খাজা এনায়েতপুরী (কুঃ) তিনার শেষ উরস শরীফে বলেছিলেন-“তোমরা সবাই ফরিদপুরীর নৌকায় উঠে যাও”

বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে একনিষ্ঠ খেদমত আর আপন পীর আধ্যাতিক ইশারা পূর্ণ কথা হৃদয়ে ধারণ করে সুদীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর নিরন্তন অবস্থান যে ব্যক্তির আসল নাম তুলে ভুলিয়ে দিয়েছে। এমন এক ব্যক্তির কথা বলছি। বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের কেবলাজান হুজুরের কোটি কোটি ভক্ত অনুরাগীদের কাছে যিনি ”খড়ি চাচামিয়া” নামে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন হয়ে পরিচিত। কিন্তুু ৫০ জন লোকও পাওয়া যাবে না যারা খড়ি চাচামিয়ার আসল নাম জানেন।

খড়ি চাচা মিয়ার আসল নাম মোঃ সামসুদ্দিন সরকার। প্রায় নব্বই বছরের ঊর্ধ্বে বয়স খড়ি চাচা মিয়া বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে আসেন বিশ্ব জাকের মঞ্জিল অর্থাৎ তৎকালীন জাকের ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার মাত্র ৫-৬ বছর পর। তারপর তার চোখের সামনেই জাকের ক্যাম্প রূপান্তরিত হয়েছে জাকের মঞ্জিল ও অবশেষে বিশ্ব মুসলিমের তীর্থস্থান বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে।

খড়ি চাচা মিয়ার জন্মস্থান বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায়। তিনি প্রথমে বায়েতগ্রহন অর্থাৎ মুরিদ হন, বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের কেবলাজান হুজুরের মুর্শেদ হযরত খাজা শাহসুফী এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেবের নিকট। কিন্তুু আপন পীরের ইশারাপূর্ণ কথার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পেরে জীবনের এ অন্তিমলগ্ন পর্যন্ত বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের রান্নার কাজে ব্যবহৃত জ্বালানী কাঠের সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্বরত আছেন।

যে কারণে তিনি খড়ি চাচা মিয়া নামে পরিচিত, চাচা মিয়া হলেন এভাবে- কেবলাজান হুজুর তাঁকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন। তার সাথে এ লেখার বিষয়ে তথ্যানুসন্ধানে বেশ রাতে দেখা করতে আমরা দু’সতীর্থ যুগল গেলে তিনি যেন হারিয়ে গেলেন যৌবন দিনগুলোতে। চোখের সামনে ভেসে আসতে থাকলো একের পর এক পরিবর্তনের কথা।

এনায়েতপুর দরবার শরীফেই খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছিঃআঃ) ছাহেবের সাথে পরিচয়। এনায়েতপুর দরবার শরীফে খাজাবাবা পরিচিত ছিলেন ফরিদপুরের মাওলানা ভাই হিসেবে। সে কারণেই খড়ি চাচা মিয়া কেবলাজানকে মাওলানা ভাই হিসাবেই সম্বোধন করতেন।

কিন্তুু সব হিসাব নিকাশই বদলে গেল শরিয়তে জিন্দেগীতে খাজা এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেবের শেষ উরস শরীফের একটি কথা। যে কথা খড়ি চাচা মিয়ার কানে আজও ভাসে। সে উরস শরীফে সমাপ্তি দিনে খাজা এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেব উপস্থিত জাকেরানদের বিদায় দিতে গিয়ে হঠাৎ বলে উঠেন সবাই ফরিদপুরীর নৌকায় উঠে যাও।

এ ভেদপূর্ণ কথা সেদিন উপস্থিত জাকেরানদের মাঝের অধিকাংশই বুঝতে ব্যর্থ হন। তাদের অনেকেই খড়ি চাচা মিয়াকেও জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ফরিদপুরের মাওলানা ভাই কটা নৌকা সাথে নিয়ে এসেছেন। যাদের অনেকের বাড়ী বা গন্তব্য আসাম, সিলেট, কুমিল্লা ও অন্যান্য স্থানে খড়ি চাচা মিয়া তার আপন মুর্শেদের ভেদপূর্ণ কথা মুর্শেদের দয়ার বদৌলতেই বুঝতে পেরেছিলেন।

তিনি তাদের জবাব দেন মাওলানা ভাইতো দু’তিনটা নৌকা নিয়ে এসেছেন। আর তোমরা বিভিন্ন গন্তব্যের মানুষ তার নৌকায় উঠবেই বা কেন। তোমাদের হুজুর শরীয়তের নৌকায় উঠতে বলেননি বরং বলেছেন এখন থেকে তরিকার ধারা, খাজা ফরিদপুরী (কুঃছিঃআঃ) ছাহেবের হাতে অর্পিত। সুতরাং তোমরা ফরিদপুরী মাওলানা ভাই – এর তরিকার নৌকায় ওঠো।

সেদিনের হাজির থাকা জাকেরানরা তাদের মুর্শেদের ইশারা বুঝতে পারুক আর নাই পারুক খড়ি চাচা মিয়া ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। আর তার পর থেকে তিনি খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃ) ছাহেব তরিকায় নৌকায় উঠেছেন, অদ্যাবধি আছেন আর আমৃত্যু তার পাক কদমের ছায়াতলেই থাকতে চান।

বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে অর্থাৎ তৎকালীন জাকের ক্যাম্পে আসার পর দু’ দরবারেই তিনি আসা যাওয়া করতেন। কিন্তুু খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছিঃআঃ) ছাহেব জাকের ক্যাম্পের যে ঘরে বসবাস করতেন তার কাছেই দুটি টিন দিয়ে একটি রুম করে দেন ও খড়ি চাচা মিয়াকে সেখানে থাকতে বলেন।

এরপর থেকেই বলতে গেলে খড়ি চাচা মিয়া বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের স্থায়ী বাসিন্দা। তারপর তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় আশেপাশের গ্রাম থেকে জ্বালানী কাঠ ক্রয় ও সংগ্রহের, তখন অবশ্য আজকের মত জ্বালানী কাঠ প্রয়োজন হতো না। সে ৫৭ বছর আগের ছোট্ট জাকের ক্যাম্প যেমন আজ বিশাল শহরের মত বিশ্ব জাকের মঞ্জিল ঠিক তেমনি তার জ্বালানী কাঠের প্রয়োজনীয়তা মিটাতে প্রতি বছর কয়েক লক্ষ মন জ্বালানী কাঠ দরকার।

কিন্তুু সেদিনের অল্প অল্প কাঠ খরিদ করে জ্বালানীর সংস্থান করার দায়িত্ব প্রাপ্ত খড়ি চাচা মিয়ার আজও খড়ি গ্রুপের প্রধান পদে বহাল। যে গ্রুপের কর্মির সংখ্যাও অগনিত। খড়ি চাচা মিয়া বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের কেবলাজান হুজুরের জাকের ভাই এ তথ্যটি সকলেই জানেন। কিন্তুু এ প্রতিবেদন তৈরী বিষয়ে তাঁর সাথে আলাপচারিতার আগে আমরা প্রতিবেদকদ্বয় ও জানতাম না যে তিনি পরে খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছিঃআঃ) ছাহেবেরও বয়াত গ্রহন করেছেন।

একদিন কেবলাজান হুজুর তাঁকে ডেকে বলেন, ভাই আসেন তো আপনার ক্বালব বাতায়ে দেই। পূর্ব থেকেই খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃ) ছাহেবের বায়েত গ্রহণের জন্য তৃষ্নার্থ খড়ি চাচা মিয়া নিঃসংকোচে কেবলাজানের কাছ থেকে বায়েত গ্রহন করেন। এ ঘটনা যেন মনে করিয়ে দেয় রাসূলে করিম (সাঃ) – এর ওফাতের পর যেমন হযরত ওমর (রাঃ) হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ছাহেব নিকট বায়েত গ্রহন করেছিলেন।

তখন থেকে খড়ি চাচা মিয়ার ডাকের পরিবর্তন আসে। মাওলানা ভাই থেকে হুজুর কেবলা। দাদা হুজুর অর্থাৎ খাজা শাহসূফী এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেবের দরবারে কেবলাজান হুজুরকে কেমন খেদমত করতে দেখেছেন এ প্রশ্নের জবাবে খড়ি চাচা মিয়া জানান– অমানুষিক কায়িক পরিশ্রম তিনি করেছেন ঠিকই কিন্তুু তিনি যে আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েছেন তা তিনি জন্ম থেকেই অর্জন করেছিলেন।

এনায়েতপুর দরবার শরীফে খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃ) ছাহেব – এর দেওয়া সুরেলা আজানের ধ্বনি এখনো খড়ি চাচা মিয়ার কানে ভাসে।
তরিকত প্রচারের প্রাথমিক পর্যায়ে কেবলাজান হুজুর কি সব নসিহত প্রদান করতেন এমন এক প্রশ্নের জবাবে খড়ি চাচা মিয়া বলেন, আদম সৃষ্টির আদি হতে পৃথিবীর অন্ত পর্যন্ত এমন কিছু নেই যা নিয়ে হুজুর কেবলা ওয়াজ করেননি।

তৎকালীন জাকের ক্যাম্পের নামাজে কারা কারা ইমামতি মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করতেন এ প্রশ্নের জবাবে বয়ঃভারে ন্যুজ খড়ি চাচা মিয়া স্মৃতির পাতা হাতড়ে দু’জনের নামই মনে করতে পারলেন, প্রায়শঃই ইমামতি করতে মাওলানা কাশেমপুরী। আর আজান দিতেন মজিদ তালুকদার।

কেবলাজন হুজুরের তরিকত প্রচারের প্রথম দিকে কোন কোন এলাকার লোক বেশী সাড়া দিয়েছিলেন এর জবাবে খড়ি চাচা মিয়া জানান, ফরিদপুর আর বরিশালের লোক বেশী আসত। খড়ি চাচা মিয়ার সমসাময়িক খাদেমদের নাম জানতে চাইলে তিনি মরহুম সুরত আলী সাহেব ও মরহুম আলাউদ্দিন চৌধুরী নাম স্মরণ করেন।

ইসলামের বিজয়ের বিষয়ে কেবলাজান হুজুর কি ধরনের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন এমন একটি প্রশ্নের জবাবে খড়ি চাচা মিয়া বলেন, কেবলাজান হুজুর পূর্বেই ইসলামের বিজয়ের কথা বলতেন এবং বলতেন বিশ্ব জাকের মঞ্জিল থেকেই ইসলামের বিজয় নিশান উড়ানো হবে।

কেবলাজান হুজুরের রওজাপাক অর্থাৎ নূরের হুজরা শরীফ জেয়ারতে যান কি না জানতে চাইলে খড়ি চাচা মিয়া অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, ওখানে যেতে সাহস পাইনা। তাছাড়াও তার অর্থাৎ খড়ি চাচা মিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস কেবলাজান এখনও আমাদের মাঝেই বর্তমান।

জীবনের এ অন্তিমলগ্নে কি দেখে যেতে চান এ জিজ্ঞাসার পর খড়ি চাচা মিয়া অপলকনেত্রে বললেন, সারা বিশ্বের ইসলামের বিজয় দেখে যেতে পারলে তিনি তৃপ্তি পাবেন। তবে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, যা শিখাতে কেবলাজান হুজুর এই নশ্বর পৃথিবীতে এসেছিলেন সেই শিক্ষার প্রথম শিক্ষা আদব। আমরা আদব শিখতে পারলাম না।

কেবলাজান হুজুর তার শেষ নসিহত “বিশ্ব জাকের মঞ্জিল পরিচালনা-পদ্ধতি” শীর্ষক কিতাবের মাধ্যমে তার যে দু’জন আধ্যাতিক উত্তরাধিকারী আলহাজ্ব মিয়া ভাইজান মুজাদ্দেদী ও আলহাজ্ব মেজভাই মুজাদ্দেদীদ্বয়কে নির্ধারণ করেছেন এ সম্বন্ধে খড়ি চাচা মিয়ার মন্তব্য — কেবলাজান সঠিক পাত্রেই আমানত রেখে গেছেন। কারণ কেবলাজান হুজুরের মতই তারা জন্ম থেকেই এ সম্মান ও সম্পদ অর্জন করে এসেছেন।

সূত্র:- সাপ্তাহিক মেঘনা।

→ জাকের পার্টি প্রতিষ্ঠা ও মূলনীতি

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel