অহং ও আত্মসচেতনতা

অহং ও আত্মসচেতনতা

নিজেকে জানার পেছনে সবচেয়ে গভীর অনুপ্রেরণা লুকিয়ে আছে – “যে নিজেকে জানে, সে ঈশ্বরকে জানে”। এটা শুধু একটি আধ্যাত্মিক বক্তব্য নয়, এটি একান্তভাবে জীবন সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরির জন্য একটি নির্দেশনা। আমরা যে কেবল দেহ, চিন্তা বা অনুভূতি তা-ই, এই ধারণা আমাদের আত্মপরিচয়ের সীমাবদ্ধতা বোঝাতে যথেষ্ট। দেহের পরিচিতি এক, কিন্তু তার সত্ত্বা ভিন্ন। ভাবনাগুলোর মধ্যে থেকেও, আমরা কখনও নিজেদের সঠিকভাবে আবিষ্কার করতে পারি না, কারণ “আমি” বলতে যা কিছু বুঝি, তা আসলে আমার নয়।

যতক্ষণ আমরা দেহ, মন, বা চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসল সত্ত্বার দিকে তাকাতে না পারি, ততক্ষণ আমরা অন্ধকারেই আছি। সুতরাং, ঈশ্বরের অস্তিত্ব যদি কিছু জায়গায় অনুভূত হয়, তবে তা আমাদের অন্তরে—অথবা বললে আরও ভালো হবে, ঈশ্বর সেই অন্তর্নিহিত সত্ত্বার মধ্যে আবির্ভূত।

সমাজের একক ব্যক্তি হিসেবে আমরা নিজেদের প্রতিকূলতা বা দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে পড়ি। এই দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষগুলি সাধারণত আমাদের অহং দ্বারা পরিচালিত হয়। আমরা নিজেদের আকাশে উড়তে চাই, কিন্তু যখন দুটি অহং পরস্পরের সম্মুখে আসে, তখন তা একটি বিষাক্ত সংঘর্ষে পরিণত হয়। প্রতিটি দ্বন্দ্ব, প্রতিটি কলহ, যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তবে তার মূল হল – অহং। এই অহং আমাদের সত্যের পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়, আমাদের সৃষ্টির প্রকৃত উদ্দেশ্যকে অস্বীকার করতে বাধ্য করে।

অহং যত বাড়ে, জীবন ততটাই কঠিন হয়ে পড়ে। অহং ছাড়াই শান্তি আসতে পারে না, তবে শান্তি লাভের জন্য অহং সৃষ্টির প্রয়োজন নেই। অহং যেন একটি অগ্নি, যা প্রতিটি মুহূর্তে জ্বলে উঠতে চায়। কিন্তু কীভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে? কীভাবে তাকে প্রশমিত করা যায়? উত্তেজনা, ক্ষোভ, বা শত্রুতা কখনও শান্তির পথ নয়। শান্তি আসবে যখন তুমি নিজের অহংকে শীতল করবে, যখন তুমি নিজেকে বড় করার পরিবর্তে ক্ষুদ্র হয়ে উঠবে।

যতটা না অহংকে ভেঙে শান্তি পাওয়া যায়, তার চেয়েও বেশি তা অর্জন করা হয় অভ্যন্তরীণ প্রেম ও সহনশীলতার মাধ্যমে। “প্রেমই শান্তির মূল” – প্রেমে অহং মুছে যায়, সংঘর্ষ দূরীভূত হয়, কিন্তু প্রেমের যন্ত্রণা আসে অন্য এক প্রান্তে। এটি যে-কোনো অসহিষ্ণু সমাজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্যি সত্যি শক্তি প্রদর্শন করার জন্য প্রস্তুত হয়।

তবে, সর্বোচ্চ যে কঠিন সত্যটি মনে রাখতে হবে, তা হলো: কাঁটার ভিড়ে গোলাপের জন্ম হলেও, সেটি চিরকাল থাকবে না। কাঁটা, ধ্বংস, অসন্তোষ কিছু দিনের জন্য থাকলেও, প্রকৃত মানুষ আসলে সেই গোলাপকেই সৃষ্টি করে, যা নিজে ফুল হয়ে উঠেও অন্যের কাঁটার আঘাত সহ্য করে। শান্তি কখনও এড়িয়ে চলা যায় না। এটি শুধু সময়ের সাথে আসা একটি জীবন পাঠ।

যে জীবনে অহং থাকে, সেখানে গোলাপের স্থানে কাঁটাই থাকবে। কিন্তু যে জীবনে অহং নেই, সেখানে গোলাপ ছড়িয়ে যায়, ছড়িয়ে যায় শুদ্ধতা, সত্য, শান্তি—এবং একদিন, মানুষের খোঁপায় কাঁটা নয়, শুধু ফুল থাকবে।

— ফরহাদ ইবনে রেহান

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel