সৃষ্টি বা কসমস (Cosmos)

সৃষ্টি বা কসমস (Cosmos)

সৃষ্টি বা কসমস (Cosmos) বলতে সাধারণভাবে বুঝায় সেই প্রক্রিয়াকে যা মাধ্যমে বিশ্ব বা জগত তৈরী হয়। এটি পৃথিবী, নক্ষত্রমণ্ডল, গ্রহ, প্রাণী, উদ্ভিদ, আকাশ, জল, মাটি, ও অন্যান্য সমস্ত বস্তু এবং শক্তির সমষ্টি। আধ্যাত্মিক, দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সৃষ্টির বিভিন্ন সংজ্ঞা রয়েছে, এবং এগুলোর প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা প্রদান করে।

বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ: বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সৃষ্টির সংজ্ঞা সাধারণত বৃহৎ বিস্ফোরণ (Big Bang Theory) থেকে শুরু হয়ে বিশ্বমণ্ডলের সম্প্রসারণ এবং বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়া বুঝায়। এটি বিশ্বভরের সমস্ত পদার্থ, শক্তি এবং শক্তির উৎসের উৎপত্তি এবং তাদের ক্রমবর্ধমান সংগঠন এবং বিকাশের প্রক্রিয়া।

বৃহৎ বিস্ফোরণ (Big Bang): বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, প্রাচীনকালে (প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে) একটি বিশাল বিস্ফোরণের মাধ্যমে পৃথিবী, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, এবং মহাবিশ্বের সমস্ত উপাদান তৈরি হয়েছিল। এটি মহাবিশ্বের আদি সৃষ্টির মুহূর্ত হিসেবে ধরা হয়।

উৎপত্তি ও বিকাশ: বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির পর, বিভিন্ন মহাজাগতিক শক্তির প্রভাবে, পদার্থগুলো গঠিত হয় এবং ক্রমে তারা পৃথিবী, গ্রহ, নক্ষত্র, ব্ল্যাক হোল এবং অন্যান্য জ্যোতিষ্কের আকার ধারণ করে। জীবনের বিকাশও ঘটে পৃথিবীতে।

আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ: আধ্যাত্মিকভাবে, সৃষ্টি সাধারণত ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা বা অজ্ঞেয় শক্তির প্রকাশ হিসেবে ধরা হয়। বিভিন্ন ধর্মে সৃষ্টির জন্য আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা রয়েছে:

হিন্দুধর্ম: হিন্দুধর্মে সৃষ্টি, পালন এবং প্রলয়ের ত্রিমূর্তি (ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব) এর মাধ্যমে সৃষ্টির প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ব্রহ্মা সৃষ্টির দেবতা, বিষ্ণু পালন করেন এবং শিব প্রলয় বা ধ্বংস ঘটান।

ইসলাম: ইসলাম মতে, পৃথিবী এবং সমস্ত সৃষ্টির উৎপত্তি আল্লাহর ইচ্ছায়। আল্লাহ একমাত্র স্রষ্টা, এবং সৃষ্টির শুরু থেকেই পৃথিবী, আকাশ, জীবজন্তু, মানুষ এবং সমস্ত কিছু আল্লাহর হুকুমে সৃষ্টি হয়েছে।

খ্রিস্টধর্ম: খ্রিস্টধর্মেও সৃষ্টির বর্ণনা রয়েছে। বাইবেলে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বর (আল্লাহ) পৃথিবী এবং সমস্ত পৃথিবীজগত ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন এবং সপ্তম দিনে বিশ্রাম নিয়েছেন।

বৌদ্ধধর্ম: বৌদ্ধধর্মে সৃষ্টির ধারণা কিছুটা ভিন্ন, কারণ তারা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। তবে তাদের মতে, এই মহাবিশ্ব অস্থির এবং চক্রাকারে সৃষ্টির এবং ধ্বংসের মধ্যে আবর্তিত হয়।

দার্শনিক দৃষ্টিকোণ: দার্শনিকরা সৃষ্টি এবং সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে নানা মত প্রকাশ করেছেন। অনেকেই মনে করেন যে, সৃষ্টি কোনো অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য বা জ্ঞান বা প্রজ্ঞার প্রকাশ।

প্লেটো: প্লেটো বিশ্বকে এক মহান পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেখেছিলেন, যা একটি ঐশ্বরিক বা আদর্শ পরিকল্পনা অনুসারে চলে।

হেগেল: হেগেল বিশ্বকে আত্মসাধনার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেছিলেন, যেখানে ইতিহাস, সমাজ এবং মানুষের জীবনের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর বা আদর্শ আত্মা নিজের পূর্ণতা অর্জন করে।

শঙ্করাচার্য: শঙ্করাচার্য, হিন্দু আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে সৃষ্টি এবং সংসারের কল্পনা করেন মায়া (অস্তিত্বের ভ্রম) হিসেবে, যার প্রকৃত বাস্তবতা একমাত্র ব্রহ্ম (ঈশ্বর)।

সৃষ্টির সংজ্ঞার সারাংশ: সৃষ্টি বলতে সেই প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয় যার মাধ্যমে পৃথিবী, মহাবিশ্ব, প্রাণী, উদ্ভিদ এবং সমস্ত বস্তু ও শক্তি গঠিত হয়। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে পৃথিবী ও মহাবিশ্বের শুরুর দিকে বিস্ফোরণ এবং বিভিন্ন পদার্থের বিকাশের প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করা হলেও, আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা বা শক্তির প্রকাশ হিসেবে দেখা হয়।

সৃষ্টি মানুষের জন্য একটি জিজ্ঞাসা, একটি অধ্যয়ন এবং নিজের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করার জন্য এক চিরন্তন অন্বেষণ।

– ফরহাদ ইবনে রেহান
২৩/০১/২০২৫

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel