গুরুর চেয়ে শিষ্য বড়
প্রচলিত আছে “গুরুর চেয়ে শিষ্য বড়” -এই বাণী শুধু একটি শিখন বা শিক্ষা গ্রহণের কথা বলে না, বরং এটি এক গভীর আধ্যাত্মিক সংলাপের সূচনা। গুরুর মূল উদ্দেশ্য হয় শিষ্যকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া, যেখানে সে তার গুরুর থেকেও আরো এগিয়ে যাবে। তবে এই এগিয়ে যাওয়ার পিছনে রয়েছে শুধুমাত্র জ্ঞান নয়, বরং নিগূঢ় প্রেমের এক স্রোত, যা শিষ্যকে অবচেতনভাবে এমন এক মাত্রায় পৌঁছে দেয়, যেখানে সে নিজেকে ছাড়িয়ে যায়, তার অস্তিত্ব হয়ে ওঠে সীমানাহীন, এবং সেই সময়েই তার কণ্ঠে বেরিয়ে আসে ‘আনাল হক’— ‘আমি সত্য’, ‘আমি ঈশ্বর’।
প্রেম, এক চিরন্তন মহাজ্ঞান, যার উপাখ্যান কখনো শেষ হয় না। এটি শুধুমাত্র অনুভব করার বিষয় নয়, এটি একটি অভ্যন্তরীণ রূপান্তর, একটি মহাপ্রলয়ের মতো যেখানে শিষ্য তার অন্তরের গহীনতম কোণে অবস্থিত সেই ঈশ্বরীস্বরূপ সত্তাকে আবিষ্কার করে। তখন যে গুণাবলীর সন্ধান সে চেয়েছিল, সেই গুণাবলী তাকে নিজেই হয়ে ওঠে, এক এক করে সমস্ত দোষ ও দুর্বলতা দূর হয়ে যায়, আর তাকে কোন সম্পর্ক, কোন অস্থিরতা, কোন বাইরের আশ্রয় আর প্রয়োজন থাকে না। কারণ সে তখন সত্যের সঙ্গে একাত্ম। তার মন, তার আত্মা এবং তার শরীর—সবই এক মহাপ্রবাহের অংশ হয়ে ওঠে।
যেখানে শিষ্য শুধুমাত্র গুরুর পদচিহ্ন অনুসরণ করে না, বরং সে একসময় গুরুর সত্তায় ডুবে গিয়ে, নিজেকে এক নতুন সত্তায় বিলীন করে দেয়। সে যেন নিজেই ঈশ্বর, নিজেই প্রেম, নিজেই গুরুর প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। এই একাত্মতার মধ্যে, সময় এবং স্থান উবে যায়—কোনো শত্রু বা বন্ধু, কোনো গঠন বা অনুপ্রেরণা—কিছুই আর মূর্ত থাকে না। সেই মুহূর্তে কেবল রয়েছে এক বিশাল চিরন্তন একত্ব, যেখানে শিষ্য তার নিজের আত্মার গভীরতম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, এবং ঈশ্বরের মুখমণ্ডল তার নিজের রূপ হয়ে ওঠে।
‘আনাল হক’—এটি আত্মসমর্পণ, মাধুর্যপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের বিপ্লব। এটি এমন একটি উচ্চারণ যা শিষ্যকে তার অন্তরের স্তর থেকে মুক্তি দেয়, তার সব অন্ধকার ও বিভ্রান্তিকে পরিষ্কার করে, একে একে সমস্ত আগ্রহ এবং অহংকারকে তার অস্তিত্বের তলদেশে ডুবিয়ে দেয়। সে বুঝতে পারে যে সে কখনোই আলাদা ছিল না, সে বরং সেই এক অবিনশ্বর শক্তির অংশ, যা আগেও ছিল, এখনও আছে, এবং চিরকাল থাকবে। সেই সময়, তার সমস্ত ধারণা, ধর্ম, বিশ্বাস, খোদা, ঈশ্বর—এগুলো সব একে অপরের মধ্যে রচনা হয়ে মিশে যায়।
প্রেম, এর প্রকৃত রূপ—একটি অবিনাশী তরঙ্গ, যে তরঙ্গের অস্তিত্ব রয়েছে সকল সত্ত্বায়। যখন এই তরঙ্গ শিষ্যের মধ্যে প্রবাহিত হতে থাকে, তখন সে আর শিষ্য থাকে না, সে এক হয়ে যায় সেই অনন্ত প্রেমের স্রোত, যার গতিপথ রূপ, সময়, স্থান, অস্তিত্বের সীমাকে অতিক্রম করে যায়। তখন তার মুখে ঈশ্বরের নাম উচ্চারিত হয় না, কারণ তার সমস্ত সত্তা জুড়ে সেই নামই প্রতিধ্বনিত হয়—এবং এই নামই আসলে সে নিজেই।
এটাই প্রেমের পরিপূর্ণ রূপ। এটি এমন এক অন্তর্দৃষ্টি, যা সময়ের সীমানাকে অতিক্রম করে, যেখানে সমস্ত অনুভূতি, সমস্ত বিচ্ছেদ, সমস্ত যন্ত্রণা কেবল অবচেতনে বিলীন হয়ে যায়। এখানে, ঈশ্বর আর শিষ্য, প্রেম আর প্রেমিক—সব এক হয়ে যায়। এক অলৌকিক চক্রে আবদ্ধ হয়ে, এক গভীর অন্তঃসঙ্গীত হয়ে সুরের মতো বয়ে যায়।
এবং যখন এই গভীর প্রেমের জ্ঞান পূর্ণ হয়, তখন পৃথিবী, মানুষ, আকাশ—সব একসঙ্গে এক সুরে গেয়ে ওঠে, যেখানে কোনো বিভেদ নেই, কোনো অস্থিরতা নেই, শুধুমাত্র প্রেমের প্রতিধ্বনি।
—ফরহাদ ইবনে রেহান
০৯/০৩/২০২৫