শব্দের বিকৃতি ও উপহাস

শব্দের বিকৃতি ও উপহাস

কিশোর বয়সে বন্ধুদের সাথে মজা করে অনেকেই ‘Are You Sure?’ এর উচ্চারণ ‘আর ইউ শুয়োর’ বলেছেন। “শিওর (Sure)” না বলে শুয়োর বলে অর্থই পরিবর্তন হয়ে যেতো। “তুমি কি নিশ্চিত?” এর পরিবর্তে অর্থ দাঁড়াতো যে- “তুমি কি শুয়োর (Pig)?”। সম্ভাবত এখনও অনেকেই মজা করে এমন বলে থাকেন। সাম্প্রতিককালে হিন্দি একটি শর্ট ভিডিও অনেকেই দেখেছেন যেখানে ফুচকা এনে দিয়ে বউকে স্বামী বলতেছে- “তু খা নাগিন (নাগিন তুই খা)”। বউ রেগে তাকালে স্বামী বলে যে- “মেনে বলা- তু খা, না গিন (তুই খা, গুনিস না)”। এভাবে শব্দের বিকৃতি করে অন্যকে নিয়ে যেভাবেই হোক উপহাস করার অনেক উদারহরণ আছে। আমরা সবাই এগুলোর সাথে পরিচিত।

আরবদেশের আরবী ভাষাতেও এভাবে উপহার করা যায়। যেমন- আসসালামু আলাইকুমالسَّلاَمُ) عَلَيْكُمْ) অর্থ আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আর আসসামু আলাইকুম (السَّامُ عَلَيْكُمْ) অর্থ আপনার উপর পাথর বর্ষিত হোক বা মৃত্যু হোক। কাফেরা আসসালামু আলাইকুম না বলে বলতো আসসামু আলাইকুম। তাছাড়া- “র’য়িনা-رَاعِنَا (আমাদের দিকে তাকাও)” এর পরিবর্তে কেউ বললো “র’ঈ’না-رَاعِيْنَا (আমাদের রাখাল)”। আইন হরফের পর ইয়া যুক্ত করে উচ্চারণ করলেই শব্দের বিকৃতি হয়ে যায়। কিন্তু উচ্চারণ প্রায় একই রকম শোনায়।

আশা করি যা বুঝাতে চেয়েছি, তা এতোটুকু ব্যাখ্যায় বুঝে গেছেন সবাই। ঠিক এইভাবেই আরবের কাফেররা হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-কে নিয়ে শব্দের বিকৃতির মাধ্যমে উপহাস করতো। তারা “র’য়িনা-رَاعِنَا (আমাদের দিকে তাকাও)” এর পরিবর্তে ব্যঙ্গ করে রাসূল (সঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলতো “র’ঈ’না-رَاعِيْنَا (আমাদের রাখাল)”। অবস্থা এতোই বাজে রূপ ধারণ করেছিলো যে, সাহাবীগণ র’য়িয়া (আমাদের দিকে দেখুন) সুন্দর করে বললেও বিষয়টা কাফেরদের কারণে বাজে দেখাতো। ফলে স্বয়ং আল্লাহ পবিত্র কুরআনে আয়াত নাজিল করলেন এই ‘র’য়িনা’ না বলতে, আর এর পরিবর্তে উনযুরনা (আমাদের দিকে নজর দিন) শব্দই পরিবর্তন করে দেওয়ার আদেশ দিলেন। যেন কাফেররা উপহাস করার সুযোগ না পায়।

আল্লাহ তা’য়ালা বলেন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَقُوۡلُوۡا رَاعِنَا وَ قُوۡلُوا انۡظُرۡنَا وَ
اسۡمَعُوۡا ؕ وَ لِلۡكٰفِرِیۡنَ عَذَابٌ اَلِیۡمٌ ﴿۱۰۴﴾

অর্থঃ হে বিশ্বাসীগণ! (তোমরা মুহাম্মাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তাকে) ‘র’য়িনা’ বলো না, বরং ‘উনযুরনা’ (আমাদের দিকে নজর দিন) বলো এবং (তাঁর আদেশ) শুনে নাও। আর কাফেরদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। [সূরা বাকারা-১০৪]

এখন কোনো তথাকথিত ইসলামী বক্তা বা আলেম যদি এধরনের শব্দ রাসূল (স:) এর বেলায় ব্যবহার করেন, তবে সে কি করে আর ইসলামী বক্তা থাকেন? সে যেই হোক না কেন। শুধু রাখাল (CowBoy) শব্দ নয়, এধরনের যত শব্দ আছে, যা আল্লাহর রাসূল (সঃ) এর শা’ন মানে আঘাত করে, তা আলেমগণ বলতে পারেন না। যদি কেউ বলেন, তবে তিনি কোনো আলেমই নন; বরং আলেম নামের জালেম।

একই কথা ভিন্ন ভিন্ন শব্দে ও বাক্যে বলা যায়। রাজা-বাদশাহ্দের ব্যবহৃত শব্দ আর সাধারণ মানুষদের কথা বলার ধরন এক নয়। আর সাধারণ মানুষের বেলায় ব্যবহৃত শব্দ আর রাজা-বাদশাহ্দের বেলায় ব্যবহৃত শব্দও এক হয় না। এই সহজ বিষয়টা কে না বুঝে! অথচ এদেশের নামধারী লাখ লাখ মুসলিমরা রাসূল (সঃ) এর শানে বেয়াদবী মূলক শব্দ ও বাক্য শুনে তৃপ্তি পায়!

নবী-রাসূলদের অনেকেই মেশ, ভেড়া, ছাগল এসব পালন করতেন। হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেন- “আমিই উত্তম মেশ পালক”। এই মেশ কি সেই মেশের কথা বলেছেন? না, পথভ্রষ্টদের কথা বুঝিয়েছেন। তিনি পথ হারাদের পথে নিয়ে আসতেন। তাই তিনি উত্তম মেশ পালক। মেশ পালনের জন্য হযরত ঈসা (আঃ) এর সময়কার কাফেররাও উপহাস করতো।

অনেকেই হয়তো জানেন যে, শ্রী কৃষ্ণ গরু পালন করতেন। তাই ঐ সময় যারা শ্রী কৃষ্ণের বিরুদ্ধে ছিলো, তারা তাকে গোয়ালা (রাখাল) বলে উপহাস করতো। অর্থাৎ ভিন্ন ধর্মেও এমন ঘটনা রয়েছে। অর্থাৎ এটা যে অপমান করে বলা হয়, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই। এই যে উপহাস, এটা ১৪ বছরের পুরাতন ইতিহাস নয়, তারও বহু পূর্ব হতেই এই উপহাস চালু ছিলো এবং এখনও চালু আছে।

যারা উক্ত সময়ে কাফেরদের অন্তরভুক্ত ছিলো, তারাই এরূপ শব্দ প্রয়োগ করতো। শুধু একটি-দুইটি শব্দ নয়, এমন হাজারও শব্দ আছে, যা নবী-রাসূলদের বেলায় সেসব শব্দ প্রয়োগ করা বেয়াদবি। আর নবী-রাসূলদের শানে বেয়াদবী করলে সে আর মুসলিম থাকে না। কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তাই খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়, যেন আদব রক্ষা করে শব্দ প্রয়োগ করা যায়। ভুলেও যেন ভুল শব্দ বের না হয়। তাই সবার বক্তৃতা দেওয়াও উচিত না। জনপ্রিয় হওয়া আর জ্ঞানী হওয়া এক বিষয় না। মুসলিমরা না শুধু, মোটামুটি এখন সব ধর্মের ও মতাদর্শের মানুষই জনপ্রিয় ব্যক্তিদের বক্তব্য শুনে। আধুনিক ভাষায় যাকে বলে ভাইরাল ব্যক্তি। জ্ঞানী-গুণীদের কদর করতে জানে না। মূলত বক্তা যেমন, তার শ্রোতাও তেমন।

তবে আরেকটি বড় সমস্যা হলো- সবাই ব্যক্তির সমালোচনায় ব্যস্ত। ফলে এই সমস্যা থেকেই যায়। কারণ ব্যক্তি মারা যায়, হারিয়ে যায়, কিন্তু দর্শন তো থেকে যায়। নবীর শানে বেয়াদবী মূলক শব্দ প্রয়োগ করা কিছু মতাদর্শের লোকদের আদর্শ। তারা সবাই একই মতাদর্শ ধারণ করে ও প্রচার করে। আমাদের উচিত ব্যক্তির সমালোচনা বাদ দিয়ে ভুল দর্শনের ভুলগুলো নিয়ে আলাপ করা। এতে যে ব্যক্তিই ভুল বক্তব্য দিবে, ভুল মতাদর্শ প্রচার করবে, নবীর শানে বেয়াদবী করবে, সাধারণ মানুষ মূহূর্তেই তাদের ধরে ফেলবে এবং তাদের সঙ্গ ত্যাগ করবে।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে নবীর প্রতি আদব রাখার জ্ঞান ও মানসিকতা দান করুন এবং শয়তানী ধারার বক্তাদের বক্তব্যের প্রভাব থেকে হেফাজত করুন।

লেখাঃ DM Rahat.

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel