সমাজে হতাশাগ্রস্ততা বৃদ্ধির কারণ।
মানুষ হিসেবে আমাদের টিকে থাকার জন্য অনেক কিছুর প্রয়োজন হয় যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এর মধ্যে প্রধান। বর্তমান উন্নত সমাজব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদের আরও কিছু চাহিদা তৈরি হয়েছে যার গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে আমাদের চাহিদা বা দৈনন্দিন প্রয়োজন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা চারদিকে ছোটাছুটি করছি লাগামহীন বিভিন্ন চাহিদা নিয়ে। এটা যেন শেষ হবার নয়! এই অগোছালো ছোটাছুটি আমাদের জীবনকে শৃংখলাহীন করে তুলছে। নিজের চাহিদা পূরনের সার্থে আমরা করনীয় অকরনীয় সবকিছুই করছি যার ফলে সমাজে তৈরি হচ্ছে অরাজকতা এর মূল বা প্রধান কারণ হচ্ছে আমরা আমাদের জীবনে টিকে থাকার জন্য ও সুস্থ সুন্দর জীবনযাপনের জন্য কি দরকার ও কতটুকু দরকার তা নির্ধারন করতে পারছি না।
আমরা মনে করছি আমাদের অনেক কিছু দরকার এবং তা প্রচুর পরিমানে দরকার। আসলে যখন আমরা এরকমটা ভাবি যে আমাদের অনেক কিছু দরকার এবং প্রচুর পরিমানে দরকার তখন এই চাহিদা শেষ হবার নয়। যদি অনেক কিছু প্রচুর পরিমানে হাতে এসেও যায় তবে আবার নতুন করে নতুন চাহিদা জন্ম নেবে। মৃত্যু অতি নিকটে এবং এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যদি আমাদের চাহিদাই শেষ না হয় তবে আমাদের মৃত্যুটা হবে অতৃপ্ত অবস্থায়। একটু গভীর ভাবে ভেবে দেখুনত আপনি যেটাকে প্রয়োজন ভেবে দৌড়াচ্ছেন সেটা পেয়ে গেলে কি আপনার প্রয়োজন শেষ? নাকি আবার আপনার নতুন চাহিদার জন্ম নেবে? যদি আবার নতুন চাহিদার জন্ম নেয় তাহলে আপনি যেটাকে প্রয়োজন ভাবছেন সেটা আসলে কোনো প্রয়োজনই না।
আপনি আপনার মস্তিষ্কে কৃত্রিম ভাবে চাহিদা তৈরি করছেন এবং তার পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছেন। কৃত্রিম চাহিদা তৈরির এই প্রক্রিয়া বন্ধ না করলে আমাদের চাহিদা কোনো কালেই শেষ হবার নয় বরং এটা আমাদের মৃত্যু পর্যন্ত খালি হাতে নিয়ে যাবে। সুতরাং আমাদের উচিত সুস্থ ও সুন্দর ভাবে টিকে থাকার জন্য আমাদের কি প্রয়োজন এবং তা কতটুকু হলে যথেষ্ট তা নির্ধারন করা। বসবাস করার জন্য বসবাস উপযুক্ত একটা বাসস্থান, খুদা নিবারনের জন্য যথেষ্ট খাদ্য, শরীর আবৃত করার জন্য যথেষ্ট পোশাক এবং সুশিক্ষা একটা পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রব্যাবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট।
আধুনিক সমাজ ব্যাবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে আপনার নতুন কিছু প্রয়োজন তৈরি হতে পারে যেটার গুরুত্ব আছে। কিন্তু সব জায়গায় আপনার যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। কোনো কিছুকে চাহিদা হিসেবে নেওয়ার আগে গভীর ভাবে ভাবতে হবে প্রকৃত অর্থে এটা আপনার চাহিদা কি না,নাকি আপনার মস্তিষ্ক কৃত্রিম ভাবে এটাকে চাহিদা হিসেবে উপস্থাপন করছে। কৃত্রিম ভাবে তৈরি চাহিদাকে মাথা থেকে মুছে ফেলতে হবে। কাজটা একটু কঠিন হলেও সময় নিয়ে করতে হবে। আর যদি প্রকৃতঅর্থে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও শিক্ষার মত অন্য কোনো চাহিদাও আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয় তবে আপনার নির্ধারন করতে হবে তা আপনার জন্য কতটুকু প্রয়োজন তথা কতটুকু হলে আপনি এটাকে আপনার কাজে লাগাতে পারেন। এটা মাথায় রাখতে হবে অতিরিক্ত কোনো কিছুই আপনার সুস্থ সুন্দর জীবনযাপনে সহায়ক নয়।
তাই কোনো চাহিদাকেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত হিসেবে নেওয়ার যাবে না। মনে রাখতে হবে মৃত্যু হচ্ছে মানব জীবনের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। অনেক কিছু করেও প্রকৃত বাস্তবতাকে ভুলে গেলে শেষে সেই অনেক কিছুই চরম হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুস্থ সুন্দর জীবনযাপনে সহায়ক সবকিছুই করতে হবে। কিন্তু মৃত্যুর মত প্রকৃত বাস্তবতাকে ভূলে গিয়ে নয়। যেকোনো বাস্তবতাকে ভূলিয়ে দেয় এমন কোনো কাজ ভালো কাজ হতে পারে না। যদি আপনি উপলব্ধি করতে পারেন আপনার হাতে সময় খুবই কম এবং আপনার করার মত অনেক সম্ভাবনা আছে তবে আপনি কেবল যা করনীয় সেইটুকুই করবেন।
সমাজবদ্ধ ভাবে বসবাসের কারনে আমাদের আশপাশের অনেককিছুর সাথে আমাদের সম্পৃক্ততা তৈরি হয়। আমাদের সাথে সম্পৃক্ত এমন কোনো কিছুই নেই যেটা আমাদের ভাবনার বিষয় নয়। তবে এখানেও আমাদের যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পৃক্ততা মানুষকে মোহ মায়ায় আবদ্ধ করে। পৃথিবীতে এমন কোনো সম্পৃক্ততা নেই যেটা চিরস্থায়ী। সম্পৃক্ততার বিভিন্ন ক্ষেত্র ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমরা আমাদের পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছি। আমাদের উচিত যেখানে যতটুকু সম্পৃক্ত হওয়া দরকার ততটুকু সম্পৃক্ত থাকা এবং এই সম্পৃক্ততা থেকে যেই দ্বায়িত্ব বোধ তৈরি হয় তা যথাযথ পালন করা। কিন্তু এইগুলোর সাথে এমন ভাবে সম্পৃক্ত হওয়া যাবে না যা মোহ মায়া তৈরি করে। সকল পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। নিজের কাছে নিজের মূল্যবোধ ও আত্ম পরিচর্চার উর্ধে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমরা মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছি এবং আবার প্রত্তাবর্তন করব। এই যাত্রাটা একান্তই একার।
মাঝখানে আমাদের এমন কোনো কিছুই সংগ্রহ করা উচিত নয় যা আমাদের প্রক্রিত অস্তিত্বের কাছে প্রত্তাবর্তনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। কোনো সম্পৃক্ততায় আবদ্ধ না হয়ে মানুষ যখন তার কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, হিংসা, অহংকার তথা আমিত্বকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারে তখন মৃত্যু তার আসল অস্তিত্বে প্রত্তাবর্তনের সোপান হয়ে যায়। মৃত্যুকে সমাপ্তি ভেবে মৃত্যু থেকে লুকানোর কিছু নেই। আমরা যদি আমিত্বের খোলস ছাড়তে পারি তবে মৃত্যু হবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা। শান্তনা নিয়ে জীবন অতিবাহিত না করে নিজেকে প্রকৃত বাস্তবতার ভিতর দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। শান্তনা হয় এমন বস্তু যার বাস্তবে কোনো ভিত্তি নেই। পরবর্তী সেকেন্ডের যেখানে ভিত্তি নেই সেখানে আমাদের উচিত প্রতিটি সেকেন্ড সচেতন ভাবে বাঁচা। তবেই জীবনকে মহিমান্বিত করা সম্ভব।
লেখা: ইমরান হাসান ইমন।