দান নয়, ত্রাণ

দান নয়, ত্রাণ

ত্রাণ অর্থ দান-দক্ষিণা নয়। ত্রাণ দ্বারা এদেশের মানুষ দান-খয়রাত মনে করে, এটা আমাদেরকে ভুল বুঝানো হয়েছে অথবা আমরা নিজেরাই বুঝার চেষ্টা করিনি। অবস্থা এমন জায়গায় এসেছে যে, আমরা ত্রাণের নামে দান করতে করতে এখন মসজিদের দান বাক্সের টাকাও ত্রাণ হিসেবে দিতে চাচ্ছি।

ত্রাণ অর্থ রক্ষা করা। ইংরেজিতে রেস্কিউ (Rescue)। কারো বাসায় আগুন লাগলো, কেউ পানিতে পড়ে গেলো, কেউ পাহার বা বন-জঙ্গলে হারিয়ে গেলো, একটা বিড়াল কোথাও আটকা পড়লো, কুকুর অসুস্থ হয়ে রাস্তায় পড়ে রইলো- এগুলোকে রেস্কিউ করা বা উদ্ধার করা মানে ত্রাণ করা। পরিত্রাণ শব্দ দেখলেই ত্রাণ অর্থ বুঝতে সহজ হবে। ত্রাণ একটি অধিকারের বিষয়। ধরুন আপনার বাসায় আগুন লাগলো, এখন রাষ্ট্রের থেকে ত্রাণ পাওয়া আপনার অধিকার। ফায়ার সার্ভিস এসে আপনাকে উদ্ধার করলো। এটাই ত্রাণ। ত্রাণ সামগ্রী মানে রক্ষার উপকরণ। এটা মোটেও দানের কিছু নয়।

আবার অনেকে দান না বলে উপহার বা হাদিয়া শব্দটি ব্যবহার করছেন। এটিও যথাযথ নয়। কারণ সেক্ষেত্রে শুধু টাকা বা খাবারই বুঝাবে, রক্ষা করা বুঝাবে না। আর তাছাড়া উপহার পাওয়া আমাদের অধিকার না। ত্রাণ পাওয়া অধিকার আমাদের। অধিকারের কারণে আমরা বিপদে ত্রাণ চাইতে পারি, কিন্তু উপহার চাইতে পারি না, আর দানের তো প্রশ্নই উঠে না।ত্রাণ নেওয়া লজ্জার নয়, দান নেওয়া লজ্জার। উপহার নিলে আবার পাল্টা উপহার দেওয়ার বিষয় থাকে। কিন্তু ‘ত্রাণ’ এ একসাথে উদ্ধার, খাদ্য, বস্ত্র ও চিকিৎসার সু-ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং পুনর্গঠন সব বুঝায়।

আপনাদ প্রতিবেশি বিপদে পড়লে তিনি আপনার থেকে সাহায্য পাওয়ার অধিকার রাখেন, এটা প্রতিবেশির হক। আপনার আত্মীয়-স্বজন, ববন্ধু-বান্ধব তাদের বিপদে আপনার কাছে সহযোগীতা চাইতে পারেন, এটা লজ্জার নয় কিন্তু তারা কেউ আপনার থেকে দান চাইবে না। বিপদে তাদের পরিত্রাণের ব্যবস্থা করা আপনার কর্তব্যের মধ্যে পরে।

ত্রাণ যদি কেউ না পায়, তবে সে তার জন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করতে পারে। ত্রাণ পেতে আন্দোলনও করা যায়। কিন্তু দান না পেলে প্রতিবাদ করা যায় না। বরং দান চাওয়া লজ্জার। যাদের ত্রাণ পাওয়া অধিকার, তাদেরকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করে সামান্য কিছু দান করে শান্তনা দেওয়া অবশ্যই অমানবিক বিষয়। অনেকেই যারা মসজিদ-মন্দিরের দানের টাকা ত্রাণের জন্য দান করার পরামর্শ দিচ্ছেন, তারা কেউ-ই ত্রাণ শব্দের অর্থ জানেন না। ত্রাণ শব্দের অর্থ জানলে কেউ দান-বাক্সের টাকায় ত্রাণের দাবি তুলতে পারতো না।

মানুষকে তাদের অধিকার না দিয়ে, শান্তনা দিয়ে দান দেওয়ার বিষয়টা বিবেকবানরা সমর্থণ করতে পারেন না। বিষয়টা এমন যে- বাপের সম্পত্তি চাচার কাছে, ভাতিজা গেল হক চাইতে, তাকে তার হক বা অধিকারের অংশ না দিয়ে অল্প কিছু টাকা দিয়ে সহযোগীতা করে সবাইকে বলে বেড়ানো যে- “ওর বাপ মরার পর তো ওর সব দায়িত্ব আমিই নিয়েছি।” অথচ তার ভাইয়ের সম্পত্তি এতো বেশি যে, যা ভাতিজা পেয়ে গেলে সেও অন্যদের দান করতে সক্ষম হবে। অথচ ভাতিজার হক মেরে দান করে সমাজের কাছহে মহৎ সাজলো।

আর সমাজের মানুষও এতোই বিবেকহীন যে, ভাতিজার সম্পত্তির কথা জেনেও চাচাকে বাহ্ বাহ্ দিলো ভাতিজার ভরণ-পোষন দেওয়ার জন্য। এখন সেটাই হচ্ছে। যারা বিপদগ্রস্ত, তারা আমাদের আত্মীয়, বন্ধু-ভাই, তাদের অধিকার আছে আমাদের থেকে ত্রাণ পাওয়ার। অথচ আমরা নিজেদের অর্থ-সম্পদ থেকে ত্রাণের ব্যবস্থা না করে, তাদের অল্প কিছু দান করছি এবং অন্যান্য দানের টাকা দিয়েও তাদের উপকারের বুলি ছেড়ে মানবতার বাণী ঝাড়ছি। আসলেই কি আমরা মানবিক! নাকি সেই হক মেরে দেওয়া চাচার মত অমানবিক?

আসুন- বিপদগ্রস্থদের দান নয়, বরং ত্রাণ করি।

বিঃদ্রঃ যারা লেখাটি পড়েছেন, তাদের অনেকেই আছেন মহাজ্ঞানী ও অনেক বেশি মানবিক। তারা এখনও মসজিদ-মন্দিরের দান বাক্সের দিকে তাকিয়ে আছেন ত্রাণ দেওয়ার জন্য, যেন নিজের ঘরে থাকা টাকার বাক্সে হাত দিতে না হয়। তারা আমার বলা অর্থ আর সংজ্ঞা মেনে নিতে পারবেন না। তাই দয়া করে নিজের ঘরে থাকা অভিধান বা Dictionary খুলে ত্রাণ শব্দের অর্থ দেখে নিন। যদি বাড়িতে অভিধান বা ডিকশনারি না থাকে, তবে গুগলে সার্চ দিন- ত্রাণ শব্দের আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ আপনারা পেয়ে যাবেন। আমারটা দেখার দরকার নেই।

লেখাঃ DM Rahat