বিশ্বওলী হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবের পবিত্র নসিহত শরীফ হইতে বিশেষ অংশটুকু তুলে ধরা হলো:-
“অতি শৈশবেই মাতৃহারা হই। মায়ের আদর কি -আমি তাহা বুঝিতে পারি নাই। অতঃপর পিতার স্নেহে, পিতামহীর আদরে আমি বড় হইতে থাকি। সকলের ছোট ছিলাম বিধায় স্বভাবতঃই বাবা আমাকে একটু বেশি আদর করিতেন। আমরা দুই ভাই দামী পোশাক পরিয়া হাতির পিঠে চড়িয়া ঘুরিয়া বেড়াইতাম। বড় সুখময় জীবন ছিল আমাদের। কিন্তু সেই সুখের স্থায়িত্ব বেশী দিন ছিল না। আমার দশ বছর বয়ঃক্রমকালে বাবার সাথে আমি প্রথমে পীরের দরবারে যাই। সেই হইতে শুরু হয় খোদাপ্রাপ্তির কঠোর সাধনা। আজও যে সাধনার শেষ হয় নাই। পীরের সান্নিধ্যে যাওয়ার পর হইতেই আমার প্রতি পিতার স্নেহ হ্রাস পায়, আত্নীয়-স্বজন বীতশ্রদ্ধ হয়।
মোটকথা, খোদাপ্রাপ্তির সাধনার পূর্বেই মাকে হারাই। অতঃপর এই পথে পা বাড়াইবার কিছু দিনের মধ্যেই পিতার স্নেহ বন্ঞ্চিত হই, আত্নীয়-স্বজনের চক্ষুশুলে পরিণত হই, বন্ধু-বান্ধবকেও হারাই। জমি-জমা যাহা ছিল। বিক্রয় করিয়া প্রাপ্ত টাকা পীর কেবলাজানকেই নজরানা দেই। অতঃপর আমার বলিয়া আর কিছুই থাকে না। চরম দরিদ্রতায় নিপতিত হই। উড়িবার পাখা থাকে না, ধরিবার ডাল থাকে না।
সেই দুর্দিনে একমাত্র পীর কেবলাজানই অামার আশ্রয়স্থল ছিলেন। তিনি দয়া করিয়া আমাকে তদীয় কদমে জায়গা দিয়াছিলেন। কিন্তু তিনিও পেট ভরিয়া কখনও আমাকে খাইতে দেন নাই। অর্ধ চামচ ভাত, তদসংগে কিন্ঞ্চিত তরকারী-ইহাই ছিল আমার খানা। কখনও দিনে একবার, কখনওবা দিনে দুইবার। এত সামান্য আহার! অথচ আমাকেই কাজ করিতে হইত সকলের চেয়ে বেশী। আহার কম, কাজ বেশী। ফলে, দেহ ধীরে ধীরে শুকাইতে লাগিল। কিছুদিন পরে পীর কেবলজান আমাকে কতিপয় নির্দেশ দিলেন।
তিনি বলিলেনঃ আটদিন অন্তর অন্তর আহার করিবে। তোমাকে দেখিয়া লোক হাসিবে। কাহাকেও কিছু বলিতে পারিবে না। কাহারও নিকট হাত পাতিতে পারিবে না। চারা কলা গাছের বুক ফাড়িয়া যদি কলার ছড়া বাহির হয়, সে কলা পোক্তও হয় না। ছোপও বালা (নষ্ট) হইয়া যায়। কাজেই আনা-ফানার মোকাম তয় করিয়া অতঃপর হেদায়েতের জন্য কোমরে কাপড় বাঁধ (অর্থাৎ বেলায়েতে নবুয়ত ও কামালাতে নবুয়তের সাজে নিজকে সজ্জিত করিয়া, উক্ত দুই মাকামের মারেফাতে সমৃদ্ধ হইয়া খোদাতায়ালার দিকে মানব সমাজকে পথ দেখাও)।
উক্ত নির্দেশ প্রাপ্তির পর হইতে শুরু হয় খোদা প্রাপ্তির বর্ণনাতীত কঠোর তপস্যা। পীরের সান্নিধ্যে এই নজীরবিহীন কঠোর সাধনা চলে আমার জীবনের ৫৪ বছর বয়ঃক্রম পর্যন্ত যে সাধনার শুরু হইয়াছিল ১০ বছর বয়স হইতে। অর্থাৎ দীর্ঘ ৪৪ বছর অনাহার-অনিদ্রাসহ বর্ণনাতীত কঠোর তপস্যা শেষে এই মিসকিনের উদ্দেশ্য কিছুটা সিদ্ধ হয়, আদামাতের তমদোষমুক্ত হই, নূরময় জগতের বিচরনের ক্ষমতা জন্মে। কিন্তু খোদাপ্রাপ্তির সেই সাধনা এখনও শেষ হয় নাই। এখনও আমি পীরের নির্দেশে পূর্বের মতই চলি, যাবতীয় কার্য সম্পাদন করি।
পীরের সান্নিধ্যে থাকাকালীন সময়ে খোদাপ্রাপ্তির সেই কঠোর তপস্যায়, আটদিন অন্তর অন্তর সামান্য খাদ্য গ্রহনে চেহারা সুরতের কি হাল হওয়ার কথা তাহা একটু চিন্তা করিলেই তোমরা বুঝিতে পারিবে। শরীরের মাংস হাড়ের সাথে লাগিয়া গিয়াছিল, রক্ত কনিকা পর্যন্ত শুকাইয়া গিয়াছিল। তোমরা অনেকেই ব্যবসা কর, কারবার কর। ধর, তুমি কোন জিনিস ১০০ টাকায় ক্রয় করিলে। সেই জিনিসের উপর লাভ করিতে হইলে অবশ্যই তাহা ১০০ টাকার উপরে বিক্রয় করিতে হইবে। তবেই কিছু আয় হইবে।
কাজেই যে মহামুল্য মারেফাত রত্ন এত কষ্টের বিনিময়ে, এত ত্যাগ-তিতিক্ষা ও কঠোর রেয়াজতের বিনিময়ে প্রাপ্ত হইলাম, তাহা তোমরা কষ্ট না করিয়া কিভাবে পাওয়ার আশা রাখ???? খোদাপ্রাপ্তি তত্ত্বজ্ঞান হাছিল করিতে আমার হাড্ডি মাংশ শুকাইয়া গিয়াছিল, কলিজার রক্ত পানি হইয়াছিল। তোমরা ভাবিও না যে, বিনা লাভে আমি ইহা বিক্রয় করিব। কাজেই, তোমরা যাহারা খোদাতায়ালার সান্নিধ্য চাও, জীবন বাজী রাখিয়া এই পথে চলিতে থাক, অনাহার, অনিদ্রা ও দরিদ্রতার। জন্য প্রস্তুত হও। তবে মনে রাখিও, যে আল্লাহর দিকে অগ্রসর হয়, আল্লাহও তাহার দিকে অগ্রসর হন, কঠোর দুর্গম পথ অতিক্রম করিবার ধৈর্য-সাহস তিনিই তাহাকে দান করেন। আমি দু’আ করি, আল্লাহপাক তোমাদিগকে আত্নশুদ্ধির এই কঠিন পথে চলিবার ধৈর্য দেন, সাহস দেন ও শক্তি দেন। আমিন।”
কেবলাজান হুজুরপাকের উপরোক্ত পবিত্র নসিহত শরীফ হইতে আমরা কেবলাজানের কঠোর তপস্যার জীবনী কিছুটা জানতে পারলাম। সূফীবাদের একটা প্রচলিত কথা হল, ” মুরিদ হলো পীরের আয়না”। অর্থাৎ মুরিদের চলা-ফেরা, কথা বার্তা, চলন বলন দেখে মানুষ চিন্তা করে লোকটার পীর কেমন। কেবলাজান হুজুর পাক বলতেন, ” পীরের খাসলতে খাসলত ধর তবেই ত্রান ও শান্তি”।