হোমপেজ ইলমে মারেফত ধর্মতত্ত্বঃ তাসাউফ ভিত্তিক পর্যালোচনা।

ধর্মতত্ত্বঃ তাসাউফ ভিত্তিক পর্যালোচনা।

ধর্মতত্ত্বঃ তাসাউফ ভিত্তিক পর্যালোচনা।

ধর্ম বাংলা শব্দ। ধর্ম শব্দটি ধৃ ধাতু হতে উৎপন্ন। যার অর্থ- ধারণ করা। অর্থাৎ- যে যা কিছু ধারণ করে সেটাই তার ধর্ম। আরবিতে ধর্মকে দ্বিন বলা হয়। যার বাংলা অর্থ ধর্ম, জীবন যাত্রার প্রণালী ইত্যাদি। দ্বিন আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান। বিবেক বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ স্বকীয় বিবেক বলে উহা গ্রহণ করলে ঐ বিধান মানুষকে মুক্তির পথ প্রদর্শন করে।

পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে: “তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে ধর্মে প্রতিষ্ঠিত করো। আল্লাহর প্রকৃতির অনুসরণ করো, যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই এটাই সরল ধর্ম।” -(সূরা আর রূম ৩০: আয়াত ৩০)

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে: “ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই, সোজা পথ তো ভ্রান্ত পথ থেকে আলাদা।” -(সূরা আল বাকারা ২: আয়াত ২৫৬)

পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত আয়াতসমূহে ধর্ম সম্পর্কে আল্লাহ্ তায়ালা মানুষকে এই ধারণা দিচ্ছেন যে, আল্লাহর ধর্ম সহজ এবং স্পষ্ট। তিনি এর মধ্যে কোনো পরিবর্তন করেন না। মানুষের জন্য আল্লাহ্ ধর্ম প্রকৃতির ধর্মের অনুরূপ। স্রষ্টার উপর পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে এই ধর্মে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

মানব রচিত ধর্ম আর আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান এক নয়। ধর্ম আর বিজ্ঞান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যারা এই মর্মার্থ বুঝবে না, তারাই এই ধরনের ভুল করবে। ধর্মকে বুঝে পালন করলে কোনো সমস্যাই হবার কথা নয়, কিন্তু না বুঝে ধর্ম পালনকারীর সমস্যা অবশ্যই রয়েছে। পৃথিবীতে যত ধর্মমত রয়েছে, এর মধ্যে বাহ্যিক ভিন্নতা থাকলেও ধর্মের মৌলিক বিষয় এক। পৃথিবীর সকল ধর্মই বলে-সৎ পথে চল, সত্য কথা বলো, পরোপকার করো, মানবতার পথে চল, মানুষের কল্যাণ করো। মানুষকে ভালোবাস, সমাজে সবাই মিলে মিশে থাকো, পাপ থেকে দূরে থাকো, পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়।

যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে মানুষ ধর্মের ভিন্নতা আনল কীভাবে? যারা ধর্মের মূল আদর্শ বুঝে না, তাদের এই ধরনের ভুল হবার কথা। কারণ ধর্ম গ্রন্থগুলো ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় নাজিল হয়েছে। পরিভাষাগুলোও ভিন্ন ভিন্ন, যার কারণে এই ধরনের ভিন্নতা ধর্মে পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া প্রতিটি ধর্মেই কট্টরপন্থি মৌলবাদীরা রয়েছে। তাদের কারণেই সমাজে বিশৃঙ্লা সৃষ্টি হয়। কেননা তারা ধর্মের মূল আদর্শ বাদ দিয়ে ধর্ম পালন করছেন। হযরত রাসুলুল্লাহ্ (সা.)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত ১ লক্ষ ২৪ হাজার নবি-রাসুল এসেছেন। সকল নবি একই সুতোয় গাঁথা। তাঁরা সকলেই বিশ্ব মানবতার কল্যাণেই কাজ করে গেছেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) আখেরি নবী ও রাসূল, তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। ইতঃপূর্বের সকল ধর্মগ্রন্থেই বলা হয়েছে। বাইবেলের Old Testament আর New Testament হলো দুইটি আসমানি কিতাবের সমন্বয়ে গঠিত। Old Testament হলো তাওরাত কিতাব, আর New Testament হলো ইনজিল কিতাব।

তাই এই দুটি কিতাবেই শরিয়তের ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন Old Testament-এ বলা হয়েছে শুকরের মাংস খাওয়া হারাম। আর তাই ইহুদিরা শুকরের মাংস খায় না। কেননা তাওরাত হলো তাদের ‘আসমানি কিতাব’। কিন্তু খ্রিষ্টানরা আবার ঘবি New Testament অনুযায়ি শুকরের মাংস খায়। যেমন- ইহুদিদের শরীরে নাপাক লাগলে চামড়া ছিলে ফেলতে হতো এবং কাপড়ের উক্ত স্থান কেটে ফেলতে হতো। আর গুনাহ করলে ‘তওবা’ স্বরূপ তাকে হত্যা করতে হতো। কিন্তু খ্রিষ্টানদের ধারণা মতে, তাদের শরীর নাপাকই হতো না, আবার তাদের কোনো গুনাহই হতো না। ইসলামি বিধান মতে, নাপাক ধুলেই তা পাক হয়। আর তওবা করলে তার গুনাহ মাফ হয়। সকল ধর্মেই সততা, সত্যবাদিতা আর আল্লাহ্ একত্ববাদের বিষয়টি এক ও অভিন্ন, কিন্তু বর্ণনার ভাষা ভিন্ন। যার কারণে এই সকল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে।

আসলে ধর্ম কোনো সমস্যাই নয়, বরং সকল সমস্যার সমাধান। যার কারণে শ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী পবিত্র হজ পালন করার উদ্দেশ্যে কাবাঘর জিয়ারতে গিয়েছিলেন। তিনি যে ৩জন শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের নাম বলেছিলেন, তার মধ্যে একজন ছিলেন মুসলমান। মক্কার হযরত আব্দুল গফুর (রহ.)-এর নাম তিনি উল্লেখ করেছেন। যার থেকে বাবা লোকনাথ শিখেছিলেন কুরআন, আর এর বিনিময়ে তাঁকে শিখিয়েছিলেন পুরাণ। মূলত আল্লাহকে ডাকা নিয়ে কথা, তা যে ভাষায়ই হোক না কেন, আল্লাহতো সকলের অন্তরের অন্তঃস্থলে থাকেন এবং সেখান থেকেই জবাব দেন। তাহলে আবার চিন্তার কারণ কী? কেউ কি বলতে পারবে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল (সা.) কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্য।

মানুষ নিজের পছন্দ অনুসারে জমি ভাগ করে দিয়েছে, ঠিক সেভাবে স্রষ্টাকে ভাগ করে নিতে চায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়:- একটি হোটেলে চারজন ব্যক্তি গেল। একজন বাঙালি, একজন পাঞ্জাবি, একজন ইংরেজ ও আর একজন বিজ্ঞানী। এখন যে বাঙালি সে বলল- ‘দাদা জল দিন’, পাঞ্জাবি বলে উঠল- ‘মুজহে পানি পিলাও’, ইংরেজ বলল- ‘Give me a glass of water’’ আর বৈজ্ঞানিক বলে H2O, এখানে যে বুঝবে না, তার কাছে ৪টি জিনিস ভিন্ন ভিন্ন মনে হবে।

আর যিনি বুঝবেন তার কাছে ৪টি বিষয়ই একই মনে হবে। ধর্ম সম্পর্কে না জেনে ব্যাখ্যা করার কারণে এবং ধর্ম গ্রন্থগুলি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় হওয়ার কারণে অজ্ঞরা এই সমস্যা তৈরি করে। আমাদের মুসলমানদের ধারণা যে, হযরত রাসুল (সা.)-এর আবির্ভাব হওয়ার পরে পূর্বের ধর্মগুলি বাতিল হয়ে গেছে, তা ঠিক নয়, বরং ধর্ম পূর্ণতা পেয়েছে।

পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে: “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের জন্য আমার নেয়ামতকে পরিপূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম”। -(সূরা আল মায়িদাহ ৫: আয়াত ৩)

অতএব, এই আয়াতে বুঝা যায় যে, মহান আল্লাহ ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের মাধ্যমে পূর্বের সকল ধর্মকে পরিপূর্ণ করেছেন, বাতিল করেননি। তাহলে এটা বলা অন্যায় নয় যে, পূর্বের ধর্মগুলো বাতিল! সকল ধর্মের সৎকর্মশীল মানুষকে আল্লাহ পুরষ্কৃত করবেন। এই ব্যাপারে আল্লাহ এরশাদ করেন: “যারা বিশ্বাস করে, যারা ইহুদি, খ্রিষ্টান ও সাবেইন, যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসে বিশ্বাস করে ও সৎ কাজ করে তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে তাদের প্রতিপালকের কাছে; তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবে না।” -(সূরা আল বাকারাহ ২: আয়াত ৬২)

যে কোনো ধর্মের লোক এক আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে যদি তাঁর বিধান মত নিজেকে পরিচালিত করতে পারে, পুরস্কার দিবসের মালিক মহান আল্লাহ বলেন, তাহলে তারাও সৎকাজের পুরস্কার পাবে। মোট কথা, ইসলাম বা মুসলিম কোনো ব্যক্তির নাম নয়, এটা আল্লাহ প্রদত্ত নিদিষ্ট বিধান পালনকারীর নাম। যে কোনো অবস্থায় থেকে এই বিধান পালন করতে পারলেই তাকে মুসলমান বলে গণ্য করা যায়। আর যে কোনো অবস্থায় থেকেই এই চরিত্র অর্জন করতে পারলে তার মুক্তি হওয়া সম্ভব।

এখন যারা নিজেদেরকে সৎ পথের দাবিদার এবং অপরকে বাতিল বলে দাবি করে, তারা কি ঠিক করছে? আসলে সকল ধর্মেই কিছু উদারপন্থি ও কট্টরপন্থি লোক আছে। উদারপন্থিদের দ্বারা কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয় না, বরং কট্টরপন্থিদের দ্বারাই সমস্যার সৃষ্টি হয়। বাহ্যিক আচরণ অনুসরণের কারণেই অনেকে আদর্শ ছেড়ে দেয়। মহামানবগণকে অনুসরণ করাই ছিল ধর্ম। যখন থেকে মানুষ মহামানবগণকে ছেড়ে দিয়ে বাহ্যিক আচরণের পিছনে ঝুঁকে পড়েছে, তখন থেকেই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত রাসুল (সা.) পর্যন্ত সকল নবি ও রাসুল ক্বালবের জ্ঞানে জ্ঞানী ছিলেন। তারা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা লাভ করেননি। তাদের বিদ্যাপীঠ ছিল আপন ‘ক্বালব’।

তাহলে আমরা কিভাবে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ইউনিভার্সিটিতে ধর্ম শিখব? ধর্ম শিখতে হলে যেভাবে ধর্ম এসেছে সেভাবে ধর্ম শিখতে হবে। আর সেই পথ হচ্ছে সাধনার পথ। যুগে যুগে মহামানবগণ মানুষের চরিত্র সংশোধন করার জন্যই আসেন। গৌতম বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করেছিলেন। যাকে তাসাউফের ভাষায় ‘ফানাফিল্লাহ’ বলা হয়। আর সুফিদের ভাষায়, ফানাফিল্লাহর পরে আর একটি ধাপ রয়েছে। যার নাম হচ্ছে বাকাবিল্লাহ। ফানাফিল্লাহ হচ্ছে নিজের আত্মাকে স্রষ্টার সাথে মিলিয়ে একাকার করে দেওয়া।

পক্ষান্তরে বাকাবিল্লাহ হচ্ছে_ নিজের মাঝে আল্লাহর অস্তিত্বকে আবিষ্কার করা। যার কারণে সাধক হযরত মনসুর হাল্লাজ (রহ.) বলেছিলেন, ‘আনাল হক’। আমি-ই সেই মহা সত্য। এর ব্যাখ্যা বুঝতে না পেরে শরিয়তের অনুসারিরা তাঁকে হত্যা করে। বিষয়টা অবশ্যই বিবেচ্য যে, ফেরাউন নিজেকে খোদা দাবি করে সাগরে ডুবে মরল এবং অভিশপ্ত হলো। অন্যদিকে মনসুর হাল্লাজ একই কথা বলে আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হলো। কারণ কাজের ফলাফল নিয়তের দিকেই বর্তায়। ফেরাউন দম্ভ করে বলেছিল, ‘আমিই প্রভু’। আর আল্লাহর প্রেমে বিভোর হয়ে হযরত মনসুর হাল্লাজ (রহ.) একই কথা বলেছিলেন। তাইতো ধর্মকে জানতে হলে ধর্মের প্রতি প্রেম থাকতে হবে। তা না হলে ধর্ম সম্বন্ধে জানা যাবে না।

– ইমাম ড. সৈয়দ এ এফ এম নূর এ খোদা