জপ: শব্দের শক্তি ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

জপ: শব্দের শক্তি ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

শব্দের শক্তি এবং তার প্রভাব কেবল আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানসিক ও শারীরিক জীবনে এর বিশাল প্রভাব রয়েছে। বস্তুবাদী মনোবিজ্ঞানীরা আজকাল জপের এই প্রভাবকে এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণ করছেন। যখন কোনো ব্যক্তি বারবার নিজেকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করার জন্য ‘আমি ভালো হচ্ছি’ বলতে থাকে, তখন তার মস্তিষ্কে ওই ভালো হওয়ার ধারনা ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং বাস্তবেও তার জীবন পরিবর্তিত হয়।

মনোবিজ্ঞানী Emile Coue এই ব্যাপারটি প্রমাণ করেছেন, যেখানে তিনি ‘Every day, in every way, I’m getting better and better’ এই মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি করার মাধ্যমে মানুষের আত্মবিশ্বাস এবং সামগ্রিক মানসিক অবস্থার উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছেন।

আধ্যাত্মিক সাধকরা কিন্তু হাজার বছর আগেই এই বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁরা বলেছেন, “শব্দই ব্রহ্ম।” তারা বলেছিলেন, যার আগমন বা আবির্ভাব আপনি চান, তার নাম জপ করুন। আসলে, প্রতিটি শব্দের মধ্যে একটি গভীর শক্তি নিহিত থাকে এবং সেই শক্তি আমাদের জীবনে বিভিন্ন প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি, পবিত্র শাব্দিক শক্তি বা জপ আমাদের মনের অন্ধকারে আলোর সঞ্চার করে এবং আমাদের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে।
এটা সেকথা নয় যে, কেবল ধর্মীয় শব্দ বা মন্ত্রের পুনরাবৃত্তি কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসে; বরং যে কোনো শব্দ বা ধ্বনি, যদি বারবার উচ্চারিত হয়, তার শক্তি বেড়ে যায়। উদাহরণ হিসেবে, আমরা যদি শব্দ ‘ফুল’ বারবার বলি, তখন মনের ওপর তার প্রভাব প্রকট হতে থাকে—আমরা ফুলের সৌন্দর্য এবং প্রশান্তির অনুভূতি অনুভব করি।

আরেকটি উদাহরণ, যদি আপনি কারো সামনে গিয়ে বলুন, “দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, সাবধানে থেকো,” তবে আপনি সেই বিপদকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। কারণ, এমন ভয়াবহ শব্দের পুনরাবৃত্তি মনের গভীরে উদ্বেগ সৃষ্টি করে, যা পরবর্তী সময়ে বাস্তবতার রূপ নিতে পারে। যেমন আমরা প্রায়ই শুনে থাকি, “বৃষ্টিতে ভিজো না, জ্বর আসবে,” এমন কথায় এক প্রকারের মানসিক প্রস্তুতি তৈরি হয়, যা আসলে শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়।
শব্দের শক্তি যদি এতই ব্যাপক হয়, তবে আমরা যদি কিছু নেতিবাচক শব্দ বা ভাবনা বারবার উচ্চারণ করি, তবে সেগুলো বাস্তবে পরিণত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কেউ যদি অবিরাম বলে, “কপাল ভালো না,” তাহলে তার জীবনে প্রকৃতপক্ষে কোনো ভালো কিছু ঘটবে না। কারণ, সে নিজের উপর নেতিবাচক শক্তি জড়ো করছে এবং সেই শক্তি তার জীবনে নেতিবাচক ফল নিয়ে আসবে।

যেহেতু শব্দই শক্তি, যেই শব্দ বেশি উচ্চারিত হয়, সেই শব্দের শক্তি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আজকের বিশ্বে যেমন ‘করোনা’ শব্দটি বারবার উচ্চারিত হচ্ছে, সে কারণে এই শব্দের সাথে সম্পৃক্ত মানসিকতা এবং উদ্বেগ সমাজে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিকাংশ মানুষ এই শব্দটি শুনতে শুনতে আতঙ্কিত হচ্ছে, যার ফলে এটি মানুষের জীবনে আরও প্রকট হতে শুরু করেছে। সুতরাং, যতটা সম্ভব আমাদের শব্দের প্রতি সচেতন থাকা উচিত, যেন আমরা অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো নেতিবাচক শক্তি নিজের জীবনে প্রবাহিত না করি।

শেষ কথা–
জপ বা শব্দের পুনরাবৃত্তি শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক বিষয় নয়, এটি একটি শক্তিশালী মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া। যে শব্দ বা ভাবনা আমরা নিয়মিত উচ্চারণ করি, তা আমাদের মনের উপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং আমাদের জীবনকে পরিচালনা করে। তাই, যদি আমরা আমাদের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন চাই, তাহলে সেই শব্দগুলোর প্রতি আমাদের মনোযোগ ও সচেতনতা বাড়াতে হবে যা আমাদের জন্য শান্তি, ভালোবাসা এবং ইতিবাচকতা নিয়ে আসবে।

–ফরহাদ ইবনে রেহান

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel