অস্তিত্বের অন্তর্নিহিত সুর
যে শক্তি আমাদের সকলের মধ্যে সঞ্চলিত, যে জীবনধারা অদৃশ্য কিন্তু অপরিসীম, অদেখা কিন্তু সর্বব্যাপী, তা কখনো হারায় না। এই শক্তি, যা শাশ্বত এবং অপরিবর্তনীয়, আমাদের সকলের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকলেও সে কখনো আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। এটি অস্তিত্বের গভীরে সর্বত্র বিরাজমান, এবং তার অনুপস্থিতি বা উপস্থিতি কেবলমাত্র আমাদের দৃষ্টির সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ। আমরা এই শক্তিকে দেখতে পাই না, কারণ তা আমাদের ধারণার বাইরে চলে গেছে, কিন্তু এর উপস্থিতি প্রতিটি সত্ত্বায় নির্দ্বিধায় অনুভূত।
এই শক্তির মধ্যেই রয়েছে সৃষ্টির গতিশীলতা। তার অদৃশ্যতার মধ্যে কেবল ক্রিয়া আর প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। জীবন এবং মৃত্যু, আনন্দ ও বেদনা, প্রেম এবং নৈরাশ্য—এই সমস্ত কিছুই তার অন্তর্গত। এই শক্তি হলো স্রষ্টার সঞ্চালন, যার মধ্যে সমগ্র বিশ্ব একসাথে বোনা হয়েছে এবং যে স্রষ্টা কোনকিছুই কখনো বিচ্ছিন্ন রাখেন না। প্রকৃতপক্ষে, আমরা যা কিছু দেখি, শুনি, অনুভব করি—সবই এই এক শক্তির বিচ্ছুরণ, তার নিজস্ব রূপান্তর। প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি চিন্তা, প্রতিটি ক্রিয়া—এগুলো শুধুমাত্র তার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা গোপনে প্রতিটি মুহূর্তে তাকে প্রকাশিত করে।
আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানে, আমরা যখন এই শক্তির গভীরতার দিকে মনোনিবেশ করি, তখন আমরা অনুভব করি যে, এই শক্তি আমাদের থেকেই উদ্ভূত। আমরা এটিকে বাইরে কোথাও খুঁজে পাব না, কারণ এর বাস্তবতা শুধু বাইরের নয়, বরং আমাদের ভিতরেও রয়েছে। যখন আমরা নিজের আত্মার গভীরে অবগাহন করি, তখন আমরা বুঝতে পারি যে, এই এক শক্তি কখনোই আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি—এটা আমাদের প্রতিটি রক্তবিন্দু, প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি অনুভূতির মধ্যে সমানভাবে বাস করে।
আমরা এতোদিন আমাদের বোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলাম, কিন্তু যখন এই শক্তির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করি, তখন আমাদের জ্ঞান এবং উপলব্ধি নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করে। সেই মুহূর্তে, যা আমরা আগে অনুভব করতে পারিনি, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে—আমরা বুঝতে পারি যে, আমাদের সকল পরিশ্রম, আমাদের সত্তার যে সংগ্রাম, তা শুধু আমাদের নিজস্ব অর্জন নয়, বরং এই এক শক্তির সংযোগের একটি অঙ্গ। যখন আমরা আমাদের আত্মাকে গভীরভাবে চিনি, তখন আমরা উপলব্ধি করি যে, সেই এক শক্তি আমাদেরই মধ্যে রয়েছে—আমাদের অস্তিত্বের মূল সত্তা।
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন জ্ঞান নয়, বরং এক ঐক্যবদ্ধ অভিজ্ঞতা। যে ব্যক্তির কাছে এই এক শক্তির সাড়া মেলে, সে তো শুধু সাধক নয়, বরং সেই মানুষ যে মানবতা, প্রকৃতি এবং সৃষ্টির মাঝে একটি অদৃশ্য সেতু তৈরি করে। সে জানে, সে উপলব্ধি করে যে, এই এক শক্তি তার থেকে দূরে নয়, বরং তার নিজস্ব জীবনের সঙ্গী, সহযাত্রী, এবং স্রষ্টা।
এটি সেই অভ্যন্তরীণ সুর, যা সমগ্র জীবনের হৃদয়ে বেজে ওঠে। এটি সেই একক ধ্বনি, যা পৃথিবী, আকাশ, নদী, পাহাড়—সবকিছুতে প্রতিধ্বনিত হয়। আমরা যখন এভাবে শুনি, তখন আমরা বুঝতে পারি, জীবনের পুরো মন্ত্রের মধ্যে কোনো বিভাজন নেই—এটি এক মহাশক্তির সুর, যা কোনো সীমা জানে না। সেই এক সুরের মধ্যে, আমরা সবাই একে অপরকে খুঁজে পাই, এবং সেই এক শক্তির মধ্যে, আমরা সবাই একে অপরের প্রতিফলন।
এই শক্তি তখনই আমাদের আত্মার সত্যি সঙ্গী হয়ে ওঠে, যখন আমরা এই পৃথিবীকে শুধু বস্তুগত অবস্থায় না, বরং তার অন্তর্নিহিত শক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শুরু করি। সেই মুহূর্তে, আমরা উপলব্ধি করি যে, যা কিছু ঘটছে—তাহলে তা শুধু আমাদের জীবন নয়, বরং পুরো সৃষ্টির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এবং সেখান থেকেই জন্ম নেয় ঐক্য, শান্তি, এবং গভীর প্রেম—যার অস্তিত্ব সত্যিই স্রষ্টার সঙ্গে একাত্ম।
—ফরহাদ ইবনে রেহান
০৪/০৩/২০২৫ইং