মুহকামাতুন ও মুতাশাবেহাতুন ভেদ:
(হুওয়াল্লাজী আনজালা আলাইকাল কিতাবা মিনহু আইয়াতুন মুহকামাতুন হুননা উমমূল কিতাবে ওয়া উখারু মুতাশাবেহাতুন।)
“সুরা: আলে ইমরান ৩:০৭ নং আয়াত”
অনুবাদ: তিনি তোমার উপর কেতাব নাজেল করিয়াছেন। যাহার কতক খুবই শক্তিশালী, উহাই আসল (মূল তথা হাকিকি) কিতাব এবং অন্যগুলো রূপক (মেজাজি)।
মন্তব্য: কোরানের সাংকেতিক হরফসমূহ তথা শক্তিশালী আয়াতসমূহকে বলা হয় হরফুল মোকাত্তআত তথা মুহকামাতুন। মোট ১৪ প্রকার সাংকেতিক শব্দ কোরান মজিদের ২৯ টি সূরার প্রারম্ভে উল্লিখিত রয়েছে। এই সংকেতসমূহের ১৪ টি অক্ষর ব্যবহৃত হয়েছে। এই ১৪ প্রকার সাংকেতিক চিহ্নই হলো কোরানের মূল, যা খুবই শক্তিশালী এবং তীর্যক। এই শক্তিশালী আয়াতসমূহের রহস্য যিনি উপলব্ধি করেছেন তিনিই রাসেখুনা ফিল ইলম। এই রাসেখুনা ফিল এলেমই কেতাবের সারসত্তা তথা কেতাবের মর্মার্থ। তিনিই কেতাবের শিক্ষক, আল্লাহর কলম। তিনিই কেতাবের সঞ্জীবনী শক্তি, একজন কামেল ( জ্ঞানে পরিপক্ব) পুরুষোত্তম সত্তাই উম্মূল কেতাব।যার মধ্যে কোনো সন্দেহের অবকাশ নাই। এই কামেল মহাপুরুষগণই আমানুগণকে অভিনবর হিকমত তথা রহস্যের জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষাদেন।
নজীরে বেনজীর নামক গ্রন্থের গ্রন্থাকার লিখেন “হরফ কোনো জ্ঞান নয়, আসলকে বুঝানোর জন্য প্রতীক। হরফের প্রতীক দিয়ে কি বুঝানো হয়েছে তা জানা ই হলো জ্ঞান। এলেম দুই প্রকার; একটি পাতার কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে, যাকে এলমুল কালাম বা কালাম শাস্ত্র বা এলমুল লেসানী বলা হয়। এই এলেম যারা পড়ালেখা জানে তারা সবাই পড়তে পারে, জানতে পারে। ইহাকে জাহিরি এলমও বলা হয়। এই এলেম ধর্মজ্ঞান নয়, ইহা হলো ধর্মজ্ঞানের রূপক প্রতীক বা আলংকারিক। কোরানিক ভাষায় তা হলো মুতাশাবেহাতুন বা তাশাবাহা, এই তাশাবাহার অর্থ করতে কোরানিক দর্শন নিষেধ করেছেন। হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেছেন “কালাম শাস্ত্রের মধ্যে যারা ধর্মজ্ঞান সন্ধান করে তারা জিন্দিক। এই এলেমকেই যারা ধর্মজ্ঞান বুঝে এবং বুঝায় তাঁরাই হলো দজ্জাল তথা প্রতারক। আল্লাহর কালাম মতলেক, মতলেক কালাম যখন নাতেক হয়, তখন তা রূপক প্রতীক নিয়ে আসে। এই রূপক প্রতীক বা আলংকারিক ভাষার মাধ্যমে কি বুঝানো হচ্ছে তা জানাই হলো ধর্মজ্ঞান; কোরানিক দর্শনের ভাষায় যাকে বলে হয় মুহকামাত।
এই এলমটি হলো ধর্মশাস্ত্রের গোপন ভেদ, কালাম শাস্ত্রের বিপরীত। যাকে বলা হয় এলমে নববী বা এলমে এলাহি তথা এলমে লদুনি বা সিনার এলেম বা আত্মজ্ঞান। এই এলেম শাস্ত্র বা পাতার কিতাবে লিখা থাকে না, থাকে পবিত্র মানবগণের সিনায় এবং অক্ষরাতীত কালাম চলছে সিনায় সিনায় প্রবাহিত হয়ে। কোরানিক দর্শনের মুতাশাবেহাতের বা তাশাবাহার মুহকামাত হলো মানুষ। যিনি পরিপূর্ণ ইনসানে কামেল, আল্লাহর মাজহার নিরানব্বই নামের সমষ্টির প্রকাশ। (১৩ পৃষ্ঠা)।
কালান্দার মাওলা জাহাঙ্গীর আঃ তার সুফিবাদ আত্মপরিচয়ের একমাত্র পথ বইয়ের তৃতীয়খন্ডে ২২৩ পৃষ্ঠায় ইরশাদ করেন “যখন জীবের মাঝে রূহ ফুৎকার করা হয়, তখনই সে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। তাই মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। প্রচন্ডভাবে রূপকের পর রূপকতার আশ্রয়ে সত্যকথাটি ধারনাতে আসতে কষ্ট হয়। আল্লাহর বানীতে রূপকতার ব্যাপক আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে। রূপকতার মোড়ক ছাড়া সেই যুগে সত্যটি প্রকাশ করলেও মানুষের উপলব্ধির দরজায় ধাক্কা মারতে হয় তো কষ্ট হতো।” আমরা কোরানের ২ নম্বর সুরা বাকারার পহেলা আয়াতে “হরফুল মুহকামাতুন” (আলিফ -লাম- মীম) দেখতে পাই। তার পরের আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন “জালিকাল (ওইটাই) কিতাবু (কিতাব,আল্লাহর নূর)।
ব্যাখ্যা:
আল্লাহর আপন জাত নূরের নূরে মুহাম্মাদি নাম ধারণ করে সেই নূরের মাধ্যমে বিচিত্র সৃষ্টিরূপে আল্লাহর বিকাশ ও প্রকাশ বিজ্ঞানকে কিতাব বলা হয়। আল্লাহর এই বিকাশ বিজ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ রূপটি ধরা পড়ে মানবদেহে। মানবদেহকে আল কিতাব বলা হয়। আল কিতাবের সর্বশ্রেষ্ঠ জাহেরি রূপ হলো এই মানবদেহটি এবং বিকাশ বিজ্ঞানটি হলো বাতেনি কর্মফল। নূরে মুহাম্মাদি এই আল কিতাবের জাহেরি এবং বাতেনি প্রকাশ বিকাশের মূল উৎস। নিজের দেহটিকে পাঠ করা তথা আপন দেহের মাঝে আপনার অনুশীলন করার নামটিই হলো ” আল কিতাব পাঠ করা। নিজের দেহটি হলো সকল প্রকার জ্ঞানের মূল উৎসের ভান্ডার। সুতরাং যা কিছু এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে তাহা আছে একটি মানবদেহে।
+লা (নাই) রাইবা ( কোনো সন্দেহ) ফিহি (ইহার মধ্যে) হুদাল (হেদায়েত) লিল (জন্য) মুত্তাকিন ( মুত্তাকী)।
অনুবাদ: আলিফ – লাম – মীম। ওইটাই কিতাব (এইটা নয়)। নাই কোনো সন্দেহ ইহার মধ্যে, মুত্তাকিনদের জন্য হেদায়েত।
মন্তব্য:
“আলিফ – লাম – মীম” যদিও তিনটি প্রতীকী বর্ণ কিন্তু এখানে আলিফ – লাম- মীম টাই হলো কিতাব। তাই জালিকাল কিতাব তথা ওইটাই কিতাব বলা হয়েছে। বলা হয় নি “হাজাল কিতাব” তথা এটাই কিতাব। এখন ওইটাই বলতে কোনটা বোঝানো হয়েছে? আলিফ- লাম- মীমটাকেই বোঝানো হয়েছে কিতাব। আল্লাহর রহস্যপূর্ণ কথাগুলো বুঝতে না পেরে অনেকে বলে ফেলেন যে ইহার ব্যাখ্যা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।
