১০ই মুহাররম পবিত্র আশুরা মোবারক
১০ই মুহাররম তারিখ-আশুরা দিবস। এই দিন উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য অত্যন্ত বিষাদময় দিন। ৬১ হিজরীর ১০ই মুহাররমে কারবালার মরু প্রান্তরে সত্যের আদর্শ সমুন্নত রাখার জন্যে, রাসূল (সাঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও প্রচারিত সাত্ত্বিক আদর্শের পতাকাকে উড্ডীন রাখার জন্য দয়াল নবী (সাঃ) এর দৌহিত্র, হযরত আলী (কঃ) এর নন্দন হযরত ইমাম হোসেন (রাঃ) ছাহেব আত্মীয়-পরিজন ও অনুচরসহ অকাতরে শাহাদাত বরণ করেন। সত্যের আদর্শ রক্ষায় সর্বস্ব ত্যাগের এমন ঘটনা নজিরবিহীন। এই পবিত্র দিন ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জল।
পাষন্ড এজিদের নির্দেশে তাহার বেতনভুক্ত সৈনিকেরা শুধুমাত্র আনুগত্যের জন্য নবী-বংশের পুরুষদের মধ্যে সকলকেই একে একে হত্যা করিয়াছিল। একমাত্র অসুস্থ জয়নাল আবেদীন প্রাণে রক্ষা পাইয়াছিলেন।
সর্বশেষে কারবালার প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন হযরত ইমাম হোসেন (রাঃ) ছাহেব। শত্রুপক্ষের পাপিষ্ঠ সীমার ইমাম ছাহেবের শিরোচ্ছেদ করে। এখানেই শেষ নয়। এজিদ সৈন্যরা নিহত ইমাম ছাহেবের পবিত্র দেহ মোবারকের উপর দিয়া অশ্ব চালনা করিয়া দেহের হাড্ডি-মজ্জা-মাংশপেশীকে মরুভুমির বালুর সাথে মিশাইয়া দেয়।
এমন পৈশাচিক হত্যাকান্ড আর কোথাও ঘটিয়াছে বলিয়া জানা যায় না। তাই ১০-ই মুহাররম আমাদের জন্য শোকাচ্ছন্ন দুঃখবিজড়িত ঘটনাবহুল এক দিবস। এই দিবসে ইমাম ছাহেবের মহব্বতের ফয়েয ওয়ারেদ হয়। বিশ্ব ব্যাপী মোসলমানেরা এই আশুরা দিবসে যেমন মাতম ও হাহাকার করে, তেমন হাহাকার ক্রন্দন আর অন্য কোন দিবসে করে না।
মুহাররমের ১০ তারিখ ইমাম ছাহেবের মহব্বত অর্জনের দিন। ইমাম ছাহেবের মহব্বত হকিকতে দয়াল নবী (সাঃ) এর মহব্বত। কাজেই ইমাম ছাহেবের মহব্বতে যে কাঁদিবে, হকিকতে দয়াল নবী (সাঃ) এর মহব্বতে সে কাঁদিবে। আর রাসূলে পাক (সাঃ) এর মহব্বতে যাহারা ক্রন্দন করিবে, তাহাদের দেল পরিচ্ছন্ন হইবে, তাহাদের জন্য দোযখের আগুন হারাম হইবে।
হযরত আবু জ্বার হইতে বর্ণিত আছে যে, দয়াল নবী (সাঃ) বলিয়াছেন, আমার আহলে বায়েতের উপমা নুহের তরীর ন্যায়; যে তাহাতে আরোহন করিয়াছিল সে রক্ষা পাইয়াছিল এবং যে পশ্চাতে ছিল সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছিল। (আহম্মদ)। মুসলিম শরীফে প্রকাশ-দয়াল নবী (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘‘আমার আহলে বায়েত হইল-আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসেন।”
উল্লিখিত হাদীসের বর্ণনা থেকে বুঝা যায় যে, আহলে বায়েতের প্রতীক হইল নুহের তরী। আর এই তরীতে আরোহণের উপায়ই হইল আহলে বায়েতের মহব্বত অর্জন; যে মহব্বত বিতরনের জন্য আকাশের ফেরেশতাসকল বিশেষভাবে প্রতি বছর মুহাররমের দশ তারিখে জমিনে নামিয়া আসেন এবং আশেকে রাসূলদের দেলে মহব্বত ঢালিয়া দেন।
তোমরা প্রতি বছর যেমন পবিত্র আশুরা মোবারক উদযাপন কর, ইমাম ছাহেবদের মহব্বতে অঝরে কান্দ, আমার অবর্তমানেও তোমরা এমনি ভাবে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে সমবেত হইয়া পবিত্র আশুরা মোবারক উদযাপন করিবে; ইমাম ছাহেবদ্বয়ের মহব্বত অর্জনপূর্বক সেই মহব্বতের স্রোতে দেলের ময়লা পরিস্কার করিবে।
কারবালার প্রান্তরে যুদ্ধকালীন সময়ে ইমাম ছাহেবের বিপক্ষে ফোরাত কুলে এজিদপক্ষীয় বিপুল সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন ছিল। ইহাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক সৈন্য ছিল-যাহারা যুদ্ধকালীন সময়ে ইমাম পক্ষের উপরে কোন তীর নিক্ষেপ করে নাই বা বর্শা চালনা করে নাই।
এজিদের বেতন ভুক্ত সৈনিক বিধায় তাহারা কেবলমাত্র এজিদ পক্ষে যোগ দিয়াছিল। শেষ বিচারের দিন, হাশরের মাঠে, তাহারা দয়াল নবী (সাঃ) কে প্রশ্ন করিবে, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ (সাঃ)! কারবালার যুদ্ধে আমরা এজিদের বেতনভোগী সৈনিক হিসাবে ফোরাতকুলে ছিলাম; কিন্তু ইমাম পক্ষের উপরে আমরাতো কোন রকম অস্ত্র চালনা করি নাই।
না তীর নিক্ষেপ করিয়াছি, না বর্শা নিক্ষেপ করিয়াছি, তাহা হইলে আজকের এই বিচার দিবসে আপনার শাফায়াত আমরা কেন পাইব না?”
রাসূলে পাক (সাঃ) বলিবেন, ‘যদিও তোমরা অস্ত্র চালনা কর নাই; তবুও তোমরা তো এজিদ পক্ষে থাকিয়া এজিদের সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়াছ। কারবালার প্রান্তরে তোমাদের বিপুল সংখ্যক সৈন্যের বেষ্টনী দেখিয়া আমার অতি আদরের দৌহিত্র ইমাম হোসেন যে ভয় পাইয়াছিল-তাহার প্রতিকার কি করিবে? সেই কারণে তোমরা শাফায়াত পাইবে না।”
কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া হাশরের মাঠে আরও অনেক আশ্চর্য ঘটনা ঘটিবে।
নবীর বেটি মা ফাতেমা সেদিন এক হাতে কহরের পেয়ালা, অন্য হাতে রক্তমাখা জামা এবং স্কন্ধে স্বামী হযরত আলী (কঃ) এর দেস্তার লইয়া পাগলিনীর মত ছুটাছুটি করিবেন। আল্লাহপাক হাশর বাসীদেরকে উদ্দেশ্য করিয়া বলিবেন, ‘হে হাশরবাসী পুরুষেরা! তোমরা চক্ষু বন্ধ কর।
