হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সর্বশ্রেষ্ঠ মোজেযা।
হযরত রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের স্বল্পসংখ্যককে মোজেযা প্রদর্শনের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। যেমন-হযবত ঈসা (আঃ) অন্ধ ব্যক্তিকে চক্ষুদান, কুষ্ঠরোগীকে রোগমুক্তি ও মৃতব্যক্তিকে কবর হতে জীবিত করা। হযরত মূসা (আঃ) হাতের লাঠি মাটিতে প্রদর্শিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সাপ হয়ে যেত।
হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর হাতের আংটির সাহায্যে আকাশ-বাতাস, পশু-পাখী, জ্বিনপরীদের আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য করতেন। হযরত সালেহ (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে পর্বতগাত্র থেকে উন্ত্রীকে বের করতেন। হযরত দাউদ (আঃ) যখন পবিত্র যবুর কিতাব পাঠ করতেন তখন তাঁর সুমধুর কণ্ঠস্বর শ্রবণ করতে পশুপাখী, মাছ পর্যন্ত নদীর কিনারায় ভিড় করতো। হযরত বিশ্বনবী (সাঃ) সশরীরে মিরাজ অভিযান, চন্দ্র-দ্বিখণ্ডিত ও পবিত্র আল- কুরআন অবিকৃত ও অবিনশ্বর-যা সর্বকালের সর্বযুগের চিরন্তন মোজেযা।
নূরুল ঈমান, উমদাতুল ফিকাহ হতে বর্ণিত, যে আদেশ আসার পর পূর্ববর্তী নির্দেশ অকার্যকর ও রহিত হয়ে যায়, তাকে বলা হয় নাসেখ বা রহিতকারী এবং পূর্ববর্তী অ-কার্যকর নির্দেশকে বলা হয় মানসুখ বা রহিত। কুরআন মজিদ অবতীর্ণ হওয়ার পর এমনিভাবে পূর্ববর্তী সকল কিতাব মানসুখ বা রহিত হয়ে গেছে।
পবিত্র কুরআনে আছে-
- (১) আমি রাসূলকে কবিতা শিক্ষা দিইনি এবং তা তার জন্যে শোভনীয় নয়। এটা তো এক উপদেশ ও প্রকাশ্য কুরআন। (সূরা ইয়াসিন, আয়াত-৬৯)।
- (২) রাসূল বললেন-হে আমার পালনকর্তা, আমার সম্প্রদায় এই কুরআনকে প্রলাপ সাব্যস্ত করেছে’। (সূরা ফুরকান, আয়াত-৩০)।
- (৩) নিশ্চয় এই কুরআন একজন সম্মানিত রাসূলের আনীত। (সূরা হাক্বক্বাহ্, আয়াত-৪০)
পবিত্র কোরআনের চ্যালেঞ্জ-
(১) এতদসম্পর্কে যদি তোমাদের কোনো সন্দেহ থাকে যা আমি আমার বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, তাহলে এর মতো একটি সূরা রচনা করে নিয়ে এসো, তোমাদের সেসব সাহায্যকারীদেরকে সঙ্গে নাও-এক আল্লাহকে ছাড়া যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক। (সূরা বাকারা, আয়াত-২৩)
চৌদ্দশত বৎসরের এই নাতিদীর্ঘ সময়ের আবর্তে পবিত্র কুরআনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও কেউ কুরআনের একটি সুরা বা আয়াতের অনুরূপ কোনো রচনাও আবিষ্কার করতে পারেনি, এখনও কেউ পারবে না। মহাপ্রলয়ের সময় পর্যন্ত কোনো মনুষ্যকুলের এই সাহস হবে না।
(২) নিশ্চয় আল্লাহর কাছেই কেয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে, তিনি জানেন, কেউ জানে না আগামীকল্য সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন্ দেশে সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত। (সূরা লোকমান, আয়াত-৩৪)।
(৩) পবিত্র কুরআন কিছু অদৃশ্য সংবাদ ও ভবিষ্যতে ঘটবে এমন অনেক ঘটনার সংবাদ দিয়েছে যা হুবহু সংঘটিত হয়েছে।
(৪) পবিত্র কুরআনে পূর্ববর্তী উম্মত, শরীয়ত ও তাদের ইতিবৃত্ত লিপিবদ্ধ আছে। আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি সত্যগ্রন্থ, যা পূর্ববর্তী গ্রন্থসমূহের সত্যায়নকারী এবং সেগুলোর বিষয়বস্তুর রক্ষণাবেক্ষণকারী। (সূরা মায়েদা, আয়াত-৪৮)
(৫) কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে মানুষের অন্তর্নিহিত বিষয়াদি সম্পর্কিত সংবাদ দেওয়া হয়েছে।
(৬) কুরআনে এমন সব আয়াত আছে যাতে কোনো সম্প্রদায় বা কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে ভবিষ্যবাণী করা হয়েছে।
(৭) কুরআন শ্রবণ করলে মুমিন, অবিশ্বাসী, সাধারণ-অ-সাধারণ নির্বিশেষে সকলের উপর প্রভাব বিস্তার হয়।
(৮) কুরআন শ্রবণ করলে এবং পাঠ করলে বিরক্তি আসে না।
(৯) কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহর, অতএব কিয়ামত পর্যন্ত -এর বিন্দু-বিসর্গ পরিবর্তন -পরিবর্ধন না হয়ে সংরক্ষিত থাকবে।
খাসায়েসুল কোবরা-১ম খন্ডে-আছে, সকল বুদ্ধিজীবীই এই বিষয়ে একমত যে, কুরআন পাক এমন একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী মোজেযা, যার মুকাবিলা করার দুঃসাহস কোনো মানুষের নেই। যদিও-এর মুকাবিলা করার ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, যদি মুশরিকদের কেউ আপনার আশ্রয়ে আসতে চায়, তবে তাকে আশ্রয় দিন, যাতে সে আল্লাহর কালাম শুনে।
হযরত বিশ্বনবী (সাঃ) মদিনার ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলমান এই ত্রি-জাতির মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি, সংহতি, মানবাধিকার ও গোষ্ঠী-কোন্দলে ক্ষত-বিক্ষত, একে অপরের হানাহানিতে রক্তামূত, অনৈক্য ও অসাম্যের পদাঘাতে জর্জরিত ও অত্যাচার-অবিচার দমনে আরব জাতিকে একটি সুসংহত জাতিতে রূপান্তরিত করার যে চেষ্টা এবং একাধিক সম্প্রদায়ের নেতৃত্বদের আহুত করে এক মহা-কংগ্রেসে সকলের সর্বসম্মতিক্রমে ৬২৪ সালে পবিত্র কুরআন শরীফের আলোকে এক মহান ঐতিহাসিক সন্ধিপত্র সম্পাদন করেন। এই সন্ধিপত্র ইতিহাসে “মদিনার সনদ” (Charter of Medina) নামে পরিচিত। উক্ত “মদিনা সনদ” পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান এবং ‘মহাসনদ’ (Magnacarta) নামে আখ্যায়িত।
মদিনাকেন্দ্রিক উক্ত রাষ্ট্রে মুহাজির ও আনসার ব্যতীত ইহুদি, খ্রিস্টান এবং বিভিন্ন ধর্মের সমর্থকরাও বসবাস করত। মদিনায় কমনওয়েলথ, ঐক্য, সংহতি, সম্প্রীতি রক্ষায় কুরআনের আলোকে ৪৭-টি শর্ত সংবলিত মতান্তরে ৫২-টি যুগান্ত সৃষ্টিকারী সনদ বা ঐতিহাসিক ইশতেহার।
উক্ত সনদের প্রায় প্রত্যেকটি ধারাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় নিরলস চেষ্টা করা হয়েছিল। উক্ত সনদ দ্বারা দীর্ঘকালব্যাপী বুয়ার্সের যুদ্ধের অবসান ও আদর্শ রাষ্ট্রের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে মানবাধিকার নীতি ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নীতি প্রবর্তন করা হয়।
লেখা- মুহাম্মদ নাসেরউদ্দিন আব্বাসী