মনসুর আল-হাল্লাজ এর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও জীবনী
মনসুর আল-হাল্লাজ এর (৮৫৭/৫৮-৯২২খ্রী.) জন্ম পারস্যের আল বাইজা নগরীর উত্তর-পূর্বে অবস্থিত তুর অঞ্চলে। বাইজা ছিল আরব শাসিত নগরী। হাল্লাজের পিতা সেখানে রেশম শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি হাল্লাজকে নিয়ে যান আরবদের প্রতিষ্ঠিত টেক্সটাইল নগরী ওয়াসিত-এ। ওয়াসিতের বেশির ভাগ মানুষ ছিল সুন্নী ও হানবলি সম্প্রদায়ভুক্ত, শিয়ারা ছিল সেখানে সংখ্যালঘু। ওয়াসিতের একটি স্কুলে কোরান পড়ে হাল্লাজ মাত্র বার বছর বয়সে হাফেজ হন। কোরানকে তিনি আত্মীকৃত করেন মরমী উপলব্ধি দিয়ে। আর এ থেকেই তার মরমী অনুসন্ধানের শুরু। তােস্তারের শাহল বিন আব্দুল্লাহ যিনি সালামীয়া সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠিতা, হাল্লাজ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
শাহল বিন আব্দুল্লাহর সঙ্গ ছেড়ে হাল্লাজ পাড়ি দেন বসরায়। সেখানে সূফী খিরকা গ্রহণ করেন উমর বিন উসমান মক্কীর হাতে। তখন তার বিশ বছর বয়স। বসরায় উমর মক্কীর কাছ থেকে তিনি সূফীদের অভ্যাস অর্জন করতে থাকেন। বিয়ে করেন বসরার সূফী সাধক ইয়াকুব আল-আক্তা কারবাইয়ের কন্যা উম্মুল হুসাইনকে। কারনাবাইয়াদের একজন বানু আল-আম ছিলেন তামিম গােত্রের বানু মুজাসির প্রতিনিধি এবং জানয বিদ্রোহীদের সমর্থক। তারাই আব্বাসীয় খলিফাদের বিরুদ্ধে বসরার দাসদের উস্কে দেন। আলিদ (জাঈদী) ছিলেন এই বিদ্রোহের নেতা। বিপ্লবী শিয়াদের সঙ্গে হাল্লাজের সংযােগ ঘটে বিবাহসূত্রে কারবাইয়াদের সঙ্গে সংশ্রবের মাধ্যমে। আর ইয়াকুব আল-আতার কন্যার সঙ্গে এই বিবাহের কারণেই হাল্লাজের সঙ্গে বিরােধ সৃষ্টি হয় উমর মক্কীর সঙ্গে। বসরায় বসবাসের এই সময়টাতেই তার মধ্যে আপাত কিছু শিয়া আচরণ দেখা যেতে থাকে। তবে তিনি ঐকান্তিকভাবেই একজন তপস্বীর জীবন যাপন করেন এবং সুন্নী মতাদর্শের প্রতি গভীরভাবে অনুগত থাকেন।
হাল্লাজ বাগদাদে যান বিখ্যাত সূফী জুনায়েদের কাছে। জুনায়েদ তার কথাবার্তা শুনে তাকে নিঃসঙ্গ ও নিঃশ্চুপ থাকার পরামর্শ দেন। এরপর জানয বিদ্রোহের পতনের পর জুনায়েদের সঙ্গ ছেড়ে তিনি মক্কায় যান হজব্রত পালন করতে। সেখানে এক বছর নির্জনবাস ও কঠোর কৃচ্ছ্বতা পালন করেন। তার পরমাত্মায় লীন হবার সাধনা শুরু হয় এখান থেকে।
মক্কা থেকে ফিরে আসার পরই তার মধ্যে লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন চোখে পড়ে সবার। কথিত আছে, বাগদাদে ফিরে তিনি যখন জুনায়েদের ঘরের দরজায় কড়া নাড়েন, ভেতর থেকে জুনায়েদ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কে?’ তার উত্তরে হাল্লাজ বলেছিলেন, ‘আনা আল-হক্ক,’ যার অর্থ ‘আমি সৃষ্টিশীল সত্য। একদল সুফীসহ হাল্লাজ জুনায়েদের কাছে গিয়ে ধর্মতত্ত্বের অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন জুনায়েদ যার কোনাে জবাব দেন নাই। বলেছিলেন, খুব শীঘ্রই সেই সময় আসছে, যখন তােমার রক্তে যুপকাঠ রঞ্জিত হবে।’ উত্তরে হাল্লাজ পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘যখন আমার রক্তে যুপকাঠ রঞ্জিত হবে তখন আপনার গায়ে কি আকারবাদীদের পােশাক পরা থাকবে?
জুনায়েদের সঙ্গে বিতর্কের কারণে এবং সাধারণের মধ্যে ধর্মপ্রচারের সুবিধার্থে হাল্লাজ খিরকা পরিত্যাগ করেন। ভ্রমণ করেন পারস্য ও খােরাসানে। এসময় কিছু সুন্নী আগে যারা খ্রীস্ট মতাবলম্বী ছিলেন, হাল্লাজের শিষ্য হন। এদেরই কেউ কেউ পরে খলিফার উজির হয়েছিলেন। খােরাসানে তিনি বিরােধিতার মুখােমুখি হন মুতাযিলা ও শিয়াদের, যাদের কেউ কেউ তার বিরুদ্ধে মিথ্যা জাদুটোনার অভিযােগ আনেন। হাল্লাজ খােরাসান ছেড়ে চলে যান পূর্ব-পারস্যের আরব উপনিবেশগুলােতে। সেখানে বছর পাঁচেক তিনি তার ধর্মীয় আদর্শ প্রচার করতে থাকেন। এরপর ফিরে আসেন তােস্তারে এবং রাষ্ট্রসচিব হামিদ কুন্নাইয়ের সহায়তায় সপরিবারে পুনর্বাসিত হন বাগদাদে।
হাল্লাজ দ্বিতীয়বার হজ্জ্ব পালন করতে মক্কায় যান চারশত শিষ্যসহ। সেখানে তিনি কিছু প্রাক্তন সূফী বন্ধুর তােপের মুখে পড়েন। মক্কা থেকে ফিরে দীর্ঘ ভ্রমণে বের হন তুর্কেস্তান ও ভারতের উদ্দেশে। এই সমস্ত অঞ্চলে হাল্লাজ বৌদ্ধ, মানী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লােকদের সংস্পর্শে আসেন।
৯০২ খ্রী, সনের দিকে হাল্লাজ তৃতীয় ও শেষবার হজ্জব্রত পালনে মক্কায় যান। শেষবার আরাফাতের ময়দানে বসে তার প্রার্থনা ছিল, আল্লাহ যেন তাকে অনস্তিত্বে পর্যবসিত করেন, যেন তিনি ঘৃণিত ও পরিত্যক্ত হন, যেন আল্লাহ তার দাসের হৃদয় ও ঠোট দিয়ে কেবল নিজেরই প্রতি করুণা করতে পারেন।
বাগদাদে নিজের পরিবারে ফিরে এসে ঘরে কাবা শরীফের একটি প্রতিকৃতি স্থাপন করেন হাল্লাজ। রাতে প্রার্থনা করেন কবরখানার পাশে বসে আর দিনের বেলা ধর্ম প্রচার করতে থাকেন পথে পথে। পরমেশ্বরকে নিজের দুঃখ-দুর্দশার ভেতর দিয়ে অর্জনের ইচ্ছা ব্যক্ত করতে থাকেন। বলেন, তিনি তার জনগণের জন্য অভিশপ্ত হয়ে মরতে চান- আল্লাহ আমার রক্তকে তােমাদের অনুগত করেছে: তােমরা আমাকে হত্যা করাে।” হাল্লাজের ধর্মীয় শিক্ষা ও বাণী সাধারণের আবেগকে জাগিয়ে তুলতে থাকে এবং তা শিক্ষিত শ্রেণীর লােকদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। জাহিরী আইনজীবী মুহাম্মদ বিন দাউদ ক্রুদ্ধ হয়ে হাল্লাজের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযােগ দায়ের করেন এবং মৃত্যুদণ্ড দাবি করেন। কিন্তু শাফি-ই আইনজীবী ইবনে সুরায়েজী হাল্লাজের পক্ষ নিয়ে বলেন, মরমী জ্ঞানের বিষয় আদালতের এক্তিয়ার বহির্ভূত, এ নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই। আল-হাল্লাজের ধর্মীয় শিক্ষার প্রভাবে বাগদাদে ক্রমশ সংঘটিত হতে থাকে নৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের আন্দোলন। ইবনে হামদান ও ইবনে ঈশাকে উজিরদের কৰ্ত বিষয়ক তার প্রস্তবনাগুলাে তিনি হাজির করেন।
৯০৮ খ্রী. সনে হানবলি প্রভাবে কিছু সুন্নী সংস্কারক ক্ষমতা দখলের ও ইবনে আল-মুতাজকে খলিফা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তারা ব্যর্থ হন এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক খলিফা আল-মুক্তাদির ক্ষমতায় টিকে যান। তখন তার উজির ছিলেন শিয়া ধনিক ইবনে আল-ফুরাত। এসময় হাল্লাজ হানবলি বিরােধী তােপের মুখে পড়েন এবং আহওয়াজে পালিয়ে যান। তখন গ্রেপ্তার হন তার কয়েকজন শিষ্য। তিন বছর পর, ৯১৩ খ্রী. সনে হাল্লাজ নিজেও আটক হন। তখন তাকে বাগদাদে আনা হয়। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন উজির আলী ইবনে ঈশা শাফি-ই আইনজীবী ইবনে সুরায়েজীর প্রভাবে তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে রেহাই দেন, তবে তার আটকাদেশ বহাল থাকে। ৮ বছর ৮ মাস তিনি রাজ প্রাসাদে বন্দী জীবন যাপন করেন।
খলিফা আল-মুক্তাদিরের আদালতে হাল্লাজের প্রভাব থাকায় দুজন শিয়া নেতা ওয়াকিল ইবনে রাউহ নাওবাতি এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী সালমাগনি হাল্লাজের বিচার পুনরায় শুরু করতে উজির হামিদ বিন আল-আব্বাসের কাছে তদ্বির করেন। এতে মধ্যস্থতা করেন শিয়া ধণিক সমর্থনকারীরা। ফলে হাল্লাজের বিরুদ্ধে আনা অভিযােগ সংক্রান্ত বিচার পুনরায় শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল, তিনি কারামতীয় এজেন্ট এবং কারামতীয়দের সহযােগিতায় তিনি মক্কায় কাবা ধ্বংসের প্ররােচনা দিয়েছেন। হাল্লাজ তার শিষ্য শাকিরকে বলেছিলেন, তুমি তােমার কাবা ধ্বংস করাে। যার গূঢ়ার্থ হলাে, আমি যেমন আমার জীবন উৎসর্গ করেছি তুমিও ইসলামের জন্য তােমার জীবন উৎসর্গ করাে। মালিকী বিচারক কাজী আবু উমর হাল্লাজের রূপকাৰ্থ-দ্যোতক উক্তিকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেন। কোনাে শাফি-ই আইনজীবী এই বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে ছিলেন না। হানাফী কাজী বিচার থেকে পিছিয়ে যান কি তার সহকারী আবু উমরকে সমর্থন দেন। পেশাজীবী স্বাক্ষীদের সিন্ডিকেট হাল্লাজের বিরুদ্ধে ৮৪টি স্বাক্ষর সংগ্রহ করে। হামিদের উস্কানিতে আল উমর রায় ঘােষণা করেন হালাজের রক্তপাত আইনসিদ্ধ।
দুদিন রাত-অমাত্য নাছর এবং রাণীমাতা মধ্যস্থতার চেষ্টা করেন খলিফার সঙ্গে। তিনি অসুস্থ থাকায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিষয়টি স্থগিত থাকে। কিন্তু উজিরের ষড়যন্ত্র খলিফার দ্বিধাদ্বন্দ্বের উপরে বিজয়ী হয়। তিনি হাল্লাজের ওয়ারেন্টে স্বাক্ষর করেন। হাল্লাজকে পুলিশ প্রধানের কাছে সােপর্দ করা হয়। ২৬ মার্চ, ৯২২ খ্রী. তারিখে এক ভিড় মানুষের সামনে মাথায় মুকুট পরিয়ে, প্রহার করতে করতে অর্ধমৃত অবস্থায় হাল্লাজকে ফাঁসীমঞ্চের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়, দোকান-পাটে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় কোথাও কোথাও। হাল্লাজের বন্ধু ও শত্রুদের কেউ কেউ তাকে ফাঁসীমঞ্চে নেয়ার সময় নানা প্রশ্ন করতে থাকেন। কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর করেন হাল্লাজ। খলিফার কাছ থেকে তার শিরচ্ছেদের আদেশ আসতে রাত হয়ে যায়। মৃত্যুদণ্ড চূড়ান্তভাবে কার্যকর করা হয়। পরদিন ২৭ মার্চ তারিখে। শিরচ্ছেদের পর মৃতদেহে তেল ছিটিয়ে দিয়ে আগুনে পােড়ানাে হয় এবং দেহভস্ম ছড়িয়ে দেয়া হয় টাইগ্রিস নদীতে।
মৃত্যুর অব্যবহিত আগে, দুঃখভােগের সময়টাতে হাল্লাজের শেষ উক্তি ছিল, অনন্য সত্তা তাকে তার অনন্যতায় একীভূত করেছেন কিনা একজন তপস্বীর কাছে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
সূত্রঃ কিতাব আল-তাওয়াসিন
ভাষান্তর ও সম্পাদকঃ রায়হান রাইন