আমানু এবং মুমিনের পরিচয়
আমানু:
কোরানিক শব্দ আমানু শব্দের প্রতিশব্দ হলো ঈমানদার। আমানু শব্দের বাঙলা পরিভাষা হলো বিশ্বাসী। কেমন বিশ্বাসী? লটরপটর বিশ্বাসী। অপূর্ণাঙ্গ বিশ্বাসী। প্রাথমিক বিশ্বাসী। ঈমানে কামেল নয়। এই বিশ্বাসকে আরবিতে ইয়াকীনও বলা হয়। এই ইয়াকীন আবার কয়েক স্তর রয়েছে।
- এক: বিল গায়েবের ইয়াকীন,
- দুই: এলমুল ইয়াকীন,
- তিন: আইনুল ইয়াকীন,
- চার: হাক্কুল ইয়াকীন।
“আল্লাজিনা ইউমিনুনা বিল গাইবি” অর্থ: যাহারা অদৃশ্যে ঈমান আনে (২:০৩)।
গায়েব তথা অদৃশ্য, দৃষ্টির অন্তরালে বস্তু, যাহা ইন্দ্রিয়ানুভূতীর অতীত, যেমন আল্লাহ, মালাইকা, আখিরাত, জান্নাত, জাহান্নাম, কিয়ামত, তকদীর হাশর, মিজান ইত্যাদি। সুরা বাকারার এই বাক্যটি গায়েবের প্রতি ঈমানটি গায়েবের ইয়াকীন নির্দেশ করে। যদিও ঈমান আর ইয়াকীনের মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। ঈমান আনতে হয়, আর ইয়াকীন অর্জন করতে হয় (১৫:৯৯)।
“কাল্লা লাও তালামুনা এলমাল ইয়াকীন ” অর্থ: তাও নয়, (হায়) যদি তোমরা জ্ঞানের দ্বারা বুঝতে পারতে (১০২:০৫)।
জ্ঞান: ইন্দ্রিয়ানুভূতির নির্ভুল ধারনাকে জ্ঞান বলা হয়।
“সুম্মা লাতারা উন্নাহা আইনাল ইয়াকীন “অর্থ: তার পর নিশ্চয়ই তোমরা উহা প্রত্যক্ষভাবে দেখবে। (১০২:০৭)।
প্রজ্ঞা নেত্র: অন্তর দৃষ্টির নির্ভুল বিচার বিশ্লেষণের ভারসাম্যকে বলা হয় প্রজ্ঞা।আয়না সামনে দাড়ালে যেমনে চিত্র দেখা যায়, কোনো কিছু সূক্ষ্ম চিত্তে দেখাই আইনুল ইয়াকীন।
হাক্কুল ইয়াকীন: যিনি সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত তিনিই হাক্কুল ইয়াকীন ওয়ালা।” ইন্না হাজা লাহুওয়া হাক্কুল ইয়াকীন ” নিশ্চয় ইহা অবশ্যই ইহা ধ্রুব সত্য (৫৬:৯৫)।
আমানু কার উপর ঈমান আনবে?
অবশ্যই রসুল তথা অলির উপর ঈমান আনবেন। মহাপ্রভু মহানবীর সাহাবাগণ ঈমান এনেছিল রসুলকে প্রত্যক্ষভাবে দেখে। মহানবী তো জাহেরী হালাতে আমাদের মধ্যে প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত নেই। তাহলে আমরা কিভাবে এই আধুনিক যুগে মহান সাহাবাগনের মহান সুন্নতটি পালন করব? মহান সাহাবাগনের মহান সুন্নতটি পালন করতে গেলে আমাদের প্রত্যক্ষ রসুলের উপর ঈমান আনতে হবে। তা না হলে মহান সাহাবাগণের মহান সুন্নত বাস্তবায়ণ করা সম্ভবপর নয়। এই মহান সুন্নত বাস্তবায়ন না হলে আমাদের ঈমান আনার সুন্নতও বাস্তবায়ন হবে না। আমাদেরকে ইসলামে প্রবেশ করতে তথা মুসলমান হতে গেলে অবশ্যই রসুলের উপর ঈমান আনতে হবে। এবং তার নিকট বায়াত গ্রহণ করতে হবে। তাহলে আমাদের রসুল কোথায়? মহানবী তো উফাৎ হয়ে গেছেন। তিনি তো জাহেরীভাবে আমাদের সামনে উপস্থিত নেই। যদিও তিনি বাতেনীভাবে চলমান।তাকে তো কোরানিক দর্শন অনুসারে খোজে নিতে হয়। কোরানিক দর্শন জানান দিচ্ছে প্রত্যেক জাতিতে, সেই জাতির নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে রসুল প্রেরণ তথা মনোনিত করা হয়। সুতরাং আমরা বাঙালী জাতি, আমাদের মাতৃভাষা বাঙলা, এবং বাঙালীদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। সুতরাং কোরানিক দর্শন জানান দিচ্ছে আমাদের বাঙালী জাতির জন্যে যিনি নিয়োগকৃত রসুল, যিনি আমাদেরকে কেতাব, হিকমত ও রহস্যের জ্ঞান শিক্ষা দিবেন, এবং স্বজাতীয় রসুলের নিকট আত্মসমর্পণ করতে হবে, এবং তার আনুগত্য তথা গোলামী করতে হবে, এবং তাকে অনুসরণ করে চলতে হবে।
ঈমানদারদের জন্য কোরানিক দর্শন ।
কোরানিক দর্শন আমানু তথা ঈমানদারদের জন্য। নবী, রসুল ও মুমিনদের জন্য নয়। মুমিনদের জন্য রয়েছে কিছু উপদেশ। মুমিনগণ, নবীগণ, রসুলগণ, আবদালগণ, আরিফগণ তাঁরা আদেশ নিষেধের বহু ঊর্ধ্বে অবস্থান করেন। কোরানিক দর্শন মানা একমাত্র ঈমানদার তথা আমানুর উপর ফরজে আইন। খান্নাস, নাস, ইনসানের জন্যও নয়। তাদেরকে আহবান করেছেন কোরানিক দর্শন। কোরানিক দর্শন পড়বেন, জানবেন, বুঝবেন, জীবন দ্বারা বাস্তবায়ন করবেন আমানুগণ। আমানুগনকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কিতাবের বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করার জন্য নির্দেশ করেছেন। আমানু তথা ঈমানদারের জন্য সালাত, যাকাত, সিয়াম, কোরবানী ও হাজ্জ, মেজাজি এবং হাকিকি ইবাদতের যাবতীয় প্রায়োগিক আয়োজন।
আল্লাহর নূর রসুল, রসুলের রঙে রঙ্গিন নায়েবে রসুল আরিফবিল্লাহ। যিনি আল্লাহর প্রকৃতির রং ধারণকারী।আর এই আরিফবিল্লাহগণকে বলা হয় হায়াতুল মুরছালীন। আল্লাহর প্রতিনিধি তথা রসুলের নূর অর্জনকারী হায়াতুল মুরছালীনরূপী আরিফবিল্লাহর উপরও ঈমান আনা যায়। যিনি স্রষ্টা এবং সৃষ্টির পরিচয় সমক্যরূপে জানেন তিনিই আরিফবিল্লাহ। এই রসুল তথা আরিফবিল্লাহর হাতের উপর হাত রেখে যারা বায়াত নিবেন তারাই কোরানিক দর্শনে আমানু তথা ঈমানদার। মুসলমানের ঘরে জম্ম নিলেই ঈমানদার হয় না, ঈমান অর্জনীয় বিষয়।
জালিকাল কিতাব তথা আল্লাহর রসুল, আল্লাহর আবদান, আল্লাহর ওলি ও আরিফবিল্লাহর আনুগত্য যারা করেন তাঁরাই কোরানিক দর্শনের পরিভাষায় মুত্তাকী। যেহেতু মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, পার্সি, তাও, শিখ ও খ্রিষ্টান ইতাদি সাইনবোর্ড নিয়ে জম্মগ্রহণ করলেই ঈমানদার হয় না। তাই কোরানিক দর্শন জানান দিচ্ছে রসুল তথা কামিল মুর্শিদের নিকট আত্মসমর্পণ করে পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করার জন্য। কোরানিক দর্শনে রসুল বা গুরুভক্তদের আমানু বলে অভিহিত করেছেন।
কোরানিক দর্শনের আদেশ নিষেধ ও উপদেশ আমানুর জন্য। আমানু তা মানলে নিয়ামতের জান্নাত।না মানলে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির স্থান জাহান্নাম। রসুল তথা অলিয়্যাম মুর্শিদ ব্যতীত সালাত, যাকাত, সিয়াম, কোরবানী ও হাজ্জ ইত্যাদি কোনে কিছুই পরিপূর্ণভাবে হয় না। যদি কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে মুর্শিদ বিহনে এসব পালন করে তবে তা জাহেলাত ব্যতীত কিছু নয়। তার ইবাদত আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে না। সেই ইবাদত হবে শয়তানের। মুখে শতবার তা-উজ পড়লেও শয়তান ছেড়ে দিবে না। যে পর্যন্ত না রসুল তথা অলিয়্যাম মুর্শিদের পদাশ্রয়ে না যাওয়া যায়। কোরান হাদিস একই বিষয়, মাত্রগত পার্থক্য শরিয়ত করেছেন। কোরান এবং হাদিস কিতাবেরই অংশ। এই হাজাল কিতাব তথা পুস্তক কিতাব মনে এবং প্রাণে মানলে ঈমানদার হবে না, জানান দিচ্ছে কোরানিক দর্শন। মহান সাহাবাগণ জীবন্ত কিতাব তথা উম্মূল কিতাব মহানবীর গোলামী করেছেন। হায়াতুল মুরছালিন জালিকাল কিতাব রসুল তথা অলি তথা আরিফ তথা মুর্শিদের গোলামী করতে হবে। এই জালিকাল কিতাবের আদেশ যারা মানেন, নিষেধ যারা বর্জন করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তারাই মুত্তাকী। আর এই মুত্তাকীদের সাথে আল্লাহ জাতরূপে থাকেন।
মুমিন:
যিনি রসুল তথা আরিফ তথা আবদাল তথা অলিয়্যাম মুর্শিদের উসিলায় আপন নফসকে শয়তানের উনিশ প্রকার ধোঁকা হতে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, সফলতা অর্জন করেছেন তিনিই মুমিন। আমানু ঈমানের কাজ করে পরিপূর্ণতা তথা ইয়াকীন অর্জন করলেই ঈমানে কামেল তথা মুমিন। যিনি আপন নফসকে পবিত্র তথা পরিশুদ্ধ করতে পেরেছেন তিনিই সফলকাম। এখনে সফলতা অর্জনের জন্য নফসটিকে পবিত্র করতে বলা হয়েছে। স্তরভেদে নফস কয়েক প্রকার। যথা : নফসে আম্মারা (১২ঃ৫৩), নফসে লাউয়ামাহ (৭৫ঃ০২) নফসে মোৎমায়েন্নাহ (৮৯:২৭), নফসে মূলহেমার (৯১ঃ৭-৮), নফসে অহেদ (২ঃ১৩৮, ৯৫:০৪), ও নফসে আনা । এখানেই “মান রাআনী ফাকাদ রাআল হাক্কা” আনাল হকের হাকিকত।
সেই সফলকাম যে আপন নফসকে পরিশুদ্ধ করেছেন, সেই ব্যর্থ যে আপন নফসকে কলুষিত করেছেন(৯১ঃ৮-৯)। নফসে মোৎমায়েন্নাহ কে বলা হয় পরিশুদ্ধ নফস। তাই কোরানের (৮৯ঃ২৭-৩০) নং আয়াতে বলা হয়েছে- “হে প্রশান্ত নফস! তুমি তোমার রবের নিকট ফিরে আসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হইয়া।আমার দাসদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হও। এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।”
এই পরিশুদ্ধ নফসকেই কোরানিক দর্শন সফলকাম বলেছেন। এই প্রশান্ত তথা মোৎমায়েন্নাহ নফসকে রব তার বান্দা বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন (আম্মারা বা লাউয়ামাহ নফসকে নয়) । এই পরিশুদ্ধ নফস কে রব তার জন্নাতে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছেন। এই পরিশুদ্ধ নফসকে কোরানিক দর্শন সফলকাম বলেছেন । “অবশ্যই মুমিনগণ সফলকাম হইয়াছে “(কাদ আফলাহাল মুমিনুন ২৩ঃ০১)।
কিন্তু কোরানিক দর্শন আমানুকে সফলকাম একবারও বলে জানান দেন নি। একটিবারের তরেও বলে নি আমানু জান্নাতি?
আমানু আর মুমিনের পার্থক্য:
- ১: আমানু শব্দের অর্থ হলো ঈমানদার।
কিন্তু মুমিন শব্দের অর্থ হলো ঈমানে কামেল। - ২: আমানু ফাসেকি বিশ্বাসী।
কিন্তু মুমিন সাদেকি বিশ্বাসী। - ৩: আমানু মুমিন নহে।
কিন্তু মুমিন আমানুও বটে। - ৪: আমানু সফলকাম হওয়ার মহড়ায় রত।
কিন্তু মুমিন সফলকাম।(২৩:০১) - ৫: আমানু খান্নাস তাড়াতে রত।
কিন্তু মুমিন খান্নাস মুক্ত। - ৬: আমানুর ঈমান স্থির নয়।
কিন্তু মুমিনের ঈমান স্থির। - ৭: আমানু আল্লাহর চেহারা অর্জনের জন্য সাধনায় রত।
কিন্তু মুমিন আল্লাহর চেহারা। - ৮: কোরানিক দর্শনের আদেশ নিষেধ আমানুর জন্য।
কোরানিক দর্শনে মুমিনের জন্য রয়েছে তিনটি উপদেশ। - ৯: আমানুর সাথে আল্লাহ জাতরূপে থাকেন না।
কিন্তু মুমিনের সাথে আল্লাহ জাতরূপে তথা রবরূপে থাকেন। - ১০: আমানুদের রব তার দাসদের দাস বলে স্বীকৃতি দেন নাই।
কিন্তু মুমিনকে তার রব দাস বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন (৮৯:২৯)। - ১১: আমানু আল্লাহর দল নয়,
কিন্তু মুমিন আল্লাহর দল। (৫৮:২২) - ১২: আমানু জান্নাতের অধীকারী নয়,
কিন্তু মুমিন জান্নাতের অধিকারী (৮৯:৩০)। - ১৩: আমানু পদপ্রদর্শক নয়,
কিন্তু মুমিন পথপ্রদর্শক। - ১৪: আমানু নফস বিচারের কাঠগড়ায়,
কিন্তু মুমিনের নফস প্রশান্ত। (৮৯:২৭) - ১৫: আমানু রূহপ্রাপ্ত হওয়ার জিহাদে তথা সাধনায় লিপ্ত।
কিন্তু মুমিন রূহপ্রাপ্ত। - ১৬: আমানুর জন্য ইবাদত শর্ত।
কিন্তু মুমিনের জন্য ইবাদত শর্ত নয়। (১৫ঃ৯৯)। - ১৭: আমানু ফায়েশা কাজে লিপ্ত হতে পারে?
কিন্তু মুমিন ফায়েশা হতে মুক্ত। - ১৮: আমানু ডানহাতের অধিকারী নয়,
কিন্তু মুমিন ডানহাতের অধিকারী। - ১৯: আমানুর কলব আল্লাহর আর্শ নয়,
কিন্তু মুমিনের কলব আল্লাহর আর্শ। - ২০: আমানু ইনসান পর্যায়ের,
কিন্তু মুমিন আদম পর্যায়ের। - ২১: আমানু শেরেক মুক্ত নয়,
কিন্তু মুমিন শেরেক মুক্ত। - ২২: আমানু দুনিয়া থেকে মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টায় রত,
কিন্তু মুমিন আল্লাহর দীন তথা তাওহীদে অবস্থান করে। - ২৩: আমানুর দায়িত্ব আল্লাহ নিজের হাতে নেন নাই,
কিন্তু মুমিনের দায়িত্ব আল্লাহ নিজ হাতে নিয়েছেন। - ২৪: আমানু ঈমানদার,
কিন্তু মুমিন বা- ঈমান। - ২৫: আমানু গ্রহীতা তথা অভাবগ্রস্ত,
কিন্তু মুমিন অভাবমুক্ত গণি। - ২৬: আমানু শব্দটি কোরানে প্রায় ২৭৬ বারের মতো রয়েছে,
কিন্তু মুমিন শব্দটি কোরানে ১৪১ আয়াতে রয়েছে।
– আর এফ রাসেল আহমেদ