে না। সেক্ষত্রে একটি প্রাণী তো শেষ হয়েছে তার সাথে সাথে আর একটি প্রাণীকে হত্যা করে কি লাভ হবে? হরিণ ছানাতো আর কিছুতেই পাওয়া যাবে না। তবে বাঘটি যাতে ভবিষ্যতে আর এ ধরনের নিষ্ঠুর কার্যে লিপ্ত না হয় তজ্জন্য তাকে যথোপযুক্ত শাসন করে ও ধমক দেয়াই যথেষ্ট। কিন্তু জালাল তরুণ যুবক,এতটা সে বুঝে কার্য করবে কি-না কে বলতে পারে? তবে দেখা যাক দেখি, তার বুদ্ধি এ ব্যাপারে কতটুকু খাটিয়ে আসে। ইত্যাকার চিন্তায় হযরত আহমদ কবীর (রহঃ) কিছুটা উৎকন্ঠার সাথে ভাগিনার প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় রইলেন।
ওদিকে হযরত শাহ জালাল (রহঃ) হরিণটির সাথে বনের মধ্যে যেখানে তার বাচ্চা দু’টি ছিল সেখানে যেয়ে দেখতে পেলেন সে ব্যাঘ্রটি শিকার ধরার ভঙ্গীতে সে বাচ্চা দু’টির পানে অগ্রসর হচ্ছে।কিন্তু ব্যাঘ্রটি হঠাৎ সেখানে মানুষ দেখে সহসা থেমে গেল। সে আর সন্মুখে অগ্রসর না হয়ে যেখানে সে ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে বাচ্চা দু’টি ও মানুষটির প্রতি তাকিয়ে রইল। তাঁর দু’টি চক্ষু হতে তখন যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছিল। হযরত শাহ জালাল বাঘটির এভাবে গতিরুদ্ধ হতে দেখে হাতের ইশারায় তাকে নিজের নিকট ডাকলেন ডাকা মাত্র তা দৃষ্টি অবনত কর ধীরে ধীরে তাঁর দিকে অগ্রসর হতে লাগল এবংনিকটে পৌছে দাঁড়িয়ে গেল।
বলা বাহুল্য, ব্যাঘ্রের দন্ড সম্পর্কিত যে সকল চিন্তা হযরত আহমদ কবীরের (রহঃ)-মনে উদয় হয়েছিল একই রকমের চিন্তা-ভাবনা হযরত শাহ জালালের হৃদয়ে ও জাগরিত হয়েছিল। তিনি ভাবলেন, বাঘটিকে হত্যা করে কি লাভ হবে? হরিণী তো আর তার হারানো শাবক ফিরে পাবেনা; সুতরাং যা হবার হয়ে গিয়েছে ; কিন্তু পরে আর কখনও যেন সে এরূপ কার্য করতে সাহস ন্ পায় সে ব্যবস্থাই করা দরকার। তিনি এ কথাটি হরিণীকে ও বুঝিয়ে বললেন। তারপর নিকটে দাঁড়ানো বাঘটিকে লক্ষ্য করে বললেন, রে হতভাগ্য!
তুই এরূপ একটি বাচ্চা হরিণকে খেয়ে জননীর মনে আঘাত দিয়েছিস কেন? এবার আমি তোর প্রাণ রক্ষা করলাম, কিন্তু সাবধান,ভবিষ্যতে যেন কস্মিনকালে আর এরূপ ঘটনা শুনতে না পাই। তা হলে নিশ্চয় তোর মৃত্যু দন্ড ঘটবে। এ বলে তিনি বাঘটির মিকে সজোরে মুষ্ঠঘাত খেয়ে বাঘটি প্রায় ঘুরে পড়ে যেতে যেতে কোনরূপে ছুটে পালাল। দুঃখী হরিণীটিহযরত শাহ জালালের এ বিচার স্বচক্ষে দেকে ভবিষ্যতের জন্য নিশ্চত হল, এবং তার ব্যথিত হৃদয়েরর মধ্যে এত আনন্দের সঞ্চার হল যার ফলে সদ্য সন্তান হারানো শোকও অনেকটা প্রশমিত হল।
সে হযরত শাহ জালাল এর পদ প্রান্তে লুটিয়ে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করল। অতঃপর শাহ জালাল ফিরে এসে স্বীয় মাতুলের কাছে ব্যাঘ্র শাসন ঘটনা বিবৃত করলেন। শুনে তিনি ভাগিনার একাধারে বিবেকবুদ্ধি ও অলৌকিক ক্ষমতার নিদর্শন দেখে আস্বস্ত হলেন এবং সাথে সাথে দু’হাত তুলে প্রার্থনা করলেন, হে অসীম করুণাময়! তুমি প্রিয় শাহ জালালের প্রতি যে অফুরন্ত নেয়ামত দান করেছ, সেজন্য তোমাকে জানাই অশেষ ধন্যবাদ। তুমি শাহ জালালের এ দক্ষতা ও যোগ্যতাকে চির অক্ষুন্ন রেখ ও দিন দিন তাকে তুমি আরও উন্নতির পথে অগ্রসর করো।
যোগ্য অলীয়ে কামেলের সেদিনের সে আন্তরিক দোয়া নিশ্চয়ই আল্লাহর দরব্রে কবুল হয়েছিল। ইতিপূর্বেকার খাজা খিজিরের আশীর্বাদ ও আজকার মামা আহমদ কবীর (রহঃ)-এর দোয়া হযরত শাহ জালালের- জীবনের চরমোন্নতির লক্ষ্যে সার্থকভাবে কার্যকরী হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নাই। আর তারই ফলে দেখা যায় তাঁর কর্মজীবনে তিনি যেসব অদ্ভুত কার্য সমাধা করেছেন তা জগতের ইতিহাসে খুব কম লোক দ্বারাই সাধিত হয়েছে।
– (ইলমে মারেফত – ﻋﻠﻢ ﻣﻌﺮﻓﺔ) ফেইসবুক গ্রুপ থেকে সংগৃহীত