নবী-নন্দিনী ফাতেমাতুজ্জোহরা হাশরের মাঠে আসিয়াছে।” সন্তান হারা, স্বামীহারা মা ফাতেমা সেদিন আরশের পায়া ধরিয়া কান্নায় ফাটিয়া পড়িবেন এবং খোদাতায়ালার উদ্দেশ্যে বলিবেন, ‘হে খোদাতায়ালা! আমি কাহার সন্তানদের হত্যা করিয়াছিলাম যে তোমার বান্দারা আমার সন্তানদ্বয়কে হত্যা করিল? আমি কাহার পাকা ধানে মই দিয়াছিলাম যে তাহারা আমার স্বামীকে হত্যা করিল? আমি স্বামী ও সন্তান হত্যার বিচার চাই।”
আল্লাহতায়ালা বলিবেন, ‘হে ফাতেমা! তোমার স্বামী ও সন্তান হত্যাকারীদের বিচার করা হইবে।” তৎক্ষণাৎ হযরত জিব্রাইল (আঃ) দয়াল নবী (সাঃ) এর সমীপে উপস্থিত হইয়া বলিবেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! সর্বনাশ হইয়াছে, আপনার বেটি, মা ফাতেমা স্বামী ও সন্তানহত্যার বিচার প্রার্থনা করিয়াছে। আল্লাহতায়ালা যদি এই বিচার করেন, তাহা হইলে আপনার উম্মতেরা কেহই আর রক্ষা পাইবে না।”
ইহা শুনিবা মাত্র প্রেমিক দয়াল নবী (সাঃ) তড়িৎ বেগে মা ফাতেমার সমীপে উপস্থিত হইয়া ক্ষোভের সহিত বলিবেন, ‘হে ফাতেমা! দেখতো আমাকে চেন কিনা?” মা ফাতেমা উত্তরে বলিবেন, “জ্বী, আপনাকে চিনি।
আপনি আমার আব্বাজান।” উম্মতের কান্ডারী দয়াল নবী (সাঃ) তৎক্ষণাৎ বলিবেন, ‘হে ফাতেমা! আমি আগে যদি জানিতাম যে তুমি আমার উম্মতকে আসামী করিয়া স্বামী ও সন্তান হত্যার বিচার দাবী করিবে, তাহা হইলে তোমাকে মেয়ে হিসাবেই স্বীকার করিতাম না।”
ইহা শুনিয়া মা ফাতেমা তাহার দাবী তুলিয়া নিয়া বলিবেন, ‘হে খোদাতায়ালা! এই বিষের পেয়ালা, রক্তমাখা জামা এবং স্বামীর দেস্তার আমি আমার আব্বাজানের গোনাহগার উম্মতের নাজাতের জন্য অছিলা করিলাম।
ইহার অছিলায় তুমি আমার আব্বাজানের গোনাহগার উম্মতদের মুক্তি দাও।” আল্লাহপাক বলিবেন, ‘হে ফাতেমা! তুমি আজকে যে দু’আই কর না কেন, তোমার দু’আ কবুল করা হইবে।”
কাজেই দয়াল নবী (সাঃ) এবং আহলে বায়েতের মহব্বত অর্জনের জন্য ১০ই মুহাররম বিশেষ উল্লেখযোগ্য দিন। এই দিবসের কর্মসূচী নিম্নরূপঃ-
আশুরা দিবসের ধর্মীয় কর্মকান্ড শুরু হইবে ৯-ই মুহাররমের দিবাগত সন্ধ্যা হইতে।
প্রথমে মাগরিব নামাজের আযানান্তে সকলেই খেয়াল কালবে ডুবাইয়া আল্লাহতায়ালাকে হাজের নাজের ওয়াহেদ জানিয়া হুজুরে কালবে মাগরিবের ফরয ও সুন্নত নামাজ আদায় করিয়া দুই রাকায়াত করিয়া মোট ছয় রাকাত নফল নামাজ আদায় করিবে। প্রতি দুই রাকায়াতান্তে ছওয়াব রেছানী করিবে। (নফল নামাজের মোনাজাত দ্রষ্টব্য)
এই দিনে বিশেষভাবে ছওয়াব রেছানী করিবে কারবালার প্রান্তে সত্যের আদর্শ রক্ষায় যাহারা শাহাদাত বরণ করিয়াছেন, তাহাদের আরওয়াহ পাক হুজুরে।
