সূফীবাদ তথা মারেফতের পরিচয়।
হাদীস শরীফে হযরত রাসূলে করিম (সা:) বলেছেনঃ “শরীয়ত আমার বাক্য (কথা), ত্বরীকত আমার কর্ম (কাজ); হাকীক্বত আমার হাল (অবস্থা) এবং মারফত আমার নিগুঢ় রহস্য (যাবতীয় কাজের মূল)।” হযরত রাসূল (সা:) তাঁর অনুসারীগণকে শরীয়ত, তরীকত, হাকীকত ও মারফতের বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছেন। শরীয়ত যেমন দেহ পরিষ্কার করে তেমনি মারফত আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জনে সহায়তা করে।
পবিত্র কুরআনে রয়েছে যেঃ “আমার স্বরণার্থেই শুধু নামাজকে (অন্তরে) সু-প্রতিষ্ঠিত কর।” নামাজ কায়েম করার আসল অর্থও তাই। এই জন্য হুজুর পূর নূর (সা:) বলেছেনঃ “ওয়াক্তিয়া সালাত হইতে দায়েমী সালাত (সার্বক্ষণিক নামাজ) অনেক মর্যাদাপূর্ন।”
সর্বাবস্থায় আল্লাহতায়ালার স্মরণে মশগুল থাকার অভ্যাস হৃদয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত করে নেওয়ার সাধনাকেই ‘আকিমুস সালাত’ বলা হয়। নিজের দেহ রাজ্য থেকে আরম্ভ করে সৃষ্টি রাজ্যের সর্বত্র আল্লাহতায়ালার স্মরণযোগ্য বিষয়সমূহ বিদ্যমান রয়েছে। এসব আলামত সমূহের কথা সর্বক্ষণ হৃদয়ে জাগ্রত রাখার নামই “যিকরুল্লাহ বা আকিমুস সালাত”এর প্রকৃত মর্ম।
এই অর্থেই আত্মনিষ্ঠ সূফীগণ বলে থাকেন যেঃ “শরীয়তপন্থী লোকেরা দিনে পাঁচবার নামাজ আদায় করে থাকেন,আর ত্বরীকত পন্থী আল্লাহর ওলীগন সর্বক্ষণ নামাজে রত থাকেন।”
অন্তরের কুপ্রবৃত্তি থেকে আত্মাকে পবিত্র রাখাই সূফী সাধনা তথা মারফতের মর্মকথা। সৃষ্টি জগতের প্রতিটি বস্তুতে স্রষ্টার পরিচিতি নিরিক্ষণ করাই সুফীধর্ম বা তাসাউফ। আল্লাহতালার নূরানী সত্তায় সমাহিত হয়ে যাওয়ায় সূফী জীবনের কামনা।
অতীতের অধিকাংশ সূফী সংসার বিরাগী ছিলেন। কারণ তারা জাগতিক ধন-সম্পদ, মান-সম্মান, লোভের মোহ পরিহার করে শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রেমে সর্বক্ষণ আত্মহারা হয়ে থাকতেন। তারা আত্মসাধনা ও আত্ম-সংযমের মাধ্যমে ঐশী প্রেমের এমন এক চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁচেছেন যে, তারা জাগতিক সম্পদ ও মান-সম্মান থেকে নিস্তেজ ও নিষ্প্রভ হয়ে যেতেন। মহান আল্লাহর জিকির ব্যতীত এক মুহূর্ত কাল তারা তাঁদের জীবনের অন্য কিছুতে ব্যয় করতেন না।
“তাজকিয়া” বা আত্মশুদ্ধি ও আত্মসাধনার মাধ্যমে পরম প্রেমময় আল্লাহর প্রেমোপলব্ধিই সূফী সাধনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য।” নিম্নে উল্লেখিত সূফীয়ায়ে কেরামের পবিত্র বাণী থেকে মারফতের নির্যাস পাওয়া যায়ঃ
“যে তার অন্তঃকরণকে বিশ্বসৃষ্টির পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র রেখেছেন এবং সমাজ থেকে দূরে রয়েছেন,আর শুধু আল্লাহ প্রাপ্তির বাসনায় নির্জনতাকে সম্বল করেছেন তিনিই প্রকৃত সূফী।”
-হযরত মাওলানা মাতবুলী (ক.)
“যিনি তার জীবন মরণ শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি কল্পেই উৎসর্গ করে দিয়েছেন তিনিই প্রকৃত সূফী।”
-হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (ক.)
“আত্মিক পবিত্রতা অর্জন এবং আল্লাহ ব্যতীত সৃষ্টি জগতের সবকিছু থেকে প্রভাব মুক্ত হওয়ার নামই সূফী মতবাদ।”
-তাপস হযরত বিশর হাফী (ক.)
“হৃদয়ে যখন আল্লাহর বিরোধিতার লেশমাত্র থাকে না, তখন জানতে হবে; মারফত অর্জন হয়েছে।
-সূফী হযরত হাসান বসরী (ক.)
“যে প্রতিটি বস্তুর পরমসত্তার সম্পর্কে অবগতি লাভ করা,গুঢ় রহস্য ও সূক্ষ্মতত্ত্ব বিষয় নিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া এবং সৃষ্টি জগতের সবকিছু নির্ভরতা থেকে বিমুখ ও বিমুক্ত থাকার নামই তাসাউফ বা সূফীবাদ।”
-হযরত সূফী মারুফ করখী (ক.)
“যিনি স্বল্প আহার,স্বল্প নিদ্রা,স্বল্প কথায় অভ্যস্ত এবং জাগতিক মোহ থেকে অনাসক্ত, তিনিই সূফী। বিশ্বসৃষ্টির জাগতিক আকর্ষণ থেকে মুক্ত থাকায় সূফীধর্ম তথা মারফতের সারকথা।
-হযরত সহল বিন আবদুল্লাহ তাসতরী (ক.)
যার অন্তরে সংকোচবোধ নেই, সর্বদা সৎ চিন্তায় বিভোর; আল্লাহর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জাগতিক লোভ-লালসা থেকে নিরাসক্ত হয়ে পড়েছেন এবং স্বর্ণ ও মাটি যার নিকট এক বলে বিবেচিত, তিনিই প্রকৃত সূফী। সূফী জীবনের একমাত্র মিশন তথা কামনা হল স্রষ্টার মারফত লাভ বা মাবুদকে চেনা – জানা।
সূত্র: আত্মশুদ্ধিতে মারেফাত (ফেইসবুক গ্রুপ)