সৃষ্টি ও প্রতিসৃষ্টি
কুম্ভকার যেমন মৃত্তিকার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে ঘটের রূপ দান করে, তেমনি ঈশ্বর তাঁর সত্তার সঙ্গে মানুষকে অঙ্গাঙ্গিভাবে সংযুক্ত করেছেন। কিন্তু যেখানে মৃত্তিকা কুম্ভকারের বাইরে থাকে, সেখানে মানুষ ঈশ্বরের বাইরে নয়। মানুষ তাঁরই অংশ, তাঁরই প্রতিচ্ছবি। ঈশ্বরের সত্তায় যে আলো জ্বলে, সেই আলোর প্রতিফলন মানুষের অন্তরে। এই প্রতিফলনই আমরা আত্মা বলি—যা দেহের মধ্যে বাস করে, কিন্তু দেহের সীমায় আবদ্ধ নয়।
ঈশ্বরের সৃজনশীলতা অসীম, আর মানুষকে তিনি সেই সৃজনশীলতার অংশীদার করেছেন। যেমন তিনি বিশ্বের স্থপতি, তেমনি মানুষও নিজের জগতের স্থপতি। ঈশ্বর যদি বীজ সৃষ্টি করেন, তবে মানুষ সেই বীজ থেকে বৃক্ষ গড়ে তোলে। ঈশ্বর যদি সমুদ্রের স্রষ্টা হন, তবে মানুষ সেই সমুদ্রে জাহাজ ভাসায়। এই প্রতিসৃষ্টির মধ্য দিয়ে মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতা লাভ করে।
যদি বিশ্বে দুঃখ বা অসুখ থাকে, যেমন ভাইরাসের আক্রমণ, তবে তা ঈশ্বরের সৃষ্টিরই একটি রূপ। কিন্তু মানুষের হাতে রয়েছে প্রতিকারের শক্তি। ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টি-ভাইরাস সৃষ্টি মানুষের সেই ঐশ্বরিক ক্ষমতার প্রমাণ। ঈশ্বর মানুষকে শুধু জীবনই দেননি, জীবনকে রক্ষা ও পুনর্গঠনের দায়িত্বও দিয়েছেন। এই দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে মানুষ তাঁর সঙ্গে সহযোগিতা করে, তাঁর সৃষ্টিকে পরিপূর্ণতার দিকে নিয়ে যায়।
মানুষের অন্তরে ঈশ্বর একটি স্বপ্ন বুনেছেন—একটি অসীম সম্ভাবনার স্বপ্ন। তিনি মানুষকে এমনভাবে গড়েছেন যে, তার হৃদয়ে সমগ্র সৃষ্টির প্রতিধ্বনি বাজে। ঈশ্বরের ইচ্ছা মানুষের ইচ্ছায় মিশে আছে; তাঁর শক্তি মানুষের সংকল্পে প্রকাশ পায়। তিনি যদি মানুষকে অন্যভাবে সৃষ্টি করতেন, তবে হয়তো এই স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতা থাকত না। কিন্তু তিনি মানুষকে তাঁরই প্রতিরূপ করে গড়েছেন, যাতে মানুষ তাঁর সঙ্গে মিলে বিশ্বকে নতুন রূপ দিতে পারে।
এই মহান সৃষ্টির মাঝে মানুষ একটি দায়বদ্ধতা বহন করে। ঈশ্বর যখন ফেরেশতাদের বলেছিলেন মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, তখন তিনি মানুষের সম্ভাবনার প্রতি নিজের ভরসা প্রকাশ করেছিলেন। মানুষ সেই ভরসার প্রতিদান দেবে—নিজের সৃজনশীলতা, প্রজ্ঞা ও প্রেম দিয়ে। কারণ, মানুষ শুধু সৃষ্টি নয়, সে স্রষ্টার সঙ্গীও বটে।
– ফরহাদ ইবনে রেহান