অস্তিত্বের গভীরতা এবং আমি
“অস্তিত্বের গভীরতা এবং ‘আমি’”
অস্তিত্বের যে রহস্য, তা মানব মনের সীমা ছাড়িয়ে যায়। আমরা যখন ‘আমি’ বলি, তখন কি আমরা আমাদের সত্যিকার অস্তিত্বকে প্রকাশ করছি, নাকি শুধুমাত্র একটি বাচনিক ধারণাকে শক্তিশালী করছি? ‘আমি’ কি শুধুই একটি ভ্রান্ত কল্পনা, যা আত্মার গভীরতায় আমাদের বিভ্রান্ত করে, না কি এটি আমাদের প্রকৃত সত্ত্বার প্রতিফলন?
ধারণাটি চিরকালীন—আমি মানে আমি। কিন্তু, যদি আমরা একটু দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাই, তাহলে এই ‘আমি’ এক মুহূর্তে স্থান ও কাল পরিভ্রমণ করে। ‘আমি’ কি সেই ‘অস্তিত্ব’ যা চিরকাল এক থাকে? ‘আমি’ কি সেই নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা, যার মাধ্যমে আমরা পৃথিবী ও বিশ্বকে জানি?
আমরা যখন আত্ম-অনুসন্ধান করি, তখন আমাদের ‘আমি’ হল এক অসীম সমুদ্র, যার তলানিতে রয়েছে গভীর শান্তি, এবং উপরে রয়েছে বিশালতা। আমরা ভুলে যাই, যে ‘আমি’ কখনও শূন্য নয়—এটি একটি অবিরাম পরিবর্তনশীলতা, একটি অবিনশ্বর শক্তি। এই শক্তি কখনও মুছে যায় না, বরং যুগের পর যুগ ধারণা বদলানোর মাধ্যমে পুনর্জন্ম নেয়।
“অন্তরের একত্বের সন্ধান”
মানুষের অস্তিত্ব পৃথিবীতে যে যাত্রার পথে রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল অন্তরের একত্বের অনুসন্ধান। মানুষের জীবনে বিভিন্ন সময় মনে হতে পারে যে, সে বিভক্ত—দেহ, মন এবং আত্মা ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্বের মতো চলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এগুলি সব একে অপরের সাথে গভীরভাবে যুক্ত। যে মানুষ নিজেকে আলাদা মনে করে, সে আসলে পৃথিবীর সর্বজনীন একত্বের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
আমাদের অস্তিত্বের মূল কাঠামো আমাদের মন ও আত্মার মধ্যে প্রবাহিত শক্তির মধ্যে লুকিয়ে থাকে। এই শক্তি, যা আমাদের ভিতরে কাজ করছে, তা আমাদের আত্মবিশ্বাস, অভ্যন্তরীণ শান্তি, ভালোবাসা ও উদ্দেশ্যের উৎস। আমাদের দেহগত সত্ত্বা কখনো পরিপূর্ণতা পাবে না, যদি না আমরা আমাদের অন্তরের একত্ব উপলব্ধি করি।
যতদিন না আমরা আত্মার এই একত্ব অনুভব করতে পারি, ততদিন আমরা দেহ-মন আর আত্মার বিভাজনে আটকে থাকব। কিন্তু যখন আমরা জানব, যে ‘আমি’ কখনো বিচ্ছিন্ন নয়—এটা এক অবিচ্ছেদ্য সত্ত্বা, যা সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্কিত—তখনই আমাদের জীবনে আসবে প্রকৃত শান্তি।
“সমগ্র অস্তিত্বের সাথে সংযোগ”
বিভিন্ন ধর্ম, দর্শন এবং আধ্যাত্মিক শাস্ত্রের মধ্যে একটি মৌলিক সত্ত্বা দেখা যায়, যা হলো: সবকিছু এক। পৃথিবী, আকাশ, মহাকাশ, বস্তু, প্রাণী—সবকিছুই এক অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রকাশ। এই মহাশক্তি, যা আমাদের মধ্যে বিরাজমান, তা আমাদের অস্তিত্বের সত্য। আমরা কেউ পৃথক নই, আমরা একসূত্রে বাঁধা। যখন আমরা আমাদের নিজের গভীরতা উপলব্ধি করি, তখন সেই একত্বের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে শান্তির আবেশ।
এই সংযোগের মধ্যে রয়েছে অসীম রহস্য। আমরা যেমন সাগরের ঢেউ, তেমনি পুরো সাগরও আমরা। আমাদের জীবনের এক একটি ক্ষণ, একটি মুহূর্ত, একটি অনুভূতি—সবই মহাবিশ্বের ছোটখাটো এক অংশ। যখন আমরা একে অপরকে গভীরভাবে বুঝি, আমরা বুঝতে পারি যে, এই পৃথিবীতে কেউই একা নয়। আমরা সবাই সমগ্র অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি, যা একসঙ্গে মিলিত হয়ে জীবনকে পূর্ণতা দেয়।
এখন, যখন আমরা আমাদের অস্তিত্বের একত্ব অনুভব করি, তখন এটি শুধুমাত্র চিন্তা বা দর্শনের বিষয় নয়—এটি একটি অভ্যন্তরীণ অবস্থা, যা আমাদের অনুভব করতে হয়, উপলব্ধি করতে হয়। একমাত্র তখনই আমরা জীবনের প্রকৃত সত্য বুঝতে পারব। আমাদের আত্মার এই উপলব্ধি, আমাদের অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে পৌঁছানোর পথ সুগম করে দেয়।
“সত্ত্বার অমরত্ব এবং সার্বজনীনতার পথে”
আধ্যাত্মিকতা এবং দর্শন কখনো বাহ্যিক বিষয় ছিল না। এটি সবসময়ই অভ্যন্তরীণ—একটি গভীর যাত্রা, যা আমাদের নীরব, অদৃশ্য অস্তিত্বের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আত্মার অমরত্ব, আমাদের জীবনের সার্বজনীনতা আমাদের জীবনের আসল লক্ষ্য। যে আমরা সৃষ্টির অংশ, সেই একই শক্তি আমাদের ভিতরে রয়েছে, যার দ্বারা জীবন তৈরি হয়, পরিব্যাপ্ত হয় এবং অবশেষে নিঃশেষ হয়ে যায়।
বিষয়টি হল—যতদিন না আমরা এই অন্তর্নিহিত শক্তিকে বুঝতে পারি, ততদিন আমরা পৃথিবীতে বিচ্ছিন্ন, বিভ্রান্ত হয়ে চলতে থাকব। যখন আত্মার অমরত্ব ও সার্বজনীনতার পথে চলি, তখনই আসবে শান্তি, মুক্তি, এবং দ্যাখা যাবে যে আমাদের জীবনই এক সুস্পষ্ট উদ্দেশ্যের দিকে পরিচালিত।
তবে এই জ্ঞান কেবল বাহ্যিকভাবে উপলব্ধি করা যায় না—এটি অনুভবের বিষয়, একটি অভ্যন্তরীণ সত্য। শুধু তখনই আমরা জানতে পারি যে, যাত্রার সার্থকতা কেবল বাহ্যিক অর্জনে নয়, বরং আত্মার অভ্যন্তরীণ জানার মধ্যে।
লেখা- ফরহাদ ইবনে রেহান