
ভালোবাসার ৪০ নিয়ম – জালাল উদ্দিন রুমি (পর্ব-১)
জালাল উদ্দিন রুমি ও শামস তাবরিজির জীবনকে উপজীব্য করে এক অনন্য উপন্যাস।
নিয়ম-০১
স্রষ্টা বলতে আমরা যা বুঝি, তা আসলে আমাদের নিজেদের সম্পর্কে ধারণারই সরাসরি প্রতিবিম্ব মাত্র। স্রষ্টার নাম নেয়ার সাথে সাথে যদি মনের মাঝে ভয় আর দোষারোপের চিহ্ন জেগে ওঠে, তাহলে বুঝতে হবে যে, আমাদের মাঝে খুব বেশি ভয় আর আফসোস লুকিয়ে আছে। আবার আমরা যদি স্রষ্টাকে ভালোবাসা আর দয়ার সাগর হিসেবে দেখি, তাহলে বুঝতে হবে সেই একই জিনিস রয়েছে আমাদের ভেতরে।
নিয়ম-০২
সত্যের দিকে যেই পথ, তাকে পাড়ি দিতে হয় হৃদয় দিয়ে, মস্তিষ্ক দিয়ে নয়। হৃদয়ের শক্তি দিয়ে তোমার নফসের মুখোমুখি হও, তাকে আহবান করো এবং পরাজিত করো। নিজের সত্তাকে যখন জানতে পারবে, তখনই স্রষ্টাকে জানতে পারবে তুমি।
নিয়ম-০৩
এই মহাবিশ্বের সবার মাঝে, সবকিছুর মাঝে আল্লাহর পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ তিনি কোন মসজিদ, মন্দির, সিনাগগ বা গীর্জায় সীমাবদ্ধ নন। কিন্তু তারপরেও যদি জানতে ইচ্ছে করে যে কোথায় তার বাস, তাহলে সেই প্রশ্নের জবাবে একটি কথাই বলা যায় : সত্যিকারের প্রেমিকের হৃদয়। আল্লাহকে একবার দেখার পর কেউ জীবিত থাকেনি এটা যেমন সত্য, তেমনি তার দর্শন পাওয়ার পর কেউ মৃত্যুবরণ করেনি এটাও সত্যি। আল্লাহকে যে খুঁজে পায়, অনন্তকালের জন্য সে তার মাঝে বিলীন হয়ে যায়।
নিয়ম-০৪
ভালোবাসা ও বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস দিয়ে তৈরি। বুদ্ধিমত্তা মানুষকে বেঁধে রাখে। এবং এতে কোন ঝুঁকি নেই। কিন্তু ভালোবাসায় সব বন্ধন মুক্ত হয়ে যায়, আর সবকিছু পড়ে যায় ঝুঁকির মুখে। বুদ্ধিমত্তা হচ্ছে সদা সতর্ক। বুদ্ধিমত্তা উপদেশ দিয়ে বলে, ‘অধিক আনন্দ থেকে সাবধান।’ আর অন্যদিকে ভালোবাসা বলে, ‘কি আসে যায়! চলো ডুব দিই।’ বুদ্ধিমত্তা সহজে ভেঙে পড়ে না, অন্যদিকে ভালোবাসা এমনকি আপনা থেকেই ধুলোয় লুটিয়ে পড়তে পারে। কিন্তু সেই ধূলোর মাঝেই লুকিয়ে থাকে অমূল্য রত্ন। যে হৃদয় ভেঙে গেছে, সে লুকিয়ে রাখে সেই রত্ন।
নিয়ম-০৫
পৃথিবীর যত ভুল তার বেশিরভাগেরই উৎপত্তি হয়েছে ভাষাগত সমস্যা এবং সাধারণ ভুল বোঝাবুঝি থেকে। কারও মুখের কথায় কখনও আস্থা রাখা উচিত নয়। ভালোবাসার বৃত্তের মাঝে যখন তুমি পা রাখবে, তখন ভাষা বলে যে বস্তুকে আমরা জানি তা সম্পূর্ণ মূল্যহীন হয়ে যাবে। কথায় যাকে প্রকাশ করা যায় না, কেবল নীরবতার মাঝ দিয়েই তাকে বোঝা যায়।
নিয়ম-০৬
একাকীত্ব এবং নির্জনতা এক জিনিস নয়। মানুষ যখন একাকী থাকে, তখন সহজেই ভাবতে পারে যে সে সঠিক পথে রয়েছে, অথচ তার ধারণা ভুল। নির্জনতাই আমাদের জন্য উত্তম, কারণ তাতে একাকী বোধ না করেই একা হওয়া যায়। কিন্তু এক সময় এমন একজন মানুষকে খুঁজে নিতেই হয়, যে তোমার আয়না হতে পারে। কেবল অন্য এক মানুষের হৃদয়ের মাঝেই মানুষ নিজেকে এবং তার মধ্যকার সৃষ্টিকর্তাকে দেখতে পারে।
নিয়ম-০৭
তোমার জীবনে যাই ঘটুক না কেন, পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল মনে হোক না কেন, কখনও হতাশার ধারে কাছেও যেও না। যখন সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়, এমনকি তখনও আল্লাহ তায়ালা শুধু তোমার জন্যই নতুন দরজা খুলে দিতে পারেন। কৃতজ্ঞ হও। যখন সবকিছু হাতের কাছে থাকে তখন কৃতজ্ঞ হওয়া সহজ। প্রকৃত সুফি সেই, যে নিজের প্রাপ্য সবকিছুর প্রতি কৃতজ্ঞ হয়েই ক্ষান্ত হয় না, বরং যা কিছু তাকে দেওয়া হয়নি তার জন্যও কৃতজ্ঞ হয়।
নিয়ম-০৮
ধৈর্য ধরা অর্থ শুধু নিষ্ক্রিয়ভাবে সহ্য করে যাওয়া নয়। ধৈর্য ধরার মানে হচ্ছে কোনো ঘটনার শেষ পর্যন্ত কি ঘটবে তা বুঝতে পারার মতো দূরদৃষ্টির অধিকারী হওয়া, এবং তাকে বিশ্বাস করা। ধৈর্য মানে কি? এর মানে হলো কাঁটার দিকে তাকিয়ে গোলাপকে দেখতে পাওয়া, রাতের দিকে তাকিয়ে ভোরকে দেখতে পাওয়া। অধৈর্য হওয়ার অর্থ হচ্ছে ভবিষ্যতে ঘটনার ফলাফল কি হবে তা বুঝতে ব্যর্থ হওয়া। সৃষ্টিকর্তার প্রেমিকরা কখনও ধৈর্য হারায় না, কারণ তারা জানে যে বাঁকা চাঁদকে পূর্ণচন্দ্র রূপে দেখতে হলে সময়ের প্রয়োজন।
নিয়ম-০৯
পুর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ অথবা উত্তর, এতে কিছু আসে যায় না। গন্তব্য যাই হোক না কেন, নিশ্চিত থাকতে হবে যেন প্রতিটি যাত্রাই হয় নিজের অন্তর অভিমুখে। একমাত্র নিজের গভীরে ভ্রমণ করার মাধ্যমেই সমগ্র বিশ্ব, এবং তার বাইরেও ভ্রমণ করা যায়।
নিয়ম-১০
যে ধাত্রী সে জানে, যদি কোন কষ্ট না থাকে তাহলে শিশুর জন্মের পথ সুগম হয় না, তাকে জন্ম দিতে পারে না তার মা। ঠিক তেমনি ভাবে কোন মানুষ যদি নতুন করে জন্ম নিতে চায়, তাহলেও কষ্টের ভেতর দিয়ে যেতে হয় তাকে। কাদামাটির পাত্র যেমন আগুনে পুড়েই শক্ত হয়, তেমনি কেবল কষ্টের মাধ্যমেই নিখুঁত হয়ে উঠতে পারে ভালোবাসা।
নিবেদক: T M Habibur Rahman