নফল নামাজান্তে যথানিয়মে ফাতেহা শরীফ পড়িয়া ছওয়াব রেছানী করিবে। (ফাতেহা শরীফ দ্রষ্টব্য)
ফাতেহা শরীফের ছওয়াব রেছানী করিয়া তরিকতের নিয়ম মত নিম্নলিখিত পাঁচ প্রকারের ফয়েজ খেয়াল করিবে।
১। হকিকতে তওবা কবুলিয়তের ফয়েজ।
২। দোসরা দায়েরা হইতে কুওতে এলাহিয়ার ফয়েজ।
৩। রাসূলে পাক (সাঃ) এর খাছ হোব্ব এশক মহব্বতের ফয়েয।
৪। আল্লাহপাকের খাছ হোব্ব এশক মহব্বতের ফয়েয।
৫। আনওয়ারে জেকেরে এলাহিয়ার ফয়েয। (ফয়েয খেয়াল করিবার নিয়ম দ্রষ্টব্য)
পাঁচ প্রকারের ফয়েযে দেল পরিচ্ছন্ন করিয়া সকলেই কিছুক্ষণ সমবেতভাবে জেকের করিবে। জেকের শেষ করিয়া এক খতম মিলাদ পড়িবে। মিলাদ শেষে এশার নামাজের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত ওয়াজ নসিহত চলিবে। এই দিনের ওয়াজে বিশেষভাবে প্রাধান্য থাকিবে কারবালার হৃদয়বিদারক শোকাচ্ছন্ন ঘটনা প্রবাহ। কারণ ইমাম ছাহেবের মহব্বত অর্জনই হইল এই দিবসের মূল লক্ষ্য। তদ্সংগে কারবালার তাৎপর্য ও শিক্ষা সম্পর্কীয় বিষয়াদিও সন্নিবেশিত থাকিবে।
ওয়াজ সমাপনান্তে এশারের আযান। আযানান্তে খেয়াল কালবে ডুবাইয়া আল্লাহতায়ালাকে হাজের, নাজের, ওয়াহেদ জানিয়া হুজুরে কালবে এশারের ফরয ও সুন্নত শেষ করিয়া দুই রাকায়াত নফল নামাজ আদায় করিয়া ছওয়াব রেছানী করিবে। (নফল নামাজের মোনাজাত দ্রষ্টব্য) অতঃপর বেতের নামাজ পড়িয়া রাসূলে পাক (সাঃ) এর গায়রতের ফয়েজ খেয়াল করিবে।
তৎপর ৫০০ মর্তবা দরুদ শরীফ পড়িয়া দয়াল নবী (সাঃ) কে নজরানা দিয়া সকলে বিশ্রাম করিবে। অতঃপর ১৮-ই ফাল্গুন বা ৫-ই জমাদিউস সানী দিবসে যে নিয়মে রহমত পালন করা হয় সেই নিয়মে রহমতের সময় উঠিয়া প্রথমে কুরআন তেলাওয়াত, তৎপর এক খতম মিলাদ শরীফ পাঠ করিবে। মিলাদ শেষে যথানিয়মে রহমতের ফয়েজ খেয়াল করিবে। অতঃপর কিছুক্ষণ জেকের করিবে।
তাহার পর ফজরের নামাজ শেষ করিয়া নিয়মমত ফাতেহা শরীফ ও খতম শরীফ পড়িবে। খতম শরীফ অন্তে কিছুক্ষণ কুরআন তেলাওয়াত চলিবে। কুরআন তেলাওয়াত শেষে আবার এক খতম মিলাদ পড়িবে। মিলাদ শেষে জোহরের পূর্ব পর্যন্ত ওয়াজ নছিহত চলিবে। অতঃপর জোহরের নামাজ, নামাজান্তে দয়াল নবী (সাঃ) এর খাছ হোব্ব এশক মহব্বতের ফয়েজ খেয়াল করিবে। (ফয়েয খেয়াল করিবার নিয়ম দ্রষ্টব্য)
ইহার পর আছর পর্যন্ত পুনরায় ওয়াজ নসিহত চলিবে। তারপর আছরের নামাজ পড়িবে, নামাজান্তে তওবা কবুলিয়তের ফয়েজ খেয়াল করিবে। অতঃপর এক খতম মিলাদ পড়িবে। এমনিভাবে দিনের কর্মসূচী শেষ করিবে।
(তথ্যসূত্রঃ বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের পরিচালনা-পদ্ধতি)