বিশ্বাসের প্রকৃতি এবং আত্ম-অনুসন্ধান
বিশ্বাসের প্রকৃতি এবং তার সাথে মানুষের আত্ম-অনুসন্ধান এক গভীর ও সূক্ষ্ম বিষয়। সত্যের সন্ধানে বিশ্বাসের প্রশ্ন আসে এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে, যেখানে সত্য ও জ্ঞানের অর্জন কোনো অন্যের ধার করা চিন্তা বা ধারণার উপর নির্ভর করে না, বরং এটি নিজের অভিজ্ঞতা ও গভীর অনুসন্ধানের মাধ্যমে উদ্ভূত হয়।
বিশ্বাস যখন অন্যের দ্বারা চাপানো হয়, তখন তা হয়ে ওঠে এক ধরনের অন্ধকারে হাঁটা। যদি কোনো ধর্ম বা মতবাদ পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের দ্বারা চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে তা কখনোই “নিজস্ব বিশ্বাস” হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। এটি শুধুমাত্র পরিধান করা এক ধরনের অস্থায়ী পোশাক, যা জন্মগত কিংবা বাহ্যিক প্রভাব দ্বারা আমাদের উপর আরোপিত। এর সঙ্গে আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা বা গভীর উপলব্ধির কোনো সম্পর্ক থাকে না। আসল বিশ্বাস, আসল সত্য এবং আসল জ্ঞান তখনই সম্ভব, যখন আমরা তা আমাদের অভ্যন্তরীণ আত্মা ও হৃদয়ের গভীরতা থেকে খুঁজে বের করি।
“পরের ধনে পোদ্দারি” এটি একটি অনবদ্য উদাহরণ, যেখানে বলা হচ্ছে যে, অন্যের বিশ্বাস কিংবা চিন্তা পোষণ করা নিজস্ব সত্যের প্রতি বিশ্বাসের অভাবকেই প্রমাণ করে। পরের বিশ্বাস নিয়ে বাঁচা, বা কোনো সামাজিক নিয়মের অন্ধ অনুগামী হয়ে থাকা, এক ধরনের আত্মবিশ্বাসহীনতা তৈরি করে এবং আমাদের নিজের পরিচয় ও উদ্দেশ্যকে বেদম করে ফেলে। এই বিশ্বাস আমাদের আত্মার গভীরে প্রবাহিত হওয়া শক্তিকে বাঁধা দেয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জ্ঞান অর্জনের পথ। যেকোনো সঠিক অনুসন্ধান বা সত্যের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য, বিশ্বাসের পরিবর্তে অনুসন্ধান প্রয়োজন। একটি বিশ্বাস বা ধর্মীয় নিয়ম মেনে চলার চেয়ে সত্য বা প্রকৃতির দিকে অবিরাম নিরীক্ষণ করা উচিত, এবং যে ধারণাগুলি প্রবাহিত হচ্ছে, সেগুলির পরীক্ষা করা উচিত। শুধু কোন কিছু গ্রহণ না করে, বরং তা চিন্তা ও বিশ্লেষণ করে জানার চেষ্টা করা উচিত।
যেমন আয়নাতে ময়লা থাকলে নিজের চেহারা দেখা যায় না, তেমনই অন্যের বিশ্বাস আমাদের মনের গভীরতায় আসলে আমাদের আসল চেহারা বা সত্যকে চিহ্নিত করতে দেয় না। যখন আমাদের মনে অস্থায়ী এবং বাইরের বিশ্বাসের আস্তরণ থাকে, তখন আমরা নিজেদের আসল পরিচয় থেকে দূরে থাকি। আমাদের ভেতরের আত্মার প্রকৃত মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে হলে, সকল প্রকারের বাইরের ইমপ্রেশন বা রীতিনীতি থেকে মুক্ত হতে হবে।
এবং এটি সত্য, যারা নিজেকে জানার জন্য কষ্ট ও ক্ষতি স্বীকার করতে চায় না, তারা নিজেদের আত্মার গভীরতম সত্যকে কখনো খুঁজে পায় না। তারা বাহ্যিক ধ্যান বা ধর্মীয় নিয়ম-নীতির মধ্যে আবদ্ধ থাকে এবং তাদের আত্মবিচার ও আত্মনিরীক্ষণের প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়। প্রকৃত অনুসন্ধান এবং আত্মবিশ্বাসী সাফল্য শুধু সেই ব্যক্তির জন্যই সম্ভব যারা সত্য অনুসন্ধানে কঠিন পথ পাড়ি দিতে প্রস্তুত।
এখানে একটি গভীর দর্শন নিহিত রয়েছে— বিশ্বাসের মুক্তি কেবল তখনই সম্ভব যখন আমরা নিজস্ব অনুসন্ধানের মধ্যে প্রবৃত্ত হই। যখন আমরা নিজেদের অন্তর্গত প্রকৃতিকে নিরীক্ষণ করতে শুরু করি, তখন আমরা দেখতে পাই যে, সত্য কোন অবস্থায় বাইরের কোনো এক সত্ত্বা নয়, বরং এটি আমাদের অন্তরে প্রতিফলিত হয়। সত্যের সন্ধান আমাদের নিজের মধ্যে, আমাদের মনের গভীরে নিহিত থাকে, যা বাহ্যিক বাধা বা সামাজিক প্রভাব দ্বারা কখনো আবদ্ধ হতে পারে না।
সুতরাং, যে ব্যক্তি আত্মবিশ্বাসী হতে চায়, তার জন্য সমস্ত বাহ্যিক বিশ্বাস ও বিধি-নিষেধ ছেঁটে ফেলে নিজের পথ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। এই পথটি কখনোই সহজ নয়, তবে এটি সেরা পথ যা আমাদের আত্মমিলন, শান্তি এবং অবশেষে সঠিক সত্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
—ফরহাদ ইবনে রেহান