হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রহঃ) ছাহেবের অন্তিম উপদেশঃ

হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রহঃ) ছাহেবের অন্তিম উপদেশঃ

ইমামে-রাব্বানী হযরত মুজাদ্দেদ আলফে-ছানী (রাহঃ) যে দায়িত্ব পালনের জন্য আবির্ভূত হইয়াছিলেন, তাহা তিনি যথাযথরূপে পালন করিয়াছেন। তাঁহার সুমহান ব্যক্তিত্বের পরশে কোটি কোটি পথহারা আদম-সন্তান সত্য পথের সন্ধান পাইয়াছে, এই উপ-মহাদেশে শিরক, কুফরী ও নাস্তিকতার যে সয়লাব বহিতেছিল, তাঁহার সংস্কারের ফলে ঐ সমস্তের মূলোচ্ছেদ সাধিত হইয়াছে; তাঁহার মহান তালীম ও দীক্ষার ফলে অজস্র লোক কামালিয়াতের স্তরে পোঁছিয়াছে এবং তাঁহার বাতেনী এলেম হইতে ফয়েজপ্রাপ্ত অসংখ্য মারেফাতপন্থী লোকের নিকট বাতেনী জগতের বহু রহস্য উদ্ঘাটিত হইয়াছে।

এক কথায়, তাঁহার উপর ন্যস্ত কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন হইয়াছে। এবার তাঁহার প্রতি পরপারের আহবান আসিতে লাগিল।

হিজরী ১০৩২ সাল। হযরত মুজাদ্দেদ (রাহঃ) আজমীর শরীফের অবস্থান করিতেছেন। এই সময় একদা তিনি লোকদের বলিলেন, ‘‘ইঙ্গিত পাওয়া যাইতেছে যে, আমার অন্তিমকাল নিকটবর্তী হইয়াছে।”

হযরত মুজাদ্দেদ (রাহঃ) তেষট্টি বৎসর বয়ঃসীমায় উপনীত হইয়াছেন। এমতাবস্থায় একদা ঈদুল্ আয্হার নামাজের পর তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বলিলেনঃ-
‘‘বন্ধুগণ”! আপনাদের নিকট হইতে আমার বিদায় গ্রহণের সময় নিকটবর্তী হইয়াছে। হযরত রাছুলে-পাক (সাঃ) যে বয়সে ওফাত লাভ করিয়াছেন, আমারও সেই বয়স হইয়াছে। অচিরেই আমার ডাক পড়িবে।

সুতরাং আপনাদের প্রতি আমার কিছু অন্তিম উপদেশ:

  • “আপনারা ছুন্নতে-রাছুলের অনুসরন করিবেন; হক্কানী ওলামা এবং বুর্জর্গানে-দ্বীনের আদর্শ অনুসরণ করিবেন।”
  • “যে সব আলেম শরীয়ত-বিরোধী কাজে লিপ্ত, আপনারা তাহাদের ধারে-কাছেও যাইবেন না। যে সমস্ত সূফী ‘ওয়াহ্দাতুল্ ওজুদ’ এ বিশ্বাসী তাহাদের দরবেশী দাবী মিথ্যা।”
  • “আপনারা আল্লাহর জেকর করিবেন; মারেফাত জ্ঞান লাভের জন্য নিয়মিত ‘মুরাকাবা’ (ধ্যান) করিবেন।”
  • “জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর গোলামীতে নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করিবেন।”
  • “যে ব্যক্তি শরীয়তের বরখেলাফে চলে অথচ কেরামতি জাহির করে, আপনারা তাহার ধোকায় পতিত হইবেন না। কারণ, আল্লাহর মারেফাতের সহিত এরূপ ব্যক্তির কোন সম্পর্ক নাই।”

আমার এই উপদেশগুলি আপনারা মান্য করিবেন; ইহাতে বাতেনী এলেমের বরকত লাভ করিতে পারিবেন।

‘‘হে আল্লাহর বান্দাগণ! আমি আল্লাহ এবং তাঁহার প্রিয়তম রাছুলের নিকট হইতে যাহা কিছু পাইয়াছি, উহার সবই আপনাদের নিকট পৌঁছাইয়া দিয়াছি। ইহাও আপনাদের অবিদিত নয় যে, সত্য দ্বীনকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করিয়াছি, বহু জুলুম অম্লানচিত্তে সহ্য করিয়াছি, এমনকি বন্দীজীবনও ভোগ করিয়াছি। আমার কষ্ট সার্থক হইয়াছে-সাধনা ফলপ্রসূ হইয়াছে। আল্লাহর দ্বীন পুনরায় সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। মনে হয়, ইহার পর আমি আর কখনও আপনাদের সঙ্গে এই মজলিসে একত্র হইতে পারিব না। তৎপূর্বেই আমার ডাক পড়িবে। আমি আপনাদিগকে আল্লাহর হাতে সঁপিয়া যাইতেছি। কিয়ামতের দিন হিসাব-নিকাশের সময় হযরত রাছুলে-পাক (ছঃ) এর পার্শ্বে আমার সহিত আপনাদের সাক্ষাৎ হইবে। আপনারা সাক্ষী থাকুন, আমি আমার কর্তব্য পালনে অবহেলা করি নাই। কারণ রাছুলে-পাক (ছঃ) এর সত্য দ্বীনের কতখানি প্রচলন আমার দ্বারা হইল সে সম্পর্কে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিবেন।”

তাঁহার এই আবেদনময় ভাষণ শুনিয়া শ্রোতৃমন্ডলী অভিভূত হইয়া পড়িলেন। সকলেরই চক্ষু অশ্রূ-ভারাক্রান্ত, সবার অন্তরে মহা-বিরহের চিন্তায় হাহাকার রব। সকলেই সমস্বরে বলিয়া উঠিলেনঃ

‘‘হে ইমামুল আওলিয়া! হে নায়েবে-নবী! আপনি স্বীয় দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করিয়াছেন। আপনার উছিলায় মৃতপ্রায় ইসলাম পুনরুজ্জীবিত হইয়াছে। এই মহান দায়িত্ব পালনের পথে আপনি অসহনীয় জুলুম সহিয়াছেন, ধৈর্যের সহিত সকল প্রতিকূলতার মোকাবিলা করিয়াছেন আর আল্লাহর দরবারে শোকরিয়া আদায় করিয়াছেন। আপনার উছিলায় আমরা গোমরাহীর অতল হইতে হেদায়েতের আলোকে উঠিয়া আসিয়াছি। আপনার মাধ্যমে তরিকত ও মারেফাতের বহু জটিল বিষয় সহজবোধ্য হইয়াছে। রহস্য-জগতের অনেক গোপনতত্ত্ব আপনি উদ্ঘাটন করিয়া খোদাতালাশীদের এক নতুন পথের সন্ধান দিয়াছেন। আল্লাহ্তায়ালা আপনাকে উত্তমরূপে পুরস্কৃত করুন।”

অতঃপর হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাহঃ) সকলের জন্য দোয়া করিয়া ভাষণ শেষ করিলেন। ঈদের জামায়াত হইতে সাধারণভাবে সকলের নিকট হইতে বিদায় লইয়া তিনি স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করতঃ নির্জনতা অবলম্বন করিলেন। ইহার কয়েকদিন পরেই তাঁহার শ্বাস কষ্ট রোগ দেখা দিল, সাথে জ্বরও দেখা দিল।

১০৩৪ সালের সফর চাঁদের ২৩ তারিখ তিনি একটুখানি আরাম বোধ করিলেন এবং ফকির-দরবেশগণের মধ্যে অনেকগুলি পোশাক-পরিচ্ছেদ বিতরন করিলেন। লোকেরা জিজ্ঞাসা করিলঃ রোগমুক্তির খুশীতেই কি আজ আপনি এই দান-খয়রাত করিতেছেন? তিনি বলিলেনঃ “না, বরং পরম বন্ধুর মিলনের দিন আসিয়া পড়িয়াছে, সেই আনন্দেই করিতেছি।” পোশাক-পরিচ্ছদ বিতরণের পর তিনি তাঁহার পুত্রগণ ও উপস্থিত খলিফাগণকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, “একজন মানুষ যাহা কিছু পাইতে পারে, আল্লাহতায়ালা আমাকে উহার সবই দান করিয়াছেন।”

উপরোক্ত মন্তব্যের পাঁচদিন পর তিনি সকলকে ডাকিয়া কতিপয় ওছিয়ত করিলেন। রোগাবস্থার ক্রমাবনতি ঘটিতে লাগিল। তিনি খুবই দুর্বল হইয়া পড়িলেন। তাহা সত্ত্বেও পাঞ্জেগানা নামাজ জামায়াতের সহিত আদায় করিতে থাকিলেন।
১০৩৪ হিজরী, সফর চাঁদের ২৮ তারিখ।

হযরত মুজাদ্দেদ আলফে-ছানী (রাহঃ) রোগ-কাতরতা সত্ত্বেও জামায়াতের সহিত ফজরের নামাজ আদায় করিলেন। তারপর কিছুক্ষণ ‘মোরাকাবা’ করিলেন। মোরাকাবা শেষে এশরাকের নামাজ পড়িলেন।

নামাজ হইতে অবসর হইয়া লোকদের বলিলেনঃ আমার প্রসাবের হাজত দেখা দিয়াছে। একটি পাত্রে কিছু বালি দিয়া আমার নিকট নিয়া আস। তৎক্ষণাৎ একটি পাত্র আনা হইল। কিন্তু তিনি বলিলেনঃ প্রস্রাব করিলে পুনরায় অজু করিতে হইবে অথচ অজু করার সময় পাইব না। কাজেই পাত্রটি ফেরৎ লইয়া যাও আর আমাকে কেবলামুখী করিয়া শোয়াইয়া দেও।

তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে ঐভাবে শোয়াইয়া দেওয়া হইল। তিনি তাঁহার ডান হাতখানি স্বীয় চেহারা মোবারকের নিচে রাখিয়া আল্লাহহ্তায়ালার জেকর করিতে লাগিলেন এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তাঁহার পবিত্র রূহ দুনিয়া হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করতঃ পরম বন্ধুর সন্নিধানে চলিয়া গেল।।

তাঁহার পবিত্র লাশ গোছল করাইবার জন্য যখন চৌকিতে রাখা হইল, তখন দেখা গেল, তাঁহার হস্তদ্বয় নামাজের অবস্থার মত নাভিস্থলে বাঁধা রহিয়াছে। গোসলের সুবিধার জন্য কয়েকবার হাত দু’খানি পৃথক করিয়া দেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু প্রত্যেক বারেই হস্তদ্বয় আপনা আপনি নাভির উপর আসিয়া ঐভাবে আবদ্ধ হইয়া যায়।

সুতরাং ঐ অবস্থাতেই গোছল করানো এবং কাফন পরানো হয়।

অতঃপর, তাঁহার পুত্র খাজা ছাদেক (রাহঃ) এর কবরের পশ্চিম পার্শ্বে তাঁহাকে দাফন করা হয়। খাজা ছাদেকের কবরের পশ্চিম পার্শের স্থানটুকুর যে প্রস্থ ছিল, উহাতে আর একটি কবরের জায়গা হইত না। কিন্তু হযরত মুজাদ্দেদ (রাহঃ) এর জন্য কবর খুড়িতে গেলে খাজা ছাদেকের কবরটি আকস্মিকভাবে আপনা আপনি এক হাত পরিমান পূর্ব দিকে সরিয়া যায়।

ছিরহিন্দ শরীফে অবস্থিত তাঁহার পবিত্র মাজার জেয়ারত করিয়া আজও লক্ষ লক্ষ আশেকান ফয়েজ ও বরকত লাভ করিতেছেন।

(গ্রন্থসূত্রঃ হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) এর জীবনী গ্রন্থ, প্রনেতাঃ মাওলানা আনসারী)

– বিনিত, আক্তার হোসেইন কাবুল।

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel