একটি বিবেক বিক্রি হবে!

একটি বিবেক বিক্রি হবে!

একটি বিবেক বিক্রি হবে!” – এটা খুবই শক্তিশালী এবং চিন্তার খোরাক দেয় এমন একটি ভাবনা। সাধারণভাবে, বিবেক মানুষের নিজস্ব নৈতিক ধারণা এবং সঠিক-ভুলের অনুভূতি। যদি বিবেক বিক্রি হয়ে যায়, তা হলে সেই মানুষটি তার অন্তর্দৃষ্টি এবং নৈতিকতা হারিয়ে ফেলবে, যা তাকে পৃথিবীতে ভালো ও খারাপের মধ্যে পার্থক্য করতে সাহায্য করে।

এটা যে অনেক বড় এবং গভীর বিষয়, তা একদম ঠিক। যখন মানুষের বিবেক হারিয়ে যায়, তখন তার জীবনের মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং মানবিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। অনেক সময় আধুনিক সমাজ, সমাজের চাপ, কিংবা ক্ষমতার লোভ মানুষকে তার বিবেক বিক্রি করতে বাধ্য করে। আর তখন, সে তার নৈতিকতার জন্য দায়ী হয় না, বরং সস্তা লাভের পেছনে ছুটতে থাকে।

এই বিষয়টি আমাদের চিন্তা করতে বাধ্য করে—”আমরা কি এখনো নিজের ভিতরের সঠিক এবং ভুলের অনুভূতিকে মূল্য দিচ্ছি, নাকি পৃথিবীর নানা কৌশল ও প্রলোভনের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বিবেককে বিক্রি করে দিচ্ছি?”। এটি কোনো এক ধরনের সতর্কীকরণও হতে পারে, যাতে আমরা আমাদের জীবনে সঠিক পথটি বেছে নিতে পারি এবং নিজের মানবিকতার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারি।

এটা সত্যি যে, যখন মানুষের বিবেক বিক্রি হয়ে যায়, তখন সে তার নৈতিকতা, মূল্যবোধ, এবং মানবিকতা হারিয়ে ফেলে। আজকের পৃথিবীতে অনেক সময় আমরা দেখতে পাই যে মানুষ বিভিন্ন সুবিধার জন্য, ক্ষমতা অর্জনের জন্য, অথবা সামাজিক চাপের কারণে নিজের ভিতরের সঠিক-ভুলের অনুভূতিকে বিসর্জন দেয়। এতে তারা কিছু সময়ের জন্য সফল হতে পারে, কিন্তু আসলে দীর্ঘমেয়াদে তারা নিজেকেই হারিয়ে ফেলে।

এটা মনে রাখতে হবে যে, যে মানুষ নিজের বিবেকের কথা শোনে না, সে কখনোই আসল সুখ ও শান্তি খুঁজে পাবে না। জীবন কখনোই সহজ সরল পথে চলে না, কিন্তু আমাদের বিবেক যদি সঠিক থাকে, আমরা পথ হারাই না। আমাদের সততা, ন্যায্যতা, এবং মানবিকতা আমাদের দিকনির্দেশক হয়ে থাকে।
একটি সমাজের গভীরতা তখনই প্রকট হয়, যখন মানুষ তার অন্তর্দৃষ্টি এবং আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, এবং যেটি আমাদের “বিবেক” হিসেবে পরিচিত, সেটি বাইরের প্রভাবের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। বিবেক মানে শুধু সঠিক ও ভুলের অনুভূতি নয়, এটি আসলে আমাদের আত্মার সঙ্গীত, যা আমাদের অস্তিত্বের গভীরতা, উদ্দেশ্য এবং মানবতার সঙ্গে সম্পর্ককে আবিষ্কার করতে সাহায্য করে।

বিবেকের বিক্রি

কীভাবে আমরা আমাদের বিবেক বিক্রি করি?
এটা কখনোই এক মুহূর্তের ঘটনা নয়। একে ধীরে ধীরে ঘটতে হতে পারে, একটি সমাজের প্রেক্ষিতে যেখানে সকল কিছুই ‘ব্যবসা’ হয়ে ওঠে—তবে একে একেবারে জীবনের দর্শন হিসেবে মেনে নেয়া খুবই বিপজ্জনক। যখন মানুষ ক্রমাগত সমাজের প্রত্যাশার কাছে হেরে যায়, যখন সামাজিক সেলিব্রিটি বা বাহ্যিক সফলতা হয়ে ওঠে একমাত্র কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য, তখন তারা নিজেদের সত্যিকারের পরিচয় এবং জীবনের গভীরতা থেকে বিচ্যুত হয়।

অভ্যন্তরীণ খালাস: এই অবস্থা যখন গম্ভীর হয়ে যায়, তখন মানুষ এক ধরণের ‘অভ্যন্তরীণ খালাস’ বা আত্মবিশ্বাসের অভাব অনুভব করে। তারা দৃষ্টির বাইরে নিজেকে খুঁজতে থাকে, অথচ আসলেই সে নিজেকে হারিয়ে ফেলে। আমাদের চারপাশের প্রবণতা, চিন্তাধারা, সমাজের চাহিদা, যে কৌশলগুলি প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করে, সেই সব কিছু আমাদের প্রকৃত আত্মার সাথে বৈপরীত্য সৃষ্টি করে। এই বিচ্যুতির কারণে, আমাদের জীবন হয়ে ওঠে মানসিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে খালি।

প্রকৃত বিবেকের পরিচয়: প্রকৃত বিবেক কখনোই বাইরে থেকে প্রভাবিত হতে পারে না। এটি অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে জাগ্রত হয়। বিবেক হচ্ছে সেই অভ্যন্তরীণ আলো যা আমাদের কণ্ঠে, আমাদের মনের গভীরে গাইতে থাকে, “এটা সঠিক”, “এটা ভুল”, এবং যা আমাদের দিকনির্দেশক। কিন্তু যখন সেই অভ্যন্তরীণ কণ্ঠ বন্ধ হয়ে যায় এবং বাইরের ধ্বনি প্রবল হয়ে ওঠে, তখন আমরা নিজেদের পথ হারিয়ে ফেলি।

বিচ্ছিন্নতার দিকে পা: বিবেক হারানোর সবচেয়ে বড় ফলাফল হলো—মানুষ তার আত্মসত্তার সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। সে সময়, “আমি কে?”—এই প্রশ্নটি একটা খালি চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়, এবং সেই খালি অবস্থায় সে অন্যের প্রত্যাশা পূরণে মনোনিবেশ করে। সমাজের থেকে প্রতিফলিত হওয়া ছবি এবং চাহিদার পরিপূরণে মানুষের জীবন কাটে, কিন্তু সেই ছবিতে কোনো বাস্তবতা থাকে না।

গভীর মানবিকতা এবং অস্থির বিশ্ব: আমরা যে বিশ্বে বাস করি, তা একটি অস্থির বিশ্ব, যেখানে সত্য এবং মিথ্যা, সঠিক ও ভুলের মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একে অপরকে ঠকানোর প্রবণতা, পুঁজি, ক্ষমতার দখল, ব্যক্তিগত লাভের জন্য অন্যকে পদদলিত করা, এই সব কিছুই হয়ে দাঁড়িয়েছে সাধারণ রীতি। এতে আমাদের গভীর মানবিক মূল্যবোধ বা আদর্শ ভোঁতা হয়ে যায়, এবং আমরা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত হওয়ার পরিবর্তে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়।

অন্য মানুষের অস্তিত্বের সম্মান: যখন মানুষের বিবেক বিক্রি হয়ে যায়, তখন সে নিজে এক ধরনের মেকি বাস্তবতায় বাস করতে থাকে। কিন্তু প্রকৃত শান্তি এবং আধ্যাত্মিক মুক্তি তখনই আসে, যখন আমরা অন্য মানুষের অস্তিত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং আন্তরিক ভালোবাসা অনুভব করি। জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য তখনই উপলব্ধি করা যায় যখন আমরা বুঝি, আমাদের সংযোগ এবং সমর্থন একে অপরের মধ্যেই নিহিত রয়েছে, তবে সেই সংযোগ “অন্তর্দৃষ্টির” মধ্যেই আবিষ্কার করা যায়।

পুনর্জন্মের প্রক্রিয়া: যখন মানুষ নিজের বিবেককে পুনরায় খুঁজে পায়, তখন তার জীবনে একধরনের পুনর্জন্ম ঘটে। একে আমরা বলতে পারি আধ্যাত্মিক পুনর্জন্ম, যেখানে তার নিজের সত্যিকারের পরিচয় এবং তার জীবনের লক্ষ্য পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সেই সময়, তার কর্ম, চিন্তা এবং বিশ্বাস একে অপরের সাথে সংযুক্ত হয়ে তাকে সত্যিকারের উদ্দেশ্যে পৌঁছানোর পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।

শেষ কথা:
বিবেক বিক্রি হয়ে গেলে, আমরা শুধু আমাদের নৈতিকতা বা মানবিকতা হারাই না, আমরা আমাদের নিজেদের অস্তিত্বকেই হারিয়ে ফেলি। কিন্তু, যেই মুহূর্তে আমরা নিজের বিবেকের দিকে ফিরে তাকাই, সেই মুহূর্তে নতুন এক জীবন শুরু হয়—যে জীবন আধ্যাত্মিক প্রশান্তি, আন্তরিকতা এবং সত্যের দিকে নির্দেশিত।

– ফরহাদ ইবনে রেহান
২/১০/২০১৯

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel