সম্ভোগ থেকে সমাধি
মহাজ্ঞানী ওশো মানুষের সমস্ত জ্ঞানকে আত্মস্থ করেছে। তবুও তাঁর মনে হয়- এই মহাবিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য তাঁর কাছে অজ্ঞাত!
ওশো তাঁর পাঠাগারে বসে অস্থির হয়ে ওঠে!বুকশেলফ-এ থরেবিথরে সাজানো শ্রীচণ্ডালী, কামচণ্ডালী, বেদ, গীতা, রামায়ণ, তওরাত, জবুর, ইঞ্জিল, গ্রন্থসাহেব, ত্রিপিটক, কোরআন, বোখারী, তিরমিজি, ঈলিয়াড এবং ওডিসি। টেবিলে অগোছালো দ্য এপিক অব গিলগামেশ, প্যারাডাইস লস্ট, ক্রাইম এণ্ড পানিশমেন্ট, দ্য মিজারেবল, সোফির জগৎ, ফাউস্ট, ডিভাইন কমেডি, এবং দ্য ডেথ গড।
ডায়োজিনিস, সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, প্লেটো, গ্যালিলিও, ডারউইন, মার্কস, লাউৎসে, কনফুসিয়াস, শ্রীরাম, শ্রীচৈতন্য, বিবেকানন্দ, বার্ট্রান্ড রাসেল, নিউটন, আইনস্টাইন, কোপারনিকাস, আলী, কালী ও রাম-রহিমের জীবনদর্শন তাঁর মুখস্থ! তাঁদের ও তাঁদের নিয়ে লেখা রাশি-রাশি বইয়ের মাঝখানে বসে ওশো চরমভাবে অস্থির হয়ে ওঠে! মনে হয়- এই এতসব বই, এসবই প্রাণশূন্য! শুষ্ক! এবং অনর্থক! জীবনের কোনো অর্থই সে খুঁজে পায়না। সিদ্ধান্ত নেয়- সমস্ত বইয়ে আগুন জ্বালিয়ে পুড়ে ছারখার করে চলে যাবে অজানার উদ্দেশ্যে, হাটতে থাকবে দুচোখ যেদিকে যায়…।
তখন রাত্রি দ্বিপ্রহর। মোমবাতির আলোটা টিপটিপ করে জ্বলছিল। আচমকা নিভে গেল! সমস্ত ঘর আলোকিত করে আবির্ভূত হলো এক জ্যোতির্ময় নারী!
ওশো বলল- ‘কে তুমি?’
‘আমি জীবন্ত গ্রন্থ।’
‘কেন এসেছ? কি চাও?’
‘কিছু চাইতে আসিনি, দিতে এসেছি।’
‘কি দিতে চাও?’
‘নারীগ্রন্থ।
যে গ্রন্থ পাঠ করলে তুমি খুঁজে পাবে জীবনের উদ্দেশ্য। এবং যে গ্রন্থে রয়েছে মহাবিশ্বের রহস্য!’ ‘কিন্তু, তোমার কাছে এ গ্রন্থ কেন? এতো ভালো গ্রন্থ তো ঈশ্বরের কাছে থাকার কথা! যাইহোক, ওটা আমাকে দাও, আমি পড়তে চাই।’ ‘কিন্তু, এই বই পাঠ করতে গিয়ে পাঠচক্রেই হারিয়ে যেওনা! এ বই পাঠ গন্ধম ভক্ষণতুল্য। পরিণাম মৃত্যু পরবর্তী জীবনে জাহান্নাম!’
মৃত্যুর পর অনন্ত অন্ধকার। মৃত্যু পরবর্তী জীবনের কথা ভাবে না ওশো। সে এই পৃথিবীর সুখ চায়, জীবনের উদ্দেশ্য, এবং মহাবিশ্বের রহস্য জানতে চায়। ওশো বই নেয়, এবং তা পড়তে থাকে…। পড়তে-পড়তে ক্লান্ত হয়, ঘেমে যায়, বিশ্রাম নেয়, আবার পড়ে। বইয়ের ভাজে-ভাজে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, আঙুল, ঠোঁট, জিহ্বাগ্র, নিঃশ্বাস এবং আদিম অঙ্গের ছোঁয়া লাগে। বই ফুলে-ফেঁপে ওঠে। ওশো পড়ে আর তর্জমা করে।
আবারও পড়ে।
বারবার পড়ে। পড়তে ভাল্লাগে। এ বই পড়া শেষ হয়েও হতে চায় না। ওশোর জীবনের উদ্দেশ্য এখন এই বই পড়া। বই পড়ে; কিন্তু, জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পায় না। তবুও পড়ে। পড়তে-পড়তে যখন জীবনরস শেষ, হাত চলেনা, পা চলেনা, আদিম অঙ্গ আর জাগে না, চোখের পাতায় ভাসে না বইয়ের অক্ষর, তখন সে জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পায়। তখন সে মনে করে- আসলে এই পড়া-টড়া কিছুই না। এই ‘কিছুই না’ জীবনের উদ্দেশ্য। এটাই শূন্যে অবস্থান, লা-মোকাম, নির্বাণ, মোক্ষম বা সমাধি।
শত-শত, হাজার-হাজার বই পড়ুয়া, এবং জীবন্ত বই পুড়ুয়া ওশো মৃত্যুর আগে রক্তের অক্ষরে লিখে যায়-
‘জীবন্ত বই পাঠ করাকে সম্ভোগ বলে। সম্ভোগ? -সেতো সমাধি! সম্ভোগ করো, করার ইচ্ছেরে দমিয়ে দাও, দমে যাও, দেখবে আপনাআপনিই জীবনের রহস্য জেনে গেছো, জেনে গেছো মহাবিশ্বের রহস্য। এই রহস্য নিজে অবলোকন করা যায়; অন্যকে দেখানো বা জানানো যায়না।’
– শহিদুল শাহ্