প্রশ্ন হলো আল্লাহ তো সবকিছুই জানেন, ইহা একটি মামলি ব্যাপার।
কিন্তু যেহেতু এই কথাগুলো প্রকাশ্যে আল্লাহ বলেছেন সেহেতু ইহার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ অবশ্যই আছে। তবে আল্লাহর এই কিতাবের ব্যাখ্যাটি দিতে কষ্ট হয় বলে এড়িয়ে যেতে বাধ্য হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ এটাও বলেছেন যে, কোরান এ জাহা কিছু নাজেল করা হয়েছে তা মানুষের জন্যই। এই আলিফ লাম মীম এর যতরকম ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ দেওয়া হোক না কেন? যদি আন্তরিক হয় তাহলে দোষের কিছু থাকে না। একেক জনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ একেক রকম হতে পারে এবং তাই হয়। কোনো প্রকার ব্যাখ্যা না দিয়ে চুপ করে থাকলেও ভালো মানায়, কিন্তু চুপ না করে সমস্ত বিষয়টা আল্লাহর উপর চাপিয়ে দেওয়া মোটেই সমীচীন নয়।
(কালান্দার মাওলা জাহাঙ্গীর আঃ : কোরানুল মজিদ ও নিহ্নবে চিত্তদাহ সুফিবাদ সার্বজনীন)
প্রতীক বলে না বলা, প্রতীকের মধ্যে ব্যঞ্জনাময় তির্যকভাব অন্তর্নিহিত থাকে। বিমূর্তকে মূর্তে প্রকাশ করলে প্রতীক তথা রূপক তথা উপমার আশ্রয় নিতে হয়। আসল তথা মূলকে দাঁড় করাতে অনুষ্ঠান তথা রূপকতার মাধ্যম নিতে হয়। রূপকের ব্যাখ্যা চলে না, মূলকে প্রকাশ করতে রূপকের প্রয়োজন হয়।
- ১: আলিফ লাম মীম অর্থাৎ input, process, Output.
- ২: আলিফ লাম মীম অর্থাৎ প্রকৃতি ও পুরুষের মিলন। অর্থাৎ পুরুষ শক্তি ও নারী শক্তির মিলন। (বাবা জাহাঙ্গীর আঃ)
- ৩: আলিফ লাম মীম অর্থাৎ পুং-জনন কোষ এবং স্ত্রী জনন কোষের সংযোগ।
- ৪: আলিফ লাম মীম অর্থাৎ নফস, শয়তান ও রূহের বৃত্ত।
- ৫: আলিফ লাম মীম অর্থাৎ নূরী বীর্যের প্রবাহমান ধারা।
- ৬: আলিফ লাম মীম অর্থাৎ কলম, সীরাজাম মুনীরা, চেরাগে জানশরীফ, নূরে হকগঞ্জে নূর, দীপাদার, প্রদীপ্ত প্রদীপ।
- ৭: আলিফ লাম মীম অর্থাৎ নিরপেক্ষতার প্রতীক।
- ৮: আলিফ লাম মীম অর্থাৎ নূরী মুহাম্মদীর বিকাশ বিজ্ঞান।
“এবং অন্যগুলো রূপক”
এই ১৪ প্রকার সাংকেতিক চিহ্ন ও শক্তিশালী আয়াত ব্যতীত অন্য সকল আয়াতগুলো রূপক তথা উপমা তথা মেসাল তথা দৃষ্টান্ত। মূল বিষয়টি রূপকতার আশ্রয় নিয়ে অথবা উপমার আশ্রয় নিয়ে বিশদভাবে বর্ননা করা হয়েছে। রূপক আপেক্ষিক , মূল তথা আসল তথা হাকিকি সার্বিক।সার্বিকের সৌন্দর্য প্রকাশ করতে রূপকের আশ্রয় নেওয়া হয়।
+ (ফাআমমাললাজীনা ফী কুলূবিহিম জাইগুন ফাইয়াততাবেউনা মাতাশাহাবা মিনহুব তেগাআল ফেৎনাতে ওয়াবতেগাআ তাবিলীহী ওয়ামা ইয়াআলামু তাভীলাহু ইললাল্লাহু।)
অনুবাদ:
সুতরাং যাহাদের অন্তর কলব) বাঁকা, সুতরাং তাহারা অনুসরণ করে সেই রূপক (আয়াতগুলিকে) এবং ফেৎনা সৃষ্টির লক্ষ্যে। অথচ আল্লাহই উহার ব্যাখ্যা ভাল জানেন।
মন্তব্য :
সুতরাং যাদের অন্তর বাঁকা, সুতরাং তারা অনুসরণ করে সেই রূপক (আয়াতগুলিকে) এবং ফেৎনা সৃষ্টির লক্ষ্যে। কোরানের ১৮ নং সুরার ৫৪ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন “অবশ্যই আমরা বিভিন্ন ধরনের বয়াণ করিয়াছি এই কোরানের মধ্যে মানুষদের জন্য প্রতিটি উপমা দিয়া। এবং মানুষ হয় বেশিরভাগ বিষয়ে কলহপরায়ণ।”
অর্থাৎ এই আয়াতে আল্লাহ বলতেছেন যে কোরানুল হাকিম এ মানুষদের জন্য সব রকম উদাহরণ বিশদভাবে বর্ননা করে দেওয়া হয়েছে। তবুও এত কিছু জানবার পরও অধিকাংশ মানুষ তর্ক বিতর্কে মেতেওঠে এবং কলহপরায়ণ হয়ে উঠে। এখন প্রশ্ন হলো কোরানের এত ব্যাখ্যা, এত বিশ্লেষণ, এত আদেশ উপদেশ দেবার পরও মানুষ কেন কলহপরায়ণ হয়ে উঠে? কেন তর্কে বিতর্কে নিজেদেরকে লিপ্ত করে? উত্তরটি তো ওই একই কথা, আর সেই কথাটি হলো, প্রতিটি মানুষের পবিত্র নফসের সঙ্গে অপবিত্র খান্নাস নামক শয়তানটি মিশিয়ে দেবার কারনে। কারণ এই খান্নাসই হলো সবরকম কুমন্ত্রণা দেবার একমাত্র গুরুঠাকুর তথা হোতা। সুতরাং বারবার ওই একটি কথাই বলা হচ্ছে এবং অধম লেখকও বারবার বোঝাতে চেষ্টা করেছি।
কোরানের ১৭ নং সুরার ৮৯ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন “আর অবশ্যই আমরা মানুষদের জন্য এই কোরআনে বিভিন্ন উপমা বিশদভাবে বর্ননা করিয়াছি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কুফরী করা ব্যতীত ক্ষান্ত হইল না।”
কোরানের এই রূপক (মুতাশাবেহাতুন) আয়াতগুলো বিকাহুয়া লেবাসী আলেম উলেমাগণ নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে সাধারণ জনতাকে বিভ্রান্ত করেছেন। তারা এই রূপক আয়াতগুলোকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে এক ইসলামকে ৭৩ কাতার দাড় করিয়েছেন। অথচ যেগুলোকে কোরান ব্যাখ্যা করতে নিষেধ করেছেন। এই রূপক বিষয়গুলো একটি নিদিষ্ট যুগের প্রায়োগিক বিধান ছিল। তাই আল্লাহর অলিগণ মূল কোরান তথা নূরী কোরানকে স্বীয় আধারে আবিষ্কার করেছেন। কোনো আল্লাহর অলিই সাদা কাগজের উপর রূপকের তাফসীর করেন নাই।তারা ধ্যানসালাতের মাধ্যমে মহানবীর নূর, নূরী কোরানকে আপন কলবের উপর ফুটিয়ে তুলেছেন।
আর আল্লাহর অলিগণ কোরানের আক্ষিক তফসীর করেন নি। যদিও অলিগণ ভালো করেই জানেন যে কোরানকে তফসীর করতে হয় আপন দেহ ও মনের উপর। কীভাবে কোরানের তফসীর আপন দেহ ও মনের উপর করা যায় সেই ফর্মূলাটুকু আল্লাহর অলিগণ ভক্তদের দান করেন। যদি কারোর অন্তরে খান্নাস তথা ফিৎনাহ সৃষ্টির উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে তিনি কোরানের রূপক আয়াতগুলোর উপর মন্তব্য করলে ক্ষতির আশংকা নেই। কারণ সবকিছু নিয়তের উপর নির্ভশীল। যারা “রাসেখুনা ফিল এলেম” তথা বোধশক্তি সম্পন্ন পরিপক্ব জ্ঞানী তারা মুহকামাতুন এবং মুতাশাবেহাতুন উভয় বিষয়ই অবগত। কারণ তারা হলেন আরিফ। সৃষ্টি এবং স্রষ্টার পরিচয় সমক্য রূপে জানেন আরিফগণই। এই আরিফগণই রূপ এবং আসলের পার্থক্য করার ফুরকান জ্ঞানের অধিকারী।
+(ওয়ার রাসেখুনা ফীল এলমে ইয়াকূলুনা আমাননাবিহী কুললুন মিন ইনদে রাববেনা।)
অনুবাদ: এবং যাহারা জ্ঞানের দিক হইতে পরিপক্ক তাহারা বলে আমরা ইহা বিশ্বাস করি, যাহা আমাদের রবের নিকট হইতে আগত।
মন্তব্য:
যাহারা জ্ঞানের দিক হইতে সুগভীর তথা পরিপক্ব তথা কামেল তথা পূর্ণজ্ঞানী তথা আরিফ। এই সুগভীর জ্ঞানী তথা আরিফ কে? যিনি সৃষ্টি এবং স্রষ্টার রহস্যজ্ঞান সমক্যরূপে জাননেন তিনিই আরিফ। যারা আত্মজ্ঞ, আত্মার বিজ্ঞানী। এলমে লাধুনী তথা এলমে ইরফানের অধিকারী তথা খিজীরী জ্ঞানের ধারক ও বাহক যারা তারা হলেন রাসেখুনা ফিল এলেম। তারাই হলেন সত্য ও মিথ্যার মানদণ্ড। আসল ও রূপকের মধ্যে পার্থক্য নির্নয়কারী ফুরকান জ্ঞানের অধিকারী। দুই মোহনার মিলনকেন্দ্র। তারা হলেন বা- ঈমানের অধিকারী। তারা জানেন কোনগুলো আয়াতে মুহকামাতুন এবং কোনগুলো আয়াতে মুতাশাবেহাতুন। তারা উভয় আয়াতের ধারক এবং বাহক। এবং তারা রূপকগুলো সযত্নে রেখে তথা বিশ্বাসস্থাপন করে আসল দ্বারা মানুষকে কল্যানের দিকে আহবান করে। তাদের কথা জ্ঞানগণ তথা অনুসন্ধানী ব্যতীত অন্য কেউ চিন্তাভাবনা তথা জিকির করে না।সুতরাং অনুসন্ধানীদের উচিত যারা “রাসেখুনা ফিল এলেম” তাদের নিকট থেকে কোরান তথা কেতাবের সারবস্তু জেনে নেওয়া এবং সন্দেহের অবসান ঘটানো।
+(ওয়ামা ইয়াজজাক্কারু ইললা উলূল আলবাবে।)
অনুবাদ: এবং তাহা (উলূল আলবাব তথা মুক্তবুদ্ধি সমপন্ন, চিন্তাশীল, অনুসন্ধানী) ব্যতীত কেহই তাহা জিকির (স্মরণ) করে না।(০৩ঃ০৭)
মন্তব্য:
যারা উলূল আলবাব তথা জ্ঞান অনুসন্ধানী, যারা সত্যকে আলিঙ্গন করার জন্য চরমভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারাই হলেন বিশেষজ্ঞনী তথা সত্য জ্ঞান অনুসন্ধানী উলূল আলবাব। তারাই কিতাবের মধ্যে আয়াতগুলোকে নিয়ে জিকির করে তথা স্মরণ করে, তথা বিশেষভাবে পর্যালোচনা করে তথা গবেষণা চালিয়ে যান।তারাই সত্য জীবন্ত প্রতিমূর্তিকে অনুসন্ধান করে বের করেন। সত্যের এই জীবন্ত মূর্তিকে বলা হয় “রাসেখুনা ফিল এলেম”। যে এলেম সিনা ব নিসা তথা ফুৎকারের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। এই সত্যজ্ঞান ও সত্যনূরের রহস্য অনুধাবন করার জন্য জ্ঞানীগণ তথা উলুল আলবাবগণ কিতাবের মধ্যে ইব্রাহিমের জিকির করেন এবং ইব্রাহিমের মুসল্লাকে অনুসরণ করেন। আল্লাহপাক কোরানের ১৯ নং সুরার মরিয়মের ৪১ নং আয়াতে ইরশাদ করেন “(ওয়াজকুর ফিল কিতাবি ইব্রাহিমা। ইন্নাহু কানা সিদ্দিকান নাবিয়্যান।)”
অনুবাদ: এবং জিকির (স্মরণ) কর কেতাবের মধ্যে ইব্রাহিমকে।নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন সত্যবাদী(সিদ্দিকান) নবী।
কোরানের ২ নং সুরা বাকারার ১২৫ নং আয়াতের ইরশাদ করেন (“ওয়াত্তাখেজু মিন মাকামে ইব্রাহিমা মুসাল্লা)। অর্থাৎ এবং (আমরা) মাকামে ইব্রাহিমকে মুসাল্লা তথা পদচিহ্নকে (সালাতেরস্থান) রূপে গ্রহণ করিতে বলিলাম (আংশিক আয়াত)।
যারা নূরী কোরানের রহস্য জানবার পথের পথিক তাদেরকেই কোরান উলূল আলবাব বলে অভিহিত করেছেন। তবে সত্য জানলেই ঈমানদার হয় না। সত্য জানা এক জিনিস আর সত্যকে মনে প্রাণে হৃদয়ে ধারণ করা অন্য জিনিস। অনেকেই সত্য জানার পরও ঈমান আনেন নাই। তাই উলুল আলবাবগণ জান্নাত পাবে কি পাবে না এই বিষয়ে কোরান স্পষ্ট করে কিছু বলেন নি। কোরানে প্রায় ২৫ শেরও, উপরে আয়াত রয়েছে, সেই আয়াতগুলোর মধ্যে রয়েছে কেতাব বিশদভাবে উপমার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এবং জ্ঞানীদের জন্য চিন্তার খোরাক রয়েছে, তারা যেন গবেষণা করেন বা খুঁটিয়ে খুটিয়ে পর্যালোচনা করেন। তাহলে হয় তো আল্লাহপাক তাদেরকে রহস্যের ডুবিয়ে দিতে পারেন।
মেজাজি কোরানের কিছু শক্তিশালী কালাম তুলে ধরছিঃ-
- “বল, যে কেহ জিবরাইলের শত্রু এইজন্য যে, সে আল্লাহর নির্দেশে তোমার হৃদয়ে (কলবে) কুরআন পৌছাইয়া দিয়াছে, যাহা উহার পূর্ববর্তী কিতাবের সমর্থক এবং যাহা মুমিনদের জন্য পথপ্রদর্শক ও শুভ সংবাদ। (২:৯৭)”
- “আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত ঈমান আনা কাহারও সাধ্য নয় এবং যাহারা অনুধাবন করে না, আল্লাহ তাহাদেরকে কলুষলিপ্ত করেন। (১০ঃ১০০)”
- “তোমার রবের ইবাদত কর ইয়াকীন অর্জন না হওয়া পর্যন্ত। (১৫:৯৯)”
- “তোমার পূর্বে আমরা ওহীসহ পুরুষই প্রেরণ করিয়াছিলাম, তোমরা যদি না জান, তাহলে জ্ঞানীগণকে জিজ্ঞাসা কর। (১৬ঃ৪৩)”
- “প্রেরণ করিয়াছিলাম স্পষ্টভাবে প্রমানাদি ও গ্রন্থাবলীসহ এবং তোমার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করিয়াছি মানুষকে সুস্পষ্ট বুঝাইয়া দিবার জন্য, যাহা তেমাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হইয়াছিল, যাহাতে উহারা চিন্তা করে। (১৬ঃ৪৪)”
- “যে বিষয়ে তোমরা জ্ঞান নাই, উহার অনুসরণ করিও না, কর্ণ, চক্ষু , হৃদয় উহাদের প্রত্যেকটি সম্পর্কেই কৈফিয়ত তলব করা হইবে। (১৭:৩৬)”
- “তোমার রব ওহীর দ্বারা তোমাকে যে হিকমত দান করিয়াছেন, এইগুলি তাহার অন্তর্ভুক্ত। (আংশিক আয়াত ১৭:৩৯)”
- “যে এই ইহলোকে (জীবদ্দশায়) অন্ধ , সে পরজম্মেও (মৃত্যুর) অন্ধ, এবং অধিকতর পথভ্রষ্ট । (১৭:৭২)”
- “সূর্য হেলিয়া পড়িবার পর হইতে রাত্রির ঘন অন্ধকার পর্যন্ত সালাত কায়েম করিবে এবং কায়েম করিবে ভোরের কোরআনের জন্য। নিশ্চয়ই প্রভাতের কোরআন হয় প্রমানিত। (১৭:৭৮)”
- “আমরা প্রত্যেক সমপ্রদায়ের জন্য নিধারণ করিয়া দিয়াছি ইবাদতের পদ্ধতি যাহা উহারা অনুসরণ করে। (আংশিক আয়াত ২২:৬৭)”
- “আকাশে ও পৃথিবীতে এমন কোনো গোপন রহস্য নাই , যাহা সুস্পষ্ট কিতাবে নাই। (২৭:৭৫)”
- “আমি তো আসমান, যমীন ও পর্বতমালার প্রতি এই আমানত পেশ করিয়াছিল, উহারা ইহা বহন করিতে অস্বীকার করিল এবং উহাতে শংকিত হইল, কিন্তু মানুষ উহা বহন করিল, সে তো অতিশয় জালিম, অতিশয় অজ্ঞ। (৩৩:৭২)”
- “আমি তো প্রত্যেক জিনিস সুস্পষ্ট ইমামের মধ্যে সংরক্ষণ করিয়া রাখিয়াছি। (৩৬:১২ নং আয়াতের শেষ অংশ)।
- “আল্লাহ ইসলামের জন্য যাহার কলব তথা বক্ষ উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছেন এবং যে তাহার রবের নূরময়তার মধ্যে রয়েছেন, সে কি তাহার সমান যে এরূপ নয়? দুর্ভোগ সেই কঠোরহৃদয় ব্যক্তিরদের জন্য যাহারা যাহারা আল্লাহর জিকির হইতে গাফেল! উহারা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে রয়েছে। (৩৯:২২)”
- “কোরআন তোমার এবং তোমার সমপ্রদায়ের জন্য সম্মানের বস্তু, সুতরাং এই বিষয়ে তোমাদের অবশ্যই প্রশ্ন করা হইবে? (৪৩:৪৪)”
- “এই কোরআন মানবজাতীর জন্য সুস্পষ্ট দলীল, এবং নিশ্চিত বিশ্বাসী সমপ্রদায়ের জন্য পথনির্দেশ ও রহমত। (৪৫:২০)”
- “নিশ্চয়ই উহা অবশ্যই কারামত ওয়ালা করআন। (৫৬:৭৭)।
- “কেতাবের মধ্যে সুরক্ষিত। (৫৬:৭৮)”
- “পবিত্রগণ ব্যতীত উহা ( কেহই) স্পর্শ করিতে পারে না।(৫৬:৭৯)।
- “রাব্বুল আলামিন হইতে নাজিল করা হইয়াছে। (৫৬:৮০)”
- “এবং নিশ্চয়ই ইহা অবশ্যই নাজেল করিয়াছেন জগৎসমূহের রব। নাজেল করিয়াছেন ইহার সঙ্গে বিশস্ত রূহ। আপনার কলবের উপর যেন আপনি হন সাবধানকারীদের হইতে। (২৬: ১৯২-১৯৪)”
- “নিশ্চয়ই উহা সম্মানিত রসুলের কথা। (৮১:১৯)”
- “এবং (তিনি) কথা বলেন না নিজ প্রবৃত্তি হইতে। (৪৩:০৩)”
সংযমের সংবিধান কিতাব হইতে কিছু কালাম তুলে ধরছি :-
- => শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ, দশভাগে আছে সত্য, আকার ছাড়া আমল ব্যর্থ, তাসাউফে যাহা পাই। (সৃষ্টিতত্ত্ব)
- => পরাগরেণু যেই ফুলে ভরিল, সেই বৃক্ষে ফল ধরিল; আলিফ লাম মীম ফল ধরিল, খাইতে চায় সবাই কৌশল করে। (দেহতত্ত্ব)
- => ইসমে আজম আছে কোরআনে, শুনিলা কেবল কানে; ফল কি আছে ওই নামের গুণে, আমল করে দেখ না। (দেহতত্ত্ব)
- => শাস্ত্র ছাড়া শিক্ষা করে, বিধি ছাড়া কর্মে করে – শাহজাহান স্বরূপ পাইলেন যখন, ইলমে লাধুনি হাসিল হইল তখন। (গুরু তত্ত্ব)”
- => বলছে সাধক শাহজাহানে, সকল বিষয় জানে প্রাণে, আত্মশুদ্ধি হইলে ভুবনে, আল্লাহর অলি কেহ মরে না। (ইসলামের বানী)”
- => তাসাউফের আমল করে, ইলমে লাধুনি হাসিল করে, শাস্ত্রীয় শিক্ষা লাগবে না রে, যদি কারো মেরাজ হয়। (স্বরূপ তত্ত্ব)”
- => সাধক কবি শাহজাহানে, আদেশ মতে চলে এই ভুবনে, গুণি বলে সর্বজনে, দিন কাটাইল জ্ঞানবিতরণে। (সূক্ষ্ম বানী)”
- => আগম নিগম মূল আলোচনা, প্রকাশ্য যায় না জানা, ভেদ বিধান শাস্ত্র কানা, জানতে হয় কৌশলে। ইংঙ্গিতে সংকেতে জানতে হয়, সূক্ষ্ণচিত্তে, অজপা নাম জপতে জপতে, সব বিষয় জানা হইলে। (নিগূঢ় তত্ত্ব)
- => শাহজাহান কয় মঙ্গল মিয়া, বিজ্ঞানী বই প্যাক্টিক্যাল করিয়া, আদ্যশক্তি ধর যাইয়া, কন্টকে রাখিয়াছে গিরী। (বিবেক)”
- => ইসমে জাতে মিশিয়া, সুরাবান তহুরা খাইয়া, অমরত্ব অর্জন করিয়া, পৃথিবীতে সুগন্ধ বিলাইতেছে। (সুরতে আল্লাহ)”
- => শাহজাহানের জীবন গেল, পরমআত্মার সন্ধানে রইল, পরশের স্পর্শে সরশ হইল, জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালাইল। (আলোর সন্ধান)”
- => তাসাউফের জ্ঞান পাইলে, পাঠ্যশিক্ষা লাগে না – কোরান পুরাণ শাস্ত্র পড়ে , আল্লাহ সবাই দেখে না। (তাসাউফ তত্ত্ব)”
- => শাহজাহান বিজ্ঞানী ছিল, সময়মত ফসল কাটিল, কত মানুষ জ্ঞান নিতে আইল, হয়ে গেছে দুজাহানের ধনী। (খারিজ তত্ত্ব).”
- => মক্কায় নাই, মদিনায় নাই, বিশ্বের কোথাও খোজিয়া না পাই, মসজিদ মন্দিরে নাই, আদমসুরতে কোরান মাননি। (উপদেশ)
- => কোরআন হলো আল্লাহর সংবিধান, বলে গেছেন রসুল ভাই, কোরআন হলো কর্মের সংবিধান বলে গেছেন রসুল ভাই, ধরায় ধরায় বিধান করে পাঠাল রাসুলেরে। (সংবিধান)
(সংযমের সংবিধান, বেলায়েতের রসুল হযরত শাহজাহান শাহ আ:)
লেখা: আর এফ রাসেল আহমেদ