নারীর ঋতুস্রাব ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
প্রাকৃতিকভাবে বাহ্যিক কোনো কারন ছাড়াই একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ের গর্ভাশয় হতে প্রতি মাসে যে রক্ত নির্গত হয়, তাকেই হায়েছ বা মাসিক ঋতুস্রাব বলে। (ইসলামী ফিকহের শাস্ত্রের আলোকে সংজ্ঞা দিলাম, কারন আমাদের সমাজে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের প্রাপ্ত বয়স্ক বলা হয় না, কিন্তু হায়েস সাধারনর ১২ বছর বয়স থেকেই শুরু হয়)।
পিরিয়ড সম্পর্কে জানেনা এমন কোনো ছেলে খুঁজে পাওয়া যাবে না বর্তমানে যার বয়স ১৫ এর বেশি। কোনো কোনো ছেলে হয়তো উপহাস আর উন্মাদিত বাক্যে আলোচনা করেছে বহুবার এই বিষয়ে বন্ধুদের সাথে। কেউবা আবার নাপাক নাপাক বলে নাক ছিটকিয়েছে। শুধু ছেলেরাই নয়, একদল সংকীর্ণমনা মেয়েরাও অন্য মেয়ের এই বিষয় টা নিয়ে করেছে নানা ধরনের অরুচিকর বাক্যালাপ।
সৃষ্টিকর্তা নারী ও পুরুষকে সৃষ্টি করেছেন কিছু আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যে। তারমধ্যে অন্যতম একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য হল পিরিয়ড বা মাসিক ঋতুস্রাব (হায়েছ)। একজন নারীর জন্য এটা শারীরিক সব রকম রোগের চেয়েও স্বাভাবিক বিষয়। আর এটা না হওয়াই অস্বাভাবিক ও ভয়ংকর বিষয়। কারন যে নারীর হায়েজ বন্ধ হয়ে যায়, সে আর মা হওয়ার অর্থাৎ সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। তাই সহজেই এর মহত্ব ও গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। আর একজন সন্তান যখন কোনো নারীর গর্ভে আসে, তখন এই রক্ত একটি নালীর মাধ্যমে সন্তানের নাভীর সাথে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়, তখন এই রক্ত বাইরে না এসে সন্তানের দেহ গঠনের জন্য সন্তানের দেহে মিশে যায়। তাই সন্তান গর্ভে আসলে নারীদের হায়েস বন্ধ হয়ে যায়। যারা ইসলামী শরীয়ত সম্পর্কে জানেন, তারা হয়তো জানেন যে, তালাক প্রাপ্ত স্ত্রীর ইদ্দত হলো ৪ মাস ১০ দিন (তিন কুরু)। এটা মূলত হায়েজের জন্যই।
বিষয় টা খুব স্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও একদল নোংরা মনের পুরুষরা এমনকি কিছু নারীরা নিজেও এই বিষয়টাকে খুব বাজে ভাবে বিচার করে। কিন্তু কেন? কারনটা আমি সত্যিই জানি না। তবে যতটুকু বুঝি এইসব মানুষের মন মানসিকতা বিচার করে, তাতে আমি ৩ টা কারন খুঁজে পাই।
প্রথম কারন হলো নারীর এই রক্ত প্রবাহিত হয় তাঁর যোনী দিয়ে, তাই এইসব মানুষের এই বাজে চিন্তা ভাবনা। দ্বিতীয় কারন থাকতে পারে, সেটা হলো এটাকে পুরুষের স্বপ্নদোষের সাথে তুলনা করে। যেহেতু স্বপ্নদোষ বাজে চিন্তার ফল (যদিও এমনিতেও হয়) এবং লজ্জার কিছুটা, তাই হায়েসকেও লজ্জার মনে করা হয়। আর তৃতীয় ও প্রধান কারন হতে পারে ধর্মীয় কারন। যেহেতু আমি মুসলিম পরিবারের ছেলে ও লিস্টের বেশির ভাগই মুসলিম, তাই ইসলামী বিষয়টা নিয়েই আলোচনা করতে চাই। ইসলাম ধর্মে এই রক্তকে নাপাকী বলে ঘোষনা করা হয়েছে স্পষ্ট ভাবেই। তাই হয়তো অনেক ধার্মিক ভাইয়েরা এটাকে ঘৃণা করে, এমনকি ধার্মিক বোনেরাও (যাদের ধর্ম জ্ঞান কম, তবুও ধার্মিক)।
আমি এই তিনটা দিক নিয়েই আলোচনা করব আজ।
প্রথম কারনঃ যৌনাঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার কারনে হায়েছকে লজ্জার ও ঘৃণার ভাবার কোনো মানেই হয় না। কারন একজন মেয়ে প্রকাশ্যেই সবার সামনে দিয়ে টয়লেটে প্রবেশ করে। সেটাকে কেউ খারাপ বলে না। পেশাব পায়খানা হওয়ার জন্য কোনো নারীকে লজ্জা পেতে হয় না। তাহলে হায়েছকে কেন খারাপ বলা হবে!!! একজন মা যখন সন্তান প্রসব করে, এটা সবাই জানে। কিন্তু তখন ত কেউ খারাপ মন্তব্য করে না, সন্তান ত যোনীদ্বার দিয়েই প্রসব হয়। তাহলে হায়েসকে কেন ঘৃণা করা হবে! আপনি যখন আপনার মায়ের গর্ভে ছিলেন, তখন এই রক্ত দিয়েই আপনার দেহ গঠন করা হয়েছিল। আপনি ত আপনার মায়ের এই রক্ত খেয়েই মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছেন। তাহলে কেন এটাকে ঘৃণার চোখে দেখেন! যে সমস্যা (কিছু মানুষের দৃষ্টিতে) আপনার জন্মদাত্রী জননীর মাঝেও ছিল, আগামীতে আপনার কন্যারও হবে, সেই বিষয়টা যখন অন্য নারীর বেলায় হচ্ছে, তখন আপনি বাজে ভাবে নিচ্ছেন কেন! এটাকে এতো ঘৃনা করেন, নারীকে এটার জন্য লজ্জা দেন।
একবারও ভেবে দেখেছেন আগামীতে যখন শুনবেন আপনার স্ত্রীর পিরিয়ড না হওয়ার কারনে আপনি জীবনে বাবা হতে পারবেন না, তখন আপনার অনুভতি কেমন হবে? যখন শুনবেন আপনার মেয়ের পিরিয়ড বন্ধের কারনে সে বন্ধ্যা হওয়ার কারনে আপনার মেয়ের জামাই আপনার মেয়েকে তালাক দিয়ে আপনার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে, তখন কেমন লাগবে আপনার? যখন শুনবেন আপনার বোনের এই ঘৃন্য ঘটনা না হওয়ার কারনে আপনি মামা হতে পারবেন না, আপনার বোনের জামাই বাবা হওয়ার আসায় অন্য মেয়েকে বিয়ে করবে, আর আপনার বোন আপনার কাছে এসে তাঁর কষ্টের কথা জানাবে, তখন আপনার মনের অবস্থা কেমন হবে? ভেবে দেখেছেন একবারও এগুলো! না, ভাবেননি আপনি। ভাবলে কখনো পিরিয়ডকে ও নারীকে ঘৃণা করতে পারতেন না।
আপনার মা, বোন, মেয়েরও এটা হচ্ছে। তবুও কেন অন্য নারীর বেলায় আপনার এই ভিন্ন ভাবনা? আপনার এরূপ মন মানসিকতার কারনেই আপনার বোন, স্ত্রী, মেয়ে লাঞ্চিত হচ্ছে অন্য পুরুষদের দ্বারা। তারা তাদের সমস্যার কথা আপনার সাথে শেয়ার করতে পারছে না, যদিও আপনি তাদের খুব আপন। কেন পারছে না জানেন! কারন আপনি পুরুষ। অথচ বিষয় টা এমন হওয়া উচিত ছিল না। হওয়া উচিত ছিল তারা তাদের এই সমস্যার সময় গুলোতে তাদের সমস্যার কথা গুলো আপনাকে জানানো। মেয়ে বা বোন ফার্মেসীর দোকানী প্যাড বা ন্যাপকিন কিনতে গিয়ে লজ্জিত না হয়ে উচিত ছিল আপনাকে দিয়ে সেটা আনিয়ে নেওয়া। কিন্তু আপনার মন মানসিকতার জন্য তারা বাইরে লজ্জিত হচ্ছে, তবুও সেটা আপনাকে জানাতে পারছে না যদিও আপনি তাদের আপনেরও আপন।
দ্বিতীয় কারনঃ ছেলেদের স্বপ্ন দোষের মত ঋতুস্রাব নয়। এটার সাথে পিরিয়ডের তুলনা করা বোকামী। কারন যতটুকু জানি স্বপ্নদোষ মেয়েদেরও হয়। গ্রামাঞ্চলের মানুষ সম্ভাবত এটাকেই ‘কষা ভাঙ্গা’ বলে থাকে। তাছাড়া এমনিতেও হায়েছের সাথে পুরুষদের স্বপ্নদোষের তুলনা করা আহাম্মকী। কারন স্বপ্ন দোষ হয় সেসব ছেলেদেরই বেশি, যারা কুভাবনায় মত্ত্ব থাকে বেশি। রাত ভরে পর্ণ ফিল্ম দেখার পর ভোরে ঘুমাইলে এমন টা হওয়াই স্বাভাবিক। আর তা না হোক, এটা হওয়ার সময় স্বপ্নে সেইরকম জোস স্বপ্নই ছেলেরা দেখে (কোন রকম স্বপ্ন, তা কইলাম না, বিষয় টা কিছুটা লজ্জারই বটে। কিন্তু এতে ত কোনো ছেলের কষ্ট হইছে বলে শুনি নাই আমি। যদিও এইসব কিছু সমস্যার জন্য কলিকাতা হারবাল এর সংখ্যা দিনকে দিন বেড়েই চলছে। কারন ছেলেদের কুভাবনা ও কুকর্ম (হস্তমৈথন ত আছেই)।
কেউ বা বীর্য বের হওয়ার সাথেও তুলনা করতে মেয়েদের এই রক্তের সাথে। আরে ভাই আপনাকে বলছি;
আপনার মত পর্ন ফিল্ম দেইখা ইচ্ছা করে বীর্যপাত করে ক্ষনিকের আনন্দ উপভোগের মত একজন নারী তার ঋতুস্রাব ঘটায় না। এটা প্রাকৃতিক। এটা তাঁর মা হওয়ার যোগ্যতার প্রমান বহন করে। আপনার বীর্যপাতের আনন্দের মত এই সময় মেয়েরা আনন্দ পায় না, বরং তাদের অনেককেই সহ্য করতে হয় সীমাহীন শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রনা। কারন একটায়, সেটা হল আগামীতে সে আপনার মত কাউকে গর্ভে ধারন করবে, দেখাবে এই সুন্দর পৃথিবী। আপনি হয়তো জানেনই না যে, আপনার মা, বোন,মেয়েও এই যন্ত্রনায় ভোগে। কিন্তু তারা আপনার সামনে হাসি মুখেই থাকে এই কষ্টের সময়টাতে। কারন আপনি একজন পুরুষ এবং আপনার হীন মনমানসিকতা।
তৃতীয় কারনঃ ইসলামে ধর্মে হায়েসকে নাপাক বলা হয়েছে। এই জন্যও অনেকেই এটাকে লজ্জার ও ঘৃণার বিষয় মনে করে। আর নাস্তিকদের মধ্যে অনেকেই এই মর্যাদাপূর্ণ রক্তকে নাপাক ঘোষনা করার কারনে ইসলাম ধর্মের এই শরীয়ত নিয়ে বাজে মন্তব্য করে। বিষয় টা নিয়ে ধর্মে বিশ্বাসী আস্তিক এবং নাস্তিকরা উভয়েই ভুল বুঝতেছে। বিষয় টা এরকম নয়, যেরকম আপনারা ভাবছেন।
আপনাদের জানা থাকার কথা যে অযু ভঙ্গের ৭ টা কারনের মধ্যে একটা হলো রক্ত বের হয়ে গড়িয়ে পরা।অর্থাৎ মানুষের গায়ের রক্তও নাপাক, যখন সেটা দেহ থেকে বের হয়ে যায়। হোক সেটা পুরুষের রক্ত বা নারীর। সুতরাং স্পষ্ট ভাবেই বুঝা যায় যে, হায়েছের রক্ত বলেই এই রক্ত নাপাক নয়, বরং রক্ত দেহ থেকে বের হয়ে যায় বলেই এটা নাপাক। যোনীদ্বার দিয়ে বের হওয়ার জন্য নয়, এই রক্ত মুখ দিয়ে বের হলেও নাপাকই বলা হতো।
আল্লাহর কাছে মানুষের শরীরের কোনো অঙ্গই অশ্লীল, খারাপ বা ঘৃণ্য নয়। পরনারীর কোমরে হাত হাত লাগালেও সেটা অশ্লীল, পরনারীর হাত ধরলেও সেটা অশ্লীল। অশ্লীলতার জন্য যৌনাঙ্গই মূখ্য বিষয় নয়। আবার স্ত্রীর সাথে যৌন মিলনকেও পূন্যের কাজ বলা হয়েছে ইসলাম ধর্মে। সুতরাং অঙ্গের বিষয় টা নিয়ে যারা মন্তব্য করছে, তারা অজ্ঞতার পরিচয় দিচ্ছে।
বুঝানোর জন্য আরেকটু পরিস্কার উদারহন দেওয়ার চেষ্টা করছি:
ইসলামী জিহাদের সময় যখন একজন যোদ্ধার শরীর থেকে রক্ত বের হতো তরবারীর আঘাতে, তখনও তাকে তা পরিস্কার করে অযু করে নামাজ আদায় করতে হতো। কারন তখনও সেটা নাপাক। কিন্তু যোদ্ধার গায়ের রক্ত ঘৃন্য নয়। আরো পরিস্কার করে বলতে গেলে একমাত্র শহীদের গায়ের রক্ত ব্যতীত সবার রক্তই বের হয়ে যাওয়ার পর নাপাক। শুধু মাত্র শহীদদের গোসল করানো হয় না। তবে যারা যুদ্ধে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর ইন্তিকাল করে, তাদেরকে গোসল দিতে হয়। যাদেরকে ইসলামী শরীয়তের ভাষায় শহীদ না বলে ‘মুরতাছ’ বলা হয় (অধিকাংশ মুসলিমরাই এটা জানে না)। কারন তাদের গায়ের রক্তও বের হয়ে যাওয়ার পর নাপাক। তবে তা কখনোই ঘৃণ্য নয়,বরং মর্যাদাপূর্ণ। এটা আপনাদের সহজেই বুঝার কথা। ঠিক অনুরূপ ভাবে নারীর হায়েছের রক্তও নাপাক, কিন্তু ঘৃণ্য নয়, বরং মর্যাদাপূর্ণ।
হায়েজ চলাকালীন সময় অনেক অল্প জ্ঞানী ধার্মিক ভাইয়েরাই এমনকি বোনেরাও নারীদের অপবিত্র বলে মনে করে থাকে। এটা একদমই ভুল। রাসূল (স) স্পষ্ট ভাবেই বলেছেন যে “বিশ্বাসীরা (মুমিন) কখনো নাপাক হয় না”। মূলত এই রক্তটা নাপাক। তাই এটাকে নারীদের নাপাকী অবস্থা বলে। তারমানে এই নয় যে নারীর শরীরও তখন নাপাক হয়ে যায়। অনেকেই পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ২২২ নং আয়াতের দ্বারা এই অবস্থায় একজন নারীকে অপবিত্র মনে করে থাকে, আয়াতটি হল..
وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الْمَحِيضِ ۖ قُلْ هُوَ أَذًى فَاعْتَزِلُوا النِّسَاءَ فِي الْمَحِيضِ ۖ وَلَا تَقْرَبُوهُنَّ حَتَّىٰ يَطْهُرْنَ ۖ فَإِذَا تَطَهَّرْنَ فَأْتُوهُنَّ مِنْ حَيْثُ أَمَرَكُمُ اللَّهُ ۚ
অর্থঃ ‘আর তারা তোমাকে (স্ত্রীলোকদের) ঋতু সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছে; তুমি বলঃ ওটা হচ্ছে ‘আযা'( কষ্টদায়ক)। অতএব ঋতুকালে স্ত্রীলোকদেরকে অন্তরাল কর এবং উত্তম রূপে শুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত তাদের নিকটে যেওনা; অতঃপর যখন তারা পবিত্র হবে তখন আল্লাহর নির্দেশ মত তোমরা তাদের নিকট গমন (যৌন মিলন) কর।’
এই আয়াতে ‘আযা’ শব্দের অর্থ আমাদের দেশের অধিকাংশ সুশিক্ষা ও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত কাঠ মোল্লারা করেছে ‘অপবিত্রতা’। অথচ এর অর্থ হচ্ছে ‘কষ্টদায়ক’। এসব আলেমদের জন্যই ইসলাম লজ্জিত হচ্ছে অনেকের কাছে। অনেক বোনও হয়তো মনে মনে কষ্ট পেয়েছে আল্লাহর প্রতি (তওবা করে নিবেন এমনটা ভেবে থাকলে)। কিন্তু স্রষ্টা তো এই অবস্থায় বোনদের অপবিত্র বলেন নাই, বলেছেন এটা আপনার জন্য কষ্টদায়ক। আপনার স্রষ্টা বর্তমান পুরুষ ও ধার্মিকদের মত অবিবেচক নন।
তাছাড়া এই অবস্থায় মেয়েদের কষ্টের জন্য তাদের নামাজকে মাফ করে দেওয়া হয়েছে। নামাজের কাযাও আদায় করতে হয় না।এটা অপবিত্রতার জন্য নয়, কারন ইসতেহাজা মেয়েদের (যাদের হায়েজের সমসসীমা ১০ দিনের উপরে চলে যায়, হানাফী মাজহাব মতে) উপর নামাজ ফরয। তবে বিনা কারনে মসজিদে প্রবেশ ও কুরআন স্পর্শ করা নিষেধ। আর এই সময় রোজা রাখা কষ্ট বিধায় রোজা রাখাও নিষেধ,তবে আগামীতে রোজা আদায় করে দিতে হয় সুবিধা মত। এই বিষয়টাও গুরুত্ব পূর্ণ। অন্য পুরুষদের কথা ত বাদই দিলাম, নিজের পিতা ও আপন ভাইও এই বিষয় টা বুঝে না, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই সময়ও রোজার মাসে মেয়েদের না খেয়ে কষ্ট করতে হয় বাপ ভাইদের নিচু মনমানসিকতার কারনে। পুরুষদের লজ্জা হওয়া উচিত এখানে। অথচ এসময়টায় আপনার উচিত তাদের বেশি কেয়ার করা, যাতে তারা মানসিকভাবে ভেংগে না পরে। এবিষয়টা নিয়ে গত রমজানে আমার দুইটা পোস্ট ছিল।
মুসলিম শরীফে বর্নিত একটি হাদীসের ভাবার্থ হল.. জাহেলী যুগে পুরুষরা ঋতুকালীন সময় মেয়েদেরকে অপবিত্র মনে করতে, তারা এই অবস্থায় স্ত্রীর হাতের কিছু খেতো না, তাদের সাথে শয়নও করতো না। এমনকি ঘর থেকে বেরও করে দিতো। এই কথা সাহাবীরা রাসূল (স) কে জানালে তিনি বললেন যে, মুসলিম পুরুষরা যেন এরূপ না করে।
একটি হাদিস উপস্থাপন করছি ঋতুকালীন সময়ে নারীর অবস্থা নিয়ে ইসলাম কি বলে;
ﺍﺻْﻨَﻌُﻮﺍ ﻛُﻞَّ ﺷَﻲْﺀٍ ﺇِﻻ ﺍﻟﻨِّﻜَﺎﺡَ
অর্থঃ “সহবাস ব্যতীত তার সাথে সবকিছু কর।” (মুসলিম :৩০২)
অন্য আরেকটি হাদিসে পাওয়া যায়;
ﻋَﻦْ ﻋَﺎﺋِﺸَﺔَ – ﺭﺿﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻬﺎ – ﻗَﺎﻟَﺖْ ﻛُﻨْﺖُ ﺃَﺷْﺮَﺏُ ﻭَﺃَﻧَﺎ ﺣَﺎﺋِﺾٌ ﻭَﺃُﻧَﺎﻭِﻟُﻪُ ﺍﻟﻨَّﺒِﻰَّ – ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ – ﻓَﻴَﻀَﻊُ ﻓَﺎﻩُ ﻋَﻠَﻰ ﻣَﻮْﺿِﻊِ ﻓِﻰَّ ﻓَﻴَﺸْﺮَﺏُ ﻭَﺃَﺗَﻌَﺮَّﻕُ ﺍﻟْﻌَﺮْﻕَ ﻭَﺃَﻧَﺎ ﺣَﺎﺋِﺾٌ ﻭَﺃُﻧَﺎﻭِﻟُﻪُ ﺍﻟﻨَّﺒِﻰَّ – ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ – ﻓَﻴَﻀَﻊُ ﻓَﺎﻩُ ﻋَﻠَﻰ ﻣَﻮْﺿِﻊِ ﻓِﻰَّ .
অর্থঃ হযরত আয়েশা (রা) থেকে বর্নিত।তিনি বলেন “আমি পিরিয়ড অবস্থায় পনি পান করতাম এবং পানির পাত্রটা রাসূলের দিকে এগিয়ে দিতাম। তিনি পানির পাত্রে সে জায়গায় মুখ লাগিয়ে পানি পান করতেন যে জায়গায় মুখ লাগিয়ে আমি পানি পান করেছি। আমি পিরিয়ড অবস্থায় হাড্ডি থেকে গোশত ছিড়ে খেতাম অত:পর তা রাসূলকে দিতাম তিনি সেখানে মুখ লাগিয়ে গোশত ছিড়তেন যেখানে মুখ লাগিয়ে আমি গোশত ছিড়েছি।” (মুসলিম- ৭১৮)
যা ই হোক, এব্যাপারে অগনিত হাদিস রয়েছে।
সুতরাং আমি বলতে চাই পিরিয়ড কোনো অস্বাভাবিক ও ঘৃন্য বিষয় নয়, না তেমন কোনো গোপনীয় বিষয়। তবে হ্যা একটা বিষয় লক্ষা রাখবেন, এই অবস্থায় আপনার মেয়ে হয়তো ব্যথার কারনে বা অন্যকারনেও হোক শুয়ে আছে অসময়ে, আছে মনমরা হয়ে, আপনিই হয়তো বাবা হয়ে তখন তাকে শাসন করছেন, ধমক দিচ্ছেন এই শুয়ে থাকা ও আনমনার জন্য। আবার হয়তো পরীক্ষার জন্য পড়ার চাপ দিচ্ছেন বা অন্য কোনো কাজ চাপিয়ে দিচ্ছেন। আপনি বড় ভাই হয়ে হয়তো বোনকে তখন ধমক দিচ্ছেন পড়ার জন্য বা অন্য কোনো কাজের জন্য, অথচ সে পিরিয়ডের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছে।
এটা তাকে আরো বেশি কষ্ট দিবে, কারন আপন মানুষ গুলোই যখন সমস্যা না বুঝে উল্টো তারা নিজেরাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, তখন একটি মেয়ে এমনিতেই মানসিকভাবে ভেংগে পরে। আপনি আপনার মেয়ের ও বোনের কষ্টটা বুঝার চেষ্টা করুন। আপনার জন্য এর চেয়ে বড় লজ্জার বিষয় আর কি হতে পারে যে, আপনি পিতা বা ভাই হয়ে নিজের কন্যা বা বোনের এই সময়টায় তাকে সহযোগীতা না করে বরং তার কষ্টের কারন হলেন, আর গোপনে অভিশপ্ত হলেন নিজের মেয়ে বা বোন কর্তৃক।কারন মেয়েদের কাছে দুনিয়ার সব পুরুষরা খারাপ হলেও ‘বাবা’ আর ‘ভাই’ কখনো খারাপ হয় না। একজন ভাল পুরুষ হিসেবে তাদের এই বিশ্বাস ও ভালবাসার অমর্যাদা করা উচিত নয়।
তবে আরেকটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই যেটা হল মেয়েরা তাদের এই পিরিয়ড চলাকালীন সময় সেটা উম্মুক্তভাবে সকল পুরুষদের সাথে শেয়ার করবে কি না করবে। আমার মতে কোনো মেয়েরই উচিত হবে না এই পিরিয়ড চলাকালীন অবস্থায় সবার সাথে সেটা শেয়ার করা। তাদের সাথেই সমস্যা শেয়ার করা উচিত, যারা সমস্যাটা বুঝবে। আর আপন মানুষ ছাড়া কেউ কারো সমস্যা অনুধাবন করতে পারে না, সেটা যত সাধারণ সমস্যাই হোক। তাই আপনজনদের সাথেই শুধু এই ধরনের সমস্যাগুলো শেয়ার করা উচিত, সেটা কোনো পুরুষের কাছে হোক বা মেয়ের কাছে হোক।তবে কিছু মেয়ে ত থাকা উচিতই অন্য সবাইকে সচেতন করার জন্য। সবাই ঘুমিয়ে থাকলে জাগিয়ে তুলবে কে! তাই কোনো মেয়ে যদি তাদের নিজেদের এই সমস্যার কথা সবার সামনে তুলে ধরে সবাইকে সচেতন করার জন্য, তাহলে অবশ্যই তাকে খারাপ বলা যাবে না।
বিঃদ্রঃ এই বিষয় টা নিয়ে গত রমজানে আমার পেইজ ও ফেইক আইডি থেকে দুইটা পোস্ট দিয়েছিলাম। ইদানীং বিষয় টা নিয়ে একটু বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করে দিয়েছে অনেকেই। পক্ষে আর বিপক্ষেও অনেক লেখালাখি হইছে, বিপক্ষের ভাই বোনেরা মূলত বাড়াবাড়িটা বেশি করে ফেলছে। ভাই আপনি যে পোস্টের বিরোধীতা করছেন, আপনার মা হয়তো ফেইসবুকে থাকলে সেই পোস্ট গুলো নিজের টাইমলাইনে শেয়ার করত। আর যদি জানতো আপনি এর বিপক্ষে বাজে মন্তব্য করেন, তাহলে হয়তো নিজের গর্ব ধারন করাকেই নিজের জন্য অভিশপ্ত মনে করত। সেই জন্যই এই পোস্ট টা দিলাম সবার পোস্টের মন্তব্য স্বরূপ। এটা নিয়ে আগামীতে নতুন করে কিছু লেখার আগ্রহ নাই। আর হ্যা, পোস্টটা শুধু মাত্র পুরুষ জাতির উদ্দেশ্যে। আর যার খুশী কপি করে নিজে পোস্ট করতে পারেন আমার নাম উল্লেখ না করেই।
পোস্ট টা সমস্ত নারীদের জন্য উৎসর্গ করলাম।।
– DM Rahat