মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ কোথায় ছিলেন। (তত্বকথা)

মহাবিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ কোথায় ছিলেন। (তত্বকথা)

মহাবিশ্বের স্রষ্টা মহান আল্লাহ এক সীমাহীন শক্তির আঁধার। তিনিই একমাত্র স্রষ্টা। এ জন্য সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহর অবস্থান কোথায় -চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মনে এটা একটা বিরাট প্রশ্ন!

পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ বলেন,

“তিনিই (আল্লাহ) প্রথমে, তিনিই শেষে, তিনিই প্রকাশ্যে তিনিই গোপনে এবং তিনিই সর্বজ্ঞানী।” (সূরা আল হাদিদ, আয়াত নং ৩)।

অর্থাৎ এমন কোন স্হান বা অবস্থা কল্পনা করা সম্ভব নয়, যেখানে আল্লাহর অস্তিত্ব নেই, এমন কোন সময় কল্পনা করা যায় না যখন আল্লাহর অস্তিত্ব ছিল না কিংবা থাকবে না। তিনি সর্ব অবস্থায় সর্ব স্হানে বিরাজমান, তাঁর অস্তিত্ব কখনো প্রকাশ লাভ করে আবার কখনো গোপন থাকে। বিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে তাঁর অস্তিত্ব গোপন ও সংরক্ষিত ছিল। নিজেকে প্রকাশের উদ্দেশ্যই তিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন।

সর্বগুণের আধার আল্লাহ তায়ালা মূলে ছিলেন তাঁর জাত পাকে। তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ বিভিন্ন গুণ ও ক্ষমতা যখন প্রকাশ পেল তখন সেগুলো হল তাঁর সিফাত। অর্থাৎ বিভিন্ন সিফাতের মাধ্যমেই আল্লাহর বহিঃপ্রকাশ। স্হূল জগৎ সৃষ্টি করে আল্লাহ তায়ালা তাঁর সিফাতগুলিকে পূর্ণভাবে প্রকাশিত হওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। তাঁর বিভিন্ন মহিমা গোপনে, অর্থাৎ বাহ্যিক চক্ষুর অন্তরালে এই স্হূল জগতে ক্রিয়াশীল রয়েছে। মানুষের বাহ্যিক ইন্দ্রিয় দ্বারা স্হূল জগতের ভিতরে কিংবা বাইরে আল্লাহর সূক্ষ্ম অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা পাওয়া সম্ভব নয়।

সূক্ষ্ম তত্ত্বজ্ঞানী ও অন্তর চক্ষু ওয়ালা সাধকের কাছে আল্লাহর এই গোপন রহস্য প্রতিনিয়ত নব নব রুপে প্রকাশ পায়। এ সকল সাধকের নিকট আল্লাহর সৃষ্টি জগৎ অত্যন্ত ব্যাপক ও বিস্তৃত। তাসাউফের সাধনা জগতে প্রবেশ করে আমি দেখেছি, সেখানে আমাদের এই পৃথিবীর মত অসংখ্য গ্রহের অস্তিত্ব বিদ্যমান। সু-নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত সৃষ্টির নিজস্ব নিয়মের প্রয়োজনে একদিকে আমাদের পৃথিবীর ন্যায় বহু গ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে, অপরদিকে পূর্বে সৃষ্ট অনুরুপ গ্রহ ধ্বংস প্রাপ্ত হচ্ছে। মোট কথা, সর্বদাই আল্লাহর মহিমা এ সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে। এভাবে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির মাঝে চিরস্থায়ী। আর বিশ্ব সৃষ্টির পূর্বে তাঁর অবস্থান ছিল তাঁর জাত পাকে যা সকল গুনের উর্ধ্বে। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনের আরেকটি বাণী উল্লেখযোগ্য,

“যখন তাঁর আরশ পানির উপরে ছিল, তখন তিনিই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী ৬ দিনে সৃষ্টি করেন।” (সূরা হুদ, আয়াত নং ৭)।

মহাবিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বর্ণনার পাশাপাশি তাসাউফের সাধনার মাধ্যমে আমি ব্যক্তি জীবনের সাথেও এর অপূর্ব মিল খুঁজে পাই। পিতার পৃষ্ঠদেশে সন্তানের জীবনী শক্তির মাঝে আল্লাহর সূক্ষ্ম শক্তি বিরাজমান ছিল। উহা ৬টি স্তর অতিক্রম করে মানুষের পূর্ণাঙ্গ দেহ, গায়ের রং, চেহারা ইত্যাদি শুক্রকীট থেকে বিকাশ লাভ করে। এমনকি মানুষের স্বভাব-চরিত্র ও জ্ঞান-বুদ্ধিও শুক্রকীট থেকেই বিকশিত হয়।

অর্থাৎ একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ তার সমস্ত বৈশিষ্ট্য নিয়ে শুক্রকীটের ভিতরে সূক্ষ্মভাবে অবস্থান করে। এই শুক্রকীট যখন অনুকূল পরিবেশে ডিম্বকোষের সাথে মিলিত হতে পারে, তখন ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে এবং কালক্রমে পূর্ণাঙ্গ মানব শিশুরুপে ভূমিষ্ঠ হয়। মানবের এই সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় আসমান ও জমিন সমূহের অবস্থান বিশ্লেষণ করা সম্ভব। পূর্ণাঙ্গ মানব স্হূলজগৎ ও উর্ধ্বে জগৎ উভয় প্রকার উপাদানে গঠিত। আসমান সমূহ বলতে উর্ধ্বজগত তথা সূক্ষ্মজগতের উপাদানসমূহকে বুঝানো হয়েছে। অনুরূপভাবে জমিনসমূহ বলতে স্হূলজগতের উপাদানগুলোকে বুঝায়। এই মানবের জন্ম লগ্নে আল্লাহর হুকুম শুক্রকীটের ভিতরে তরল পদার্থের আবরণে বিরাজমান।

পবিত্র কুরআনে এ কথা বলা হয়েছে,

“আল্লাহ মহাকাশ,পৃথিবীর ও তাদের মাঝের সবকিছু ৬ দিনে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি আরশে সমাসীন হন।” (সূরা আস সাজদাহ, আয়াত নং ৪)।

মানব সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় দেখা যায়, প্রথমে মানবের অস্তিত্ব থাকে পিতার শুক্রকীটে। তারপর মাতৃগর্ভে শুক্রকীট ডিম্বকোষের সাথে মিলিত হয়ে নতুন সৃষ্টির সূচনা করে। তার ৪০ দিন পর অর্থাৎ তৃতীয় স্তরে ঐ নতুন বীজ রক্তের ফোঁটায় পরিণত হয়। এই রক্তের ফোঁটা আরো ৪০ দিন পর অর্থাৎ পঞ্চম স্তরে যখন অস্হি যুক্ত হয়, তখন এই অপরিণত মানব শিশুর ভিতরে আল্লাহ তাঁর রুহ থেকে রুহ ফুঁকে দেন। শুক্রকীটে অবস্হিত আল্লাহর সূক্ষ্ম শক্তি এবং ১২০ দিন বয়সে ফুঁকে দেয়া রুহ মানব শিশুর ক্বালবে প্রকাশ লাভ করে। সর্বশেষ (অর্থাৎ ষষ্ঠ) পূর্ণাঙ্গ স্তরে ঐ মানব শিশুই আল্লাহর সত্তা ক্বালবে ধারণ করে নিয়ে মাতৃগর্ভ হতে দুনিয়ায় আগমন করে। ‘ পৃথিবী সৃষ্টি সম্পন্ন করার পর আল্লাহ আরশে সমাসীন হন ‘ – পবিত্র কুরআনের এই আয়াত দ্বারা মানব শিশুর ক্বালবে আল্লাহর অবস্থানের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

পবিত্র কুরআনের উপরোক্ত আলোচনা থেকে পরিশেষে বলা যায় যে, সৃষ্টির পূর্বে মহান আল্লাহ তায়ালা জাতপাকে সমহিমায় অবস্থান করছিলেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর প্রতিনিধির মাধ্যমে সৃষ্টিজগতে প্রকাশিত হয়ে মানুষকে তাঁকে পাওয়ার পদ্ধতি শিক্ষা দিচ্ছেন।

সূত্র: আল্লাহ কোন পথে।
নিবেদক: অধম পাপী মোজাম্মেল পাগলা।

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel