ওলী-আউলিয়া বিরোধী শিয়া মতবাদ
শিয়া মতবাদের সবচেয়ে সুন্দর দিক হল, শিয়ারা আলে মুহাম্মদ অর্থাৎ আহলে বাইত এবং নবীর বংশধরগণকে সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করেন এবং নিজেদেরকে মাওলা আলী (আঃ) এর অনুসারী দাবি করেন। নিঃসন্দেহে এটা উত্তম।
সবারই এই অধিকার ও স্বাধীনতা আছে যে, তারা নিজেদের মতাদর্শ অনুযায়ী জীবন-যাপন করবেন। তাই শিয়াদের বিরোধীতা করা বা তাদের মন্দ দিকগুলো তুলে ধরাকে আবশ্যক মনে করছি না। এটা সূফীবাদের একটি শিক্ষা যে, সূফীবাদীরা অন্যদের দোষ নিয়ে ঘাটাঘাটি করেনা। কিন্তু তারা যখন সূফীবাদীদেরকে শিয়া বানিয়ে ফেলার ফাঁদ তৈরি করে, তখন মানুষকে ফাঁদ সম্পর্কে সতর্ক করা আবশ্যক হয়ে উঠে।
“সাধারণ মানুষদের শিয়া বানানোর ফাঁদ” না বলে শুধু “সূফীবাদীদের শিয়া বানানোর ফাঁদ” কথাটি কেন বললাম? এই প্রশ্নও অনেকের মনে জাগতে পারে। মূলত ওহাবী, খারেজী, কওমী, সুন্নী, আহলে হাদিসপন্থি ইত্যাদি বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষ আহলে বাইতকে খুব বেশি সম্মান করে না, বরং তিন খলিফাসহ অন্যান্য সাহাবীদেরকেই তারা বেশি মূল্যায়ন করেন। তারা আহলে বাইতের প্রতি দুর্বল নন। নবী পরিবারকে ভালবাসাকে তারা ঈমানের অঙ্গই মনে করেনা। অপরদিকে শিয়ারা যেহেতু আহলে বাইতকে বেশি মূল্যায়ন করে এবং তিন খলিফাসহ অনেক সাহাবীকে গালাগালি করে, তাই ওহাবীপন্থিদের ধারে কাছেও ঘেষার সুযোগ পায় না শিয়াপন্থিরা। ওহাবীরা শিয়াদের নাম শুনলেও ঘৃণা করে। শিয়াদের কোনো ভাল কথাও তারা পছন্দ করেনা। ফলে শিয়ারা ওহাবীদের কাছে তাদের দর্শনের প্রচার করার সুযোগ পায় না এবং দাওয়াত দিয়ে শিয়াও বানাতে পারে না।
অপরদিকে সূফীবাদীরাও আলে মুহাম্মদ অর্থাৎ আহলে বাইত এবং নবীবংশের লোকদের সর্বাধিক সম্মান করেন এবং ভালবাসেন। অন্যান্য সকল সাহাবীদের মূল্যায়ন করলেও আহলে বাইতের সদস্যদের সবার উপরে স্থান দেন। তাছাড়া সত্যকে ধারণ করার মানসিকতা থাকায় প্রয়োজনে আহলে বাইতের সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদস্বরূপ তিন খলিফাসহ অনেক সাহাবীদের ব্যাপারে গঠনমূলক সমালোচনাও করেন। কারণ এটা সত্য যে, রাসূল (সঃ) নিজে মাওলা আলী (আঃ)-কে নিজের স্থলাভিষিক্ত করেছিলেন এবং কুরআন ও আহলে বাইতকে আঁকরে ধরার আদেশ দিয়েছিলেন। তাছাড়া পরবর্তীতে সাহাবীদের মধ্যে অনেকেই পূর্বের পথে ফিরে গিয়েছিলেন, অর্থাৎ যারা মনে প্রাণে ইসলাম গ্রহণ করেনি, শুধু মৌখিক স্বীকৃতি দিয়েছিল, তারা রাসূল (সঃ) এর ওফাতের পর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া সুন্নীদের স্বীকৃত গ্রন্থেও তিন খলিফাসহ অনেক সাহাবীদের দোষের বিষয় আলোচিত হয়েছে। ফলে সূফীবাদীদের মধ্যে অনেকেই তা গ্রহণ করেছেন এবং প্রচার করেছেন। ফলে যুগে যুগে অনেক সূফীও বাতিলদের থেকে শিয়া উপাধিও পেয়েছেন।
শিয়ারা এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে। প্রথমে আহলে বাইতের প্রশংসা এবং পরে সাহাবীদের সমালোচনা শুনে সূফীবাদীদের অনেকেই ছদ্মবেশি শিয়াদেরকে পছন্দ করতে শুরু করে। আর শিয়ারা আস্তে আস্তে তাদের কাছে অধিক বিশ্বস্ত হয়ে উঠে। আর শেষে সূফীবাদীদেরকে পূর্ণরূপে শিয়া বানিয়ে ফেলে এবং পরবর্তীতে ঐসব সূফীবাদীদের দিয়েই অন্যান্য সূফীবাদীদেরকে দলে ভীরাতে থাকে। কারণ যখন একজন অল্প জ্ঞানী সূফীপন্থি সাহাবীদের সমালোচনাকে সহজ করতে পারে, তখন তারা ওলী-আউলিয়াদের সমালোচনা আর কিছুই মনে করে না। ফলে তারা ধীরে ধীরে শিয়াদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ওলী-আউলিয়াদেরকে আহলে বাইতের বিরোধী মনে করতে থাকে, যার ফলে ওলী-আল্লাহদের প্রতি ঘৃণা বাড়তে থাকে। আর যখন ওলীদের প্রতি ঘৃণা বাড়তে থাকে, তখন পীর-ফরিকদের প্রতি আর শ্রদ্ধাবোধ থাকেনা এবং শেষে পীরের কাছে বায়াতকেও অস্বীকার করে।
সূফী-ওলীদের প্রতি শিয়াদের বিদ্বেষ মনোভাব শুরু থেকেই। তারা ওলী-আউলিয়াগণকে মানেন না। এমনকি বড়পীর আব্দুল কাদির জিলানী (রহঃ)-কে তারা কাফের মনে করেন। যদিও এদেশের অনেক শিয়ারা খাজা বাবাকে মূল্যায়নের মিথ্যা নাটক করেন, কিন্তু খাজা বাবার সিলসিলায় যারা খাজা বাবার উপরের সারির পীর মাশায়েখগণ আছেন, তাদের অপমান করেন। খাজা বাবাকে মূল্যায়নের এই নাটক শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে খাজা বাবার প্রভাবের কারণে। খাজা বাবাকে মূল্যায়ন না করলে এই উপমহাদেশে তাদের কেউ মূল্যায়ন করবে না, তাই এই মিথ্যা নাটক।
শিয়াবাদ মূলত ওহাবীদের একটি আলাদা ভার্শন। এরা কেউই আধ্যাত্মিকতা মানে না, সুফিবাদ মানে না, গুরুবাদ বা মুর্শিদের কাছে বায়াতকে মানে না। ঠিক যেভাবে ওহাবীরা মুহাম্মদ (সঃ) ও সাহাবীদেরকে মানার দোহায় দিয়ে আউলিয়াদের মানেনা, পীর-মুর্শিদের কাছে বায়াতকে অস্বীকার করে, ঠিক সেভাবেই শিয়ারা মাওলা আলী (আঃ) ও ১২ ইমামের দোহায় দিয়ে আউলিয়াদের আনুগত্যকে অস্বীকার করে, পীর-মুর্শিদের কাছে বায়াতকে মানেনা। সহজভাবে বলতে গেলে তাদের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার কিছুই নেই।
শিয়াদের ফাঁদে অল্প জ্ঞানী সূফীবাদীদের পা দেওয়ার পিছনে মূলত দায়ী কারা? দায়ী বর্তমানের অতিপন্ডিত সূফীবাদীরা। বর্তমানের অনেক অতিপন্ডিত সূফীবাদীরা বাংলায় অনুবাদকৃত ইতিহাসের বই পড়ে নিজেদের বিশাল বড় সূফী ভাবতে শুরু করেছে। তারা ভাবে যে পূর্বের সূফীরা সঠিক ইতিহাস জানতেন না। ফলে তারা এমন সব ইতিহাস তুলে ধরছেন, যা পূর্বের সূফীরা বলেন নাই। বর্তমানে অধিকাংশ পীর ও তাদের ভক্তেরা ইতিহাসকেই সূফীবাদ ভাবতে শুরু করেছেন। আধ্যাত্মিকতা আর ইতিহাস যে এক বিষয় না, এটাও অনেকে বুঝতে চায় না। পূর্বের সূফীরা ইতিহাসকে নয়, আধ্যাত্মিকতাকে প্রচার করতেন। কিছু ইতিহাসকে মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়, তাই পূর্বের সূফীরা সেগুলো জেনেও চুপ থেকেছেন।
বাসর ঘরে কি হয়, তা সব প্রাপ্তবয়স্ক সবাই জানেন, কিন্তু শিশুদেরকে তা জানানো হয় না। তবুও সত্য বলার অযুহাতে যদি কেউ শিশুদেরকে বাসর ঘরের জ্ঞান দিয়ে দেন, তখন সেই ব্যক্তিকে সবাই জাহেল বলবে এবং সেই শিশুগুলোও নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। কারণ এই জ্ঞানের আগেও জ্ঞানের কিছু স্তর আছে, সেগুলো পাড় না করে বাসর ঘরের জ্ঞান অর্জন করলে শিশুরা সেটা হজম করতে পারবে না। ফলে পথভ্রষ্ট হয়ে যানে। ঠিক তেমনি ধর্মীয় অনেক বিষয় আছে, যা সবাইকে বলা যায় না, তা শুধু জ্ঞানীদের জন্য। অজ্ঞানীরা যদি সেসব সত্য জানে, তবে তারা পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। হক বলা মানে এই না, তা সবাইকে বলে বেড়াতে হবে।
তাছাড়া তরিকাপন্থিদের অনেককেই দেখা যায় যে, শিয়াদের কিছু বললে তারা রেগে যান। বলেন যে, “শিয়া মানে অনুসারী, শিয়া মানে মাওলা আলীর শিয়া”। এটা একপ্রকার অজ্ঞতা। শাব্দিক অর্থ আর ব্যবহারিক অর্থের পার্থক্য যারা বুঝেনা, তারা জাহেল। কারণ ওহাবী অর্থও আল্লাহওয়ালা, কারণ ওহাব আল্লাহর একটি নাম। কিন্তু সবাই জানে যে ওহাবী কাদের বলা হয়। শিয়া অর্থ অনুসারী হলেও শিয়াবাদ যে আলাদা একটি মতবাদ, তা সবাই জানার পরও শিয়াদের হয়ে কিছু তরিকাপন্থি সাফাই গায়।
আহলে বাইতকে ভালবাসার কারণে কেউ শিয়া উপাধি দিলে তা অবশ্যয়ই আনন্দের ও সম্মানের। তাই বলে শিয়া মতবাদী হতে হবে এবং শিয়াদের প্রশংসা করতে হবে, এমন নয়। বাতিলদের থেকে শিয়া উপাধি পাওয়া আর নিজেই শিয়াবাদ গ্রহন করা যে এক বিষয় নয়, এটাও বর্তমানের তরিকাপন্থিদের অনেকেই জানেন না। এর জন্য দায়ী অবশ্যই তাদের পীর সাহেবগণ। কারণ অধিকাংশ পীরই নিজে ইতিহাস বিশ্লেষণ করে না, বাজারে যখন কোনো ইতিহাসের নতুন বই বের হয়, তখন সেটা পড়েই ইতিহাস বলা শুরু করে ভক্তদের কাছে। তাছাড়া যখন আত্মজ্ঞান থাকেনা, তখন বাজারে পাওয়া ইতিহাসের বই পড়েই পীরগিরি চালানো লাগে। ফলে তাদের শিষ্যরা হুট করে শিয়া হয়ে যাওয়াও অসস্বাভাবিক বিষয় নয়।
তাছাড়া আরেকটা বিষয় খেয়াল করেছি, তা হল শিয়ারা সূফীবাদীদের ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে থাকে, বন্ধুত্ব করে, সূফীবাদীদের গ্রুপে জয়েন করর, আর টার্গেট করে সূফীবাদীদের হৃদয়েই শিয়াবাদের বীজ বোপন করে। তারা ওহাবী সালাফীদের সামনে টিকতেই পারিনা। অনলাইন প্লাটফর্মেও তাদের টার্গেট এই সূফীবাদীরাই।
যেভাবে অমুসলিম ও মুসলিমের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে, সেভাবে শিয়াদের সাথেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে রাখা যায়, এটা দোষের না। সেক্ষেত্রে উভয়ের আকিদাগত বিষয় স্পষ্ট থাকতে হবে, শিয়াকে বলতে হবে যে তিনি একজন শিয়া। তা না করে নিজের পরিচয় গোপন করে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে ফাঁদে ফেললে ত সে বন্ধু নয়, সে মুনাফিক। তাছাড়া শিয়ারা শিয়া হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন, যেভাবে ওহাবী, কওমী, সূফীবাদীরা নিজেদের পরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করেন। কিন্তু যেসব শিয়ারা ফাঁদ পাতে, তাদেরকে শিয়া বললে তারা রেগে যান এবং নিজেদেরকে স্পষ্টভাবে শিয়া বলে প্রচার করতে দ্বিধাবোধ করেন। অর্থাৎ সূফীবাদীদের সাথে মিশে নিজেদেরকে সূফীবাদী হিসেবে পরিচয় করিয়ে সূফীবাদীদেরকে শিয়াবাদী করে তুলতে চান।
শিয়াদের ঘৃণা করবে হবে, এমনটা নয়। সেটা তাদের দর্শন। ধর্মকে তারা তাদের মত করে পালন করেন, যেভাবে তাদের কাছে সঠিক মনে হয়। কিন্তু সূফীবাদীদের জন্য উচিত হবেনা নিজেদেরকে শিয়াতে রূপান্তরিত করা। আমাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধবের মাঝে যেমন ওহাবী, সালাফী, কওমী, আহলে হাদিসরা আছেন, তেমনি শিয়ারাও থাকতে পারেন। কিন্তু এক্ষেত্রে শিয়াদেরকে শিয়া জেনেই সম্পর্ক রাখতে হবে, তাদেরকে সূফীবাদী মনে করা যাবেনা। পীর ও তাদের যোগ্য ভক্তদের দায়িত্ব হবে তরিকাপন্থিদেরকে সঠিক ইতিহাস জানানোর পাশাপাশি শিয়াবাদ সম্পর্কে অবহিত করা।
হে মাওলা আলী (আঃ)! হে মুশকিল কোশা! হে জগত জননী মা ফাতেমা (আঃ)! হে আমিরুল মুমিনিন ইমাম হাসান (আঃ)! হে ধর্মের রক্ষাকারী মাওলা ইমাম হোসাইন (আঃ)! হে আলে মুহাম্মদ (আঃ)গণ! আপনাদের দোহায় দিয়ে যারা আপনাদেরই প্রকৃত অনুসারী ওলী-আউলিয়াগণের বিরোধীতা করে, তাদের সুপথ দান করুন, আর আমাদের মত সহজ-সরল অযোগ্য নাদান গোলামদেরকে ঐসব প্রতারণাকারী ওলী বিদ্বেষীদের ছলনার ফাঁদ থেকে রক্ষা করুন। হে পাক-পাঞ্জাতন! আপনারা আমাদের সহযোগিতা না করলে আমরা তাদের ছলনার ফাঁদে পা দিয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবো। হে মহাপবিত্র সত্তা! এই অযোগ্য গোলামদের প্রার্থণা কবুল করুন।
লেখাঃ DM Rahat