তরিকত কী ও কেন আবশ্যক

তরিকত কী ও কেন আবশ্যক

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) গারে হেরা পাহাড়ের গুহায় ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। এখানে হজরত জিবরাইল আ. আগমন করেন। এখান থেকেই তরিকত বা আধ্যাত্মিকতার উৎসস্থল বলা হয়ে থাকে। তরিকত হল, আল্লাহ ও রাসূল সা.-এর পথে ভ্রমণ করা। তরিকতের মুর্শিদ, যিনি এক অজানা পথের সন্ধান দেন। তরিকতের জ্ঞান হাসিলের প্রথম ধাপ হল, বায়আতে রাসূল গ্রহণ করা, অর্থাৎ পাপ থেকে নিজেকে বিরত রাখার শপথ নেওয়া। পবিত্র কুরআনে আছে- “হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাকো।” (সূরা তাওবা, আয়াত নং-১১৯)

তবে ‘আল্লাহ যদি চান’, আর যখন ভুলে যাও, তখন তুমি তোমার রবের জিকির কর এবং বলো, আশা করি, আল্লাহ আমাকে -এর চেয়েও নিকটবর্তী সত্য পথের হিদায়েত দেবেন। (সূরা কাহাফ, আয়াত নং-২৪)

“হে মুমিনগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর ও আনুগত্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্য থেকে কর্তৃত্বের অধিকারীদের।” (সূরা নিসা, আয়াত নং ৫৯)

“নিশ্চয় আল্লাহর করুণা সৎকর্মপরায়ণদের নিকটবর্তী।” (সূরা আরাফ, আয়াত নং-৫৭)

“তোমরা তোমাদের রবকে ডাকো অনুনয় বিনয় করে ও চুপিসারে। নিশ্চয় তিনি পছন্দ করেন না সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে।” (সূরা আরাফ, আয়াত নং-৫৬)

তরিকা সুফিবাদের একটি গোষ্ঠীর জন্য, বিশেষ করে আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং হাকিকত সন্ধানের অভিপ্রায়ে আধ্যাত্মিক অনুশীলনের জন্য ব্যবহৃত হয়। তরিকার অনুসারীরা মুরিদিন (একবচন-মুরিদ) নামে পরিগণিত। যার অর্থ-অভিলাষী। যেমন-আল্লাহকে জানার এবং ভালোবাসার জ্ঞান কামনা। এই সুফিবাদ উৎকর্ষসাধনের জন্য বিখ্যাত সুফি-দরবেশ এই পন্থাকে সাধারণের নিকট জনপ্রিয় করে তোলেন। শায়খ সানাউল্লাহ পানিপথী রাহ. স্বীয় তাফসির গ্রন্থ “তাফসিরে মাজহারী”-তে ব্যক্ত করেছেন, যে সকল লোক এলমে লা-দুল্লী বা এলমে তাসাউফ অর্জন করে তাঁদেরকে সুফি বলে।

এলমে তাসাউফ হাসিল করা ফরজে আইন বলেছেন। কেননা, এলমে তাসাউফ মন বা অন্তঃকরণকে গায়রুল্লাহ-তে ফিরিয়ে আল্লাহতায়ালার দিকে রুজু করে দেয়। সর্বদা আল্লাহতায়ালার হুজুরী পয়দা করে দেয় এবং কলব বা মন থেকে বদ খাসলতসমূহ দূর করে নেক খাসলতসমূহ পয়দা করে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে দেয়। আত্মশুদ্ধি অর্জনের জন্য এলমে তাসাউফ যে ফরজ।

হজরত ইসমাইল হাক্কি রা. তাঁর “তাফসির রুহুল বয়ানে” উল্লেখ করেছেন, দ্বিতীয় প্রকার এলেম হচ্ছে, এলমে তাসাউফ বা কলব বা অন্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট। এই এলেম অর্জন করা প্রত্যেক মুমিনের জন্য ফরজ। পবিত্র কুরআনে আছে- “তোমাদের প্রত্যেকের জন্য আমি নির্ধারণ করেছি শরীয়ত ও স্পষ্ট পন্থা।” (সূরা মায়েদা, আয়াত নং-৪৮)

শরীয়ত একটি বৃক্ষস্বরূপ। তরিকত তাঁর শাখাপ্রশাখা। মারিফাত তাঁর পাতা এবং হাকিকাত তাঁর ফল। (সিররুল আসরার) হজরত বায়োজিদ বোস্তামী রাহ., হজরত জুনায়েদ বাগদাদী রাহ. বলেন, অর্থাৎ “যে ব্যক্তি কোনো হাক্কানী পীর বা শায়েখ গ্রহণ করেনি, তাঁর শায়খ উস্তাদ হয় শয়তান। শয়তানই তাঁকে গোমরাহ বা বিভ্রান্ত করে দেয়। কাজেই গোমরাহী থেকে বাঁচা যেহেতু ফরজ, সেহেতু হাক্কানী পীর সাহেবের নিকট বায়আত হওয়াও ফরজ”।

হজরত ইমাম আবু হানিফা রাহ. বলেন- “আমি নোমান বিন সাবিত দুটি বছর না পেতাম তবে হালাক হয়ে যেতাম, “লাওলা সানাতানি লাহা লাকা আবু নোমান”। অর্থাৎ যদি আমার পীর সাহেব ইমাম বাকের ও ইমাম জাফর সাদিক রাহ.-এর নিকট বায়আত হয়ে দুটি বছর অতিবাহিত না করতাম, তবে আত্মশুদ্ধি লাভ না করার কারণে গোমরাহ ও হালাক হয়ে যেতাম।

অনুরূপে, হজরত সৈয়দ আবদুল কাদির জিলানী রাহ. সিররুল আসরার ও ফাতহুর রব্বানী, হজরত ইমাম গাজ্জালী রাহ. কিমিয়ায়ে সাআদাত, হজরত মুজাদ্দিদ- ই-আলফেসানী রাহ. মকতুবাদ শরীফ ও হজরত আহমদ কবীর রেফাইয়ী রাহ. আল বুনিয়ানুল মুশাইয়্যদ কিতাবে কলব পরিশুদ্ধ করার জন্য বা এলমে তাসাউফ অর্জনের জন্য কামিল পীরের নিকট বায়আত হওয়ার কথা ব্যক্ত করেছেন।

হজরত জালালউদ্দিন রুমি রাহ. বলেন- “আমি মাওলানা রুমি ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহওয়ালা হতে পারিনি, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার পীর হজরত শামসে তাবরিজ রাহ.-এর নিকট বায়আত হয়ে এলমে তাসাউফ আমল করে এখলাস হাসিল না করেছি।”

বড় পীর আবদুল কাদির জিলানী রাহ. লিখেছেন, “কলব বা অন্তরকে জীবিত বা যাবতীয় ক-রিপু হতে পবিত্র করার জন্য আহলে তালকিন অর্থাৎ পীরে কামেল গ্রহণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য ফরজ”। (সিররুল আসরার, ৫-ম অধ্যায়)

আল্লাহতায়ালা মানুষকে তাঁর এবাদত-বন্দেগী করার জন্য প্রেরণ করেছেন। এই এবাদত-বন্দেগীর মুখ্য উদ্দেশ্য হল, আল্লাহতায়ালার রেজামন্দী আয়ত্ত করা। আল্লাহর বেজামন্দী হাসিল করতে হলে নিজের নফসকে শুদ্ধ রাখতে হবে। সকল প্রকার ছোট-বড়ো গোনাহের কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।

হজরত রাসূল সা.-এর জামানায় মানুষ অতীতের সকল প্রকার পাপ কাজ ত্যাগ করে, এক আল্লাহর রেজামন্দী লাভের অভিপ্রায়ে হজরত রাসূল সা.-এর নিকট এসে বায়আত গ্রহণ করতো। সেসময়ে তাঁরা অতীতের সমুদয় কর্মকান্ডের জন্য অনুতপ্ত হয়ে বিশ্বনবী সা.-কে সাক্ষী রেখে আল্লাহতায়ালার সমীপে তওবা করতো। অতঃপর স্বয়ং হজরত রাসূল সা. তাঁদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। এরই ধারাবাহিকতায় আজও বায়আতের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

পবিত্র কুরআনের ঘোষণা- “আর যারা তোমার কাছে বায়আত গ্রহণ করে, তাঁরা শুধু আল্লাহরই কাছে বায়আত গ্রহণ করে, আল্লাহর হাত তাঁদের হাতের উপর, অতঃপর যে কেউ ওয়াদা ভঙ্গ করলে তাঁর ওয়াদা ভঙ্গের পরিণাম বর্তাবে তারই উপর। আর যে আল্লাহকে দেওয়া ওয়াদা পূরণ করবে অচিরেই আল্লাহ তাঁকে মহা পুরস্কার দেবেন।” (সূরা ফাতহ, আয়াত নং-১০)

“হাঁ, অবশ্যই যে নিজ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে, তবে নিশ্চয় আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে ভালোবাসেন।” (সূরা ইমরান, আয়াত নং-৭৭)

“অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা গাছের নিচে আপনার হাতে বায়আত গ্রহণ করেছিল, অতঃপর তিনি তাঁদের অন্তরে কী ছিল তা জেনে গিয়েছেন, ফলে তাঁদের উপর প্রশান্তি নাজিল করলেন এবং তাঁদেরকে পুরস্কৃত করলেন নিকটবর্তী বিজয় দিয়ে।” (সূরা ফাতহ, আয়াত নং-১৯)

আল্লাহতায়ালা হজরত বিশ্বনবী-বিশ্বনেতা সা.-কে পুরুষেরও নবী ও নারীদেরও নবী করে পাঠিয়েছেন। “হে নবী! যখন মুমিন নারীরা তোমার কাছে এসে এই মর্মে বায়আত করে যে, তাঁরা আল্লাহর সাথে কোনো কিছু শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, তারা জেনে শুনে কোনো অপবাদ রচনা করে রটাবে না, এবং সৎকাজে তারা তোমার অবাধ্য হবে না। তখন তুমি তাঁদের বায়আত গ্রহণ কর এবং তাঁদের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ অতিশয় ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা মুমতাহিনাহ, আয়াত নং-১২)

অতএব যারা আল্লাহ ও রাসূল সা.-এর সন্তুষ্টি হাসিলের অভিপ্রায়ে বায়আত গ্রহণ করবে, আল্লাহর বিধান ও রাসুল সা.-এর সুন্নাত-ই হল, হাক্কানী পীর মুর্শিদের বিধান।

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত, হজরত রাসূল সা. বলেছেন, “যে ব্যক্তি বায়আতের বন্ধন ছাড়াই মৃত্যুবরণ করলো, সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করলো।” (মুসলিম শরিফ)

সুতরাং আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূল সা.-এর সন্তোষ হাসিলের উদ্দেশ্যে যে বা যারা তরিকতের ওপর আমল-এবাদত করার জন্যে হাক্কানী কামেল ব্যক্তির নিকট বায়আতে-রাসূল সা. গ্রহণ করেছেন। তিনি সর্বদা একজন হাক্কানী কামেল মুর্শিদের অধীনে থাকেন। বিধায় শয়তান তাঁকে ধোঁকা দিতে পারে না। “যে রাসূলের আনুগত্য করলো, সে আল্লাহরই আনুগত্য করলো। আর যে বিমুখ হল, তবে আমি তোমাকে তাঁদের উপর তত্ত্বাবধায়ক করে প্রেরণ করিনি।” (সূরা নিসা, আয়াত নং-৮০)

ইসলাম ধর্মের তরিকা হল, বিলায়তের মহা পান্ডিত্য অর্জনের পথ। আল্লাহতায়ালার ওলি, ইমামদের প্রবর্তিত বিভিন্ন এবাদতের পথ তরিকতের সিলসিলা। সারা পৃথিবীতে প্রায় চার’শ তরিকতের সিলসিলা বিদ্যমান। উক্ত তরিকা বা সিলসিলা সাহাবা, আহেল-বায়েত-এর মাধ্যমে হজরত রাসূল সা. পর্যন্ত সংযুক্ত হয়েছে।

কালক্রমে বিখ্যাত ওলিদের অবলম্বন করে নানা তরিকা বা সিলসিলা গড়ে ওঠে। সেগুলির মধ্যে কয়েকটি তরিকা খ্যাতিলাভ করেছে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রাহ. বলেন-

(১) আমাদের সোহবত এবং তরিকত ও সুলুক হাসিল করার সিলসিলা বিশুদ্ধ এবং মিলিত ও ধারাবাহিক সনদের মাধ্