হযরত ইমাম হুসাইন (আ:) এর শাহাদাত বরণ!

হযরত ইমাম হুসাইন (আ:) এর শাহাদাত বরণ!

কারবালার ময়দানে ইমাম হুসাইন (আ:) মওলা আলী (আ:) এর জুলফিকার তরবারী যখন শত্রূ পক্ষের বিরুদ্ধে চালনা করিতেছিলেন তখন ইয়াজিদ বাহিনী নিজেদের মারাত্মক পরিণতির কথা চিন্তা করে ইয়াজিদ সেনাপতি আমর বিন সা’আদ’ নির্দেশ দিল, সবাই মিলে চারিদিক থেকে ইমাম হুসাইন (আ:) কে লক্ষ করে তীর নিক্ষেপ কর। নির্দেশমত ইয়াজিদ বাহিনী নবী (সা:) এর দৌহিত্রকে চারিদিক থেকে ঘিরে বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। ফলে চার দিক থেকে তীর এসে হযরত ইমাম হুসাইন (আ:) কে আঘাত হানতে লাগল। কোনটা ঘোড়ার গায়ে লাগছিল, কোনটা ইমাম (আ:) এর গায়ে লাগছিল।

এ ভাবে যখন তীরের আঘাত ইমাম হুসাইন (আ:) এর পবিত্র শরীর ঝাঁঝরা হয়ে ফিনকি দিয়ে সারা শরীর থেকে রক্ত বের হতে লাগল,তখন তিনি (আ:) বারবার মুখে হাত দিয়ে বললেন, বদ-বখত! তোমরাতো তোমাদের নবী (সা:) এর লেহাজও করলে না। তোমরা নবী (সা:) এর বংশধরকে হত্যা করেছ। তোমরা কেন আমাকে হত্যা করতে চাও? আমি কি কোনো পাপ অথবা অপরাধ করেছি? ইয়াজিদ সৈনবাহিনী বোবার মত দাঁড়িয়ে রইল।

পূনরায় ইমাম হুসাইন (আ:) বললেন-আমাকে হত্যা করলে আল্লাহর কাছে কী জবাব দিবে? কী জবাব দিবে বিচার দিবসে আমার নানা মহা নবীর কাছে? ইয়াজিদের সেনাবাহিনী পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে। আবার ইমাম হুসাইন (আ:) বললেন “হালমিন নাসরিন ইয়ান সুরুনা” আমাদের সাহায্যে করার মত কি তোমাদের মধ্যে একজনও কি নেই। তারপরের আহবানটি সাংঘাতিক মারাত্মক। ঐতিহাসিকদের মতে এটাই ইমাম হুসাইন (আ:) এর শেষ ভাষন। “আলাম তাসমাও? আলাইসা ফিকুম মুসলিমু”? আমার কথা কি শুনতে পাওনা? তোমাদের মাঝে কি মাত্র একটি মুসলমানও নেই?

এরপর এ এক অন্য রকম দৃশ্য ইমাম হুসাইন (আ:) এর চোখের সামনে আর একটা দৃশ্য ভেষে উঠল, তিনি (আ:) দেখতে পেলেন দো-জাহানের বাদশা আখেরী পয়গম্বর আহম্মদ নবী মুহাম্মদ মোস্তফা (সা:) একটি বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।শেরে খোদা মওলা হযরত আলী মর্তুজা (আ:) ও হযরত মা ফাতেমাতুয যুহরা (আ:) ও পাশে আছেন,আর বলছেন, ’হুসাইন’! আমাদের দিকে তাকাও, আমরা তোমাকে নিতে এসেছি বাবা তুমি আমাদের নিকট অতিশ্রিঘই চলে আস।

হযরত ইমাম হুসাইন (আ:) এর কাপড় রক্তে ভিজে যাচ্ছিল আর হুযুর (সা:) সেই রক্ত বোতলে ভরে নিচ্ছেন এবং বলছিলেন,হে আল্লাহ! হুসাইনকে পরম ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দান কর, আল্লাহ! আল্লাহ! নবী (সা:) এর দৌহিত্র নিজের রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেলেন। শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে গিয়ে একেবারে রক্তশুণ্য হয়ে গেলেন এবং আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন। যে মুহুর্তে হযরত ইমাম হুসাইন (আ:) ঘোড়া থেকে পড়ে গেলেন, আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠল, হযরত ফাতেমাতুয যুহরার পবিত্র আত্বা ছটপট করতে লাগল, শেরে খোদা মওলা হযরত আলী মর্তুজা (আ:) এর রুহ মুবারক থেকে ‘আহ’ শব্দ বের হল। সেই হুসাইন (আ:) পতিত হলে, যাকে প্রিয় নবী (সা:) নিজের কাঁধে নিতেন। ঘোড়া থেকে পতিত হওয়ার পর কমবখত সীমার, হাওলা বিন ইয়াজিদ, সেনান বিন আনস প্রমুখ বড় বড় জালিম এগিয়ে আসলো এবং হযরত ইমাম হুসাইন (আ:) এর পবিত্র শরীরের উপর চেঁপে বসল। সীমার বুকের উপর বসল।

হযরত ইমাম হুসাইন (আ:) বুকের উপর সীমারকে দেখে বললেন, আমার নানাজান (সা:) ঠিকই বলেছেন, এক হিংস্র কুকুর, আমার আহলে বাইতের উপর মুখ দিচ্চে, আমার নানাজান (সা:) এর কথা ষোল আনা সত্য, তুমিই আমার হত্যাকারী। আজ জুম্মার দিন, এ সময় লোকেরা আল্লাহর দরবারে সিজদারত। আমার মস্তকটা তখনই আমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন কর, যখন আমিও সিজদারত থাকি। আহ! দেখুন, হযরত ইমাম হুসাইন (আ:) জীবন সায়াহ্নের সেই মুহুর্তেও পানি পান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন নি, নিজের ছেলে মেয়েকে দেখার জন্য আরজু করেননি, সেই সময়েও কোন আকাঙ্খা বা আরজু থাকলে এটাই ছিল যে, আমার মাথা নত হলে যেন আল্লাহর সমীপেই নত হয়। সে সময়ও তিনি (আ:) বাতিলের সামনে মাথা নত করেননি। সেই সময়ও তিনি ইমাম (আ:) সিজদা করে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন, সালাত কায়েম করে গিয়েছেন, দুনিয়াবাসীকে জানিয়ে গিয়েছেন যে, হুসাইন (আ:) আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েও সালাত ত্যাগ করেননি। তিনি (আ:) দুনিয়াবাসীকে এটাই যেন বলতে চেয়েছিলেন, আমাকে যদি ভালবাসেন, আমার জিন্দেগী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করুন।

এরপর সীমার ইমাম (আ:) এর গলায় খঞ্জর চালাতে গিয়ে দেখল খঞ্জর কিছুতেই কাটেনা শত চেষ্টা করেও যখন পারলনা, তখন ইমাম (আ:) বললেন, ওহে সীমার তুমি যেখানেখঞ্জর ধরেছ সেখানে আমার নানাজান (সা:) তাঁর পবিত্র মুখ দিয়ে চুমু দিয়েছিলেন, আমাকে এভাবে আর কষ্ট দিওনা আমার নানাজানের চুমুর জায়গায় খঞ্জর দিয়ে তুমি কিছুতেই মস্তক বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। ওহে সীমার তুমি আমাকে একটু সময় দাও আমি যখন সিজদায় মাথা অবনত করে রাখব, তখন তুমি আমার গর্দানের উপরিভাগে খঞ্জর চালাইও, হযরত ইমাম হুসাইন (আ:) সিজদায় মাথা রাখলেন এবং তসবীহ পাঠ করে বললেন, মওলা! যদি হুসাইন (আ:) এর কুরবানী তোমার দরবারে গৃহীত হয়, তাহলে এর ছওয়াব নানাজান (সা:) এর উম্মতের উপর বখশিশ করে দাও।

তখন সীমার গর্দানের উপরিভাগে খঞ্জর চালিয়ে হযরত ইমাম হুসাইন (আ:) এর মস্তক মুবারক শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল, ইমাম (আ:) এর পবিত্র রুহু মোবারক তখন বের হয়ে চলে গেলেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্নাইলাহে রাজেউন)। তখন তাঁর (আ:) এর ঘোড়া স্বীয় কপালকে তাঁর (আ:) এর রক্তে রঞ্জিত করল এবং দৌড়ে চলে যেতে লাগল। তখন সীমার লোকদেরকে বলল, ঘোড়াটিকে ধর, কিন্তু যতজন লোক ঘোড়াটি ধরতে এগিয়ে গেল, সে সবাইকে আক্রমন করল এবং দাঁত আর পা দিয়ে জখম করে ওদেরকে শেষ করে দিল। সতেরজন লোককে এ ভাবে খতম করল। শেষ পর্যন্ত সীমার বলল,ছেড়ে দাও, দেখি কি করে। ঘোড়া ছুটে গিয়ে তাঁবুর কাছে গেল এবং কান্না চিৎকার করতে লাগল।

সুত্র: “কারবালা প্রান্তরে“, খতিবে পাকিস্তান হযরত মাওলানা মুহাম্মদ শফী ওকাড়বী (রহ:)।

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel