মসজিদ-মন্দির বা মাজারের দান বাক্সের টাকা ত্রান দেওয়া যাবে না

মসজিদ-মন্দির বা মাজারের দান বাক্সের টাকা ত্রান দেওয়া যাবে না, এটাই চূড়ান্ত।


অতি আবেগের স্রোতে মানুষের বিবেক ভেসে গিয়েছে। কোনো বিবেকবানদের জন্য একথা বলা উচিত না যে, “মসজিদ-মন্দির বা মাজারের দান বাক্সের টাকা বন্যার্তদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়া হোক।” এ দাবি কেবল মাত্র আবেগ থেকেই হতে পারে। খুব সেন্সেটিভ বিষয়, যা মানুষের আত্মসম্মানে আঘাত হানতে সক্ষম।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে (বন্যা, ঝড়, অগ্নিকান্ড ইত্যাদি) যারা সমস্যায় পড়েন সাময়িক সময়ের জন্য, তারা ভিক্ষুক নন। তারা ভিক্ষা করে খায় না বা দান গ্রহণ করে না; বরং নিজেরাই ভিক্ষা দেন এবং দান করেন। তারা শুধুমাত্র কিছু সময়ের জন্য বিপদে পড়ে। এই যে হঠাৎ বিপদ, মানে আমাদের জীবনের অসময়, তা কিন্তু সবার জীবনেই আসে। তাই বলে কি আমরা ভিক্ষা করি বা দান গ্রহণ করি? সর্বোচ্চ ধার-দেনা করে চলি, আবার ফিরিয়ে দেই। তাহলে বন্যার্তদের কেন দান করার প্রসঙ্গ আসতেছে? তারা কি দান বা ভিক্ষা চেয়েছে? তবে কেন মসজিদ-মন্দির বা মাজারের দান বাক্সের টাকা তাদের দেওয়ার কথা উঠাচ্ছে একদল মানুষ?

ধরুন আপনি হঠাৎ বিপদে পড়লেন, আপনার বিপদ দেখে আপনার আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশি, বন্ধু-বান্ধব এসে আপনাকে বললো- “এই নিন, আপনাকে ১০ হাজার টাকা দান করলাম। দান গ্রহণ করুন”। তখন আপনার মানসিক অবস্থা কেমন হবে? ইচ্ছা করবে না যে, “মরে যাই?” ঐ ব্যক্তিদের কি আর বন্ধু মনে হবে? গ্রহণ করবেন সেই দান? যদি আপনি ভিক্ষুক না হয়ে থাকেন, তবে আপনি কোনোদিনও তা গ্রহণ করবেন না। আর ঐ ব্যক্তিদের সাথে আর সম্পর্ক রাখবেন না। কিন্তু যদি এক বন্ধু এসে বলে যে- “এই নাও ১০ হাজার টাকা। আপাতত বিপদ সামলাও।” তখন আপনার কেমন অনুভূতি হবে। মনে হবে না যে- “এতো বিপদের মাঝেও এই আনন্দ যে, একজন ভালো বন্ধু আপনার আছে, যে কিনা আপনার বিপদে সহযোগীতার হাত বাড়িয়েছে”। হয়তো বলবলেন যে- “অনেক ধন্যবাদ, আমার বিপদ কেটে গেলে টাকাটা ফেরত দিয়ে দিবো”। তখন দেখা যাবে বন্ধু রেগে গিয়ে অভিমানে বলবে “তুই কি আমাকে বন্ধু ভাবিস না! কিসের টাকা ফেরত দিবি? বন্ধু হয়ে বন্ধুকে এতোটুকু সহযোগীতা না করলে কিসের বন্ধুত্ব!”। তখন ঐ টাকা নিতে আপনার আর খারাপ লাগবে না। কারণ সেটা দান বা ভিক্ষার টাকা নয়, ঐটা ভালোবাসার টাকা। আমরা আমাদের আপনজনদের জন্য যা ব্যয় করি, তা আমরা দান হিসেবে করি না, তাই তারাও কখনো লজ্জাবোধ করে না আমাদের দ্বারা ব্যয় করাতে। বোন বিপদে পড়লে ভাই তাকে টাকা পাঠায়, ভাই বিপদে পড়লে বোন, এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে, প্রতিবেশিকে। এগুলো দান বা ভিক্ষা নয়। এগুলো হলো পাশে থাকা, সহযোগীতা করা, হাদিয়া বা উপহার দেওয়া।

আপনি বিপদে পড়লে দান না নিলে বন্যার্তদের দান দিতে চাচ্ছেন কেন? তাও আবার সেই টাকা, যা মসজিদ-মন্দির বা মাজারের দান বাক্সে জমা হয়। আপনার বিবেক কি ভেসে গেল বন্যায়! যারা নিজেরাও ভিক্ষা দেয় বা দান করে, তাদেরকে ভিক্ষা বা দানের টাকা দিতে চান, আপনার হৃদয় কাঁপে না? আপনার আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধব সাময়িক বিপদে পড়লে কি তাকে দান করে অপমান করেন? এটা ত অমানুষদের নোংরা অস্ত্র, যাকে বলে “সুযোগে সদ্বব্যবহার”। দান বা ভিক্ষা দিয়ে ভিক্ষুক বানিয়ে দিতে চাচ্ছেন একজন সাবলম্বি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিকে। কেন? আপনি কি জানেন না যে, জীবনের চেয়েও সম্মান অনেক বড়?

বন্যার্তদের ভিক্ষুক ভাবার কোনো অধিকার আপনার নাই। তারা যদি একবার বুঝে যে, আপনারা তাদের ভাই-বন্ধু হিসেনে সহযোগী না, বরং তাদের দান করছেন বা ভিক্ষা দিচ্ছেন, তাহলে তারা মরে গেলেও আপনাদের থেকে কিছু গ্রহণ করবে না। অসময়ে তাদের আশ্রয় দরকার, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা দরকার। তবে দান হিসেবে নয়। বন্ধুর থেকে বন্ধু সহযোগীতা পাওয়ার অধিকার থেকে। মানুষ ত মানুষের জন্য। তারা আমাদের ভাই-বন্ধু, তাদের অসময়ে সহযোগীতা করা আমাদের পরম দায়িত্ব। ভিক্ষা দেওয়া বা দানের মত কাজ তো আমরা সারাজীবনই করে যাবো। কিন্তু মানুষ হয়ে মানুষের বিপদে, বন্ধু হয়ে বন্ধুর বিপদে কি নিজের অংশ থেকে তাদের সহযোগীতা করতে পারবো না? তাহলে আমি কিসের মানুষ?

মসজিদ-মন্দিরের জন্য টাকা উঠালে ব্যানারে লেখা থাকে “মুক্ত হস্তে দান করুন”। বন্যার্তদের জন্য ব্যানার বানালে লিখতে হয় “সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দিন”। এই দুইটার পার্থক্য বুঝুন। দান/ভিক্ষা আর সহযোগীতা এক নয়।

তবে হ্যা, মসজিদ-মন্দির বা মাজারে দান আর কাউকে ভিক্ষা দেওয়া এক বিষয় নয়। তাই মসজিদ-মন্দির, মাজারে যাকাত-ফেতরার টাকা দেওয়া যায় না। যাকাতের টাকা শুধু দরিদ্রদের জন্য। কিন্তু মসজিদ-মন্দিরে দান করা হয় কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে। যে উদ্দেশ্যে দান করে, সেই উদ্দেশ্যের বাইরে তা ব্যয় করার অধিকার মসজিদের মুতাওয়াল্লীদের নেই। এটা সবাইকে বুঝতে হবে। এটা সবক্ষেত্রেই; যেমন- কেউ চিকিৎসার জন্য টাকা চাইলো, আমরা দিলাম, তারপর দেখলাম সে চিকিৎসা না করে বাজার করতেছে, তখন আমরা বিরক্ত হবো। এমন কি নিজের আপন লোকদের যদি জামা-কাপড় কিনতে টাকা দেই, তা না করে অন্য কিছু করলেও আমরা বিরক্ত হয়ে যাই তার প্রতি। কেন? কারণ যেজন্য দেওয়া, তা না করে অন্য কাজে ব্যয় উচিত নয়। এটা কখনোই পছন্দীয় কাজ নয়। সেখানে দানের বিষয়ে কিভাবে মেনে নেওয়া যায়? ধর্মীয় ফতুয়া বাদ দিলাম, এমনিতেও তো এক খাতের বরাদ্দকৃত অর্থ অন্য খাতে ব্যয় অযৌক্তিক ও নীতি বিরুদ্ধ।

মসজিদ, মন্দির, মাজারের অধীনে বিভিন্ন ট্রাষ্ট থাকে, সেখানে যাকাতের অর্থ জমা নেওয়া হয়, অভাবীদের দানের জন্য টাকা জমা নেওয়া হয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সহায়তার জন্য টাকা জমা দেয় মানুষ। সেটা সম্পূর্ণ আলাদা ফান্ড। যাকাতের টাকা যাকাতের খাতে, সাধারণ দানের টাকা সাধারণ ভাবে অসহায়দের জন্য এবং বন্যা-ঝড়ের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য যে সেক্টর থাকে, সেই সেক্টরের টাকা আলাদাভাবেই দুর্যোগের সময় খরচ হয়। সেখানে দান ও সহযোগীতার অর্থ আলাদা আলাদা থাকে। সেই টাকা মসজিদ-মন্দির বা মাজারের টাকা নয়, বরং মাজার, মসজিদ-মন্দিরের মাধ্যমে সংগ্রহ করা টাকা। যেমন অনেকেই মানুষের থেকে টাকা উঠিয়ে অসহায়দের সাহায্য করেন, এর মানে এই না যে, ঐ ব্যক্তি দান নিয়েছেন; বরং তিনি অন্যদের জন্য দান সংগ্রহ করেছেন এবং পরিবেশন করেছেন। মসজিদ, মন্দির বা মাজারের যে ফান্ড এই ক্ষেত্রে, সেটাও তেমন। কিন্তু এটা উল্লেখ থাকতে হবে, যেন মানুষ জেনে বুঝে দান করে এবং সহযোগীতা করে। যাকাতের টাকা, দানের টাকা, সহযোগীতার টাকা আলাদা আলাদা রাখতে হয়। দান বাক্সের টাকা আর সেই ফান্ডের অর্থ এক নয়।

দয়া করে বন্যার্তদের সাময়িক অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের ভিক্ষুক বানিয়ে দিবেন না, তারা আপনাদের অতি আবেগে এই বিষয়ে বিবেকহীনতার এই ভুল কৌশল বুঝতে না পেরে আপনাদের পাঠানো অর্থের জিনিসপত্র গ্রহণ করছেন। তারা জানেও না যে, আপনারা তাদেরকে দান বাক্সের টাকা থেকে ত্রাণ দিতে গিয়ে মনের অজান্তেই ভিক্ষুক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দিচ্ছেন। তারা খারাপ অবস্থায় আছে, তারা এভাবে ভাবতে পারছে না এখন। কিন্তু আপনারা তো ভালো আছেন, আপনারা কিভাবে অতি আবেগে বিবেক বিসর্জন দিয়ে তাদের ভিক্ষুক বানানোর পায়তারা করছেন? আপনি তো আপনার আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবকে ভিক্ষা দেন না বা দান করেন না। তাহলে এদের কেন দান বাক্সের টাকা দিতে চাচ্ছেন? আপনার ঘরেও তো টাকার বাক্স আছে, সেই টাকা থেকে কেন সহযোগীতা করছেন না? আপনার ভার্চুয়াল টাকার বাক্স আছে ব্যাংকে, সেই টাকা কেন দিচ্ছেন না? তাহলে তো দান বাক্সের টাকা ব্যয়ের প্রসঙ্গই আসতো না। আপনি নিজের টাকার বাক্স যত্নে আগলে রেখে মসজিদ-মন্দিরের দান বাক্সের দিকে তাকাচ্ছেন। বিবেক জাগ্রত করুন।

বন্যার্তদের দান বা ভিক্ষা দেওয়া যাবে না। এতে তাদের অপমান করা হবে। তাদের আত্মসম্মানে আঘাত করা হবে। এই আত্মসম্মানের জন্যেই মধ্যবৃত্তরা না খেয়ে মরে, বিনা চিকিৎসায় মরে, তবুও কারো কাছে হাত পাতে না। আর আপনারা তাদের সেই আত্মসম্মানে আঘাত করতে চাচ্ছেন? কিভাবে পারলেন এই ভাবনা মাথায় আনতে? আপনি নাস্তিক হোন বা মুসলিম-হিন্দু, কিন্তু আপনার কোনো অধিকার নাই সম্মানীদের কৌশলে অপমান করার।

যারা এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অসহায়, তারা আমাদের ভাই-বন্ধু। পুরো দেশবাসীর এখন নৈতিক দায়িত্ব তাদের সহযোগীতা করা, যেভাবে নিজের আপন ব্যক্তিদের সহযোগীতা করি তাদের সম্মান বজায় রেখে। নিজের অংশ থেকে তাদের খাবার, বস্ত্র, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যা দান করা হয়ে গেছে বা ভিক্ষুক বা দরিদ্রদের দান করার জন্য যে টাকা রাখা, সেই টাকা এই খাতে ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। এই সময় মনুষত্বের পরিচয় দিন। অনেক দিনমুজুর আর ভিক্ষুকও এই সময় তাদের টাকা বন্যার্তদের সহযোগীতায় দিচ্ছে, সেও ভিক্ষা দিচ্ছে না; বরং মানুষ হিসেবে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করছে। আর আপনি দান করার চিন্তা নিয়ে আছেন! আপনি ত ঐসব ভিক্ষুকদের চেয়ে ছোট মনের মানুষ হয়ে গেলেন, সেটা খেয়াল করেছেন? দান নয়, বরং ত্রাণ বা সহযোগীতা করুন। মসজিদের দান বাক্সের চিন্তা বাদ নিয়ে নিজের টাকার বাক্সে হাত দিন।

হে দয়াময় প্রভু! আপনি বিপদ দিয়েছেন, আপনিই উদ্ধার করবেন। কিন্তু আমাদের বিবেকহীন করে রাখবেন না, আমাদের বিবেক জাগ্রত করুন, আমাদের হৃদয়কে প্রসস্থ করুন; আমরা যেন আমাদের অসহায় ভাই-বন্ধুদের আপন মানুষ ভেবে তাদের পূর্ণ মর্যাদা রক্ষার মাধ্যমেই তাদের সহযোগীতা করতে পারি।

লেখাঃ DM Rahat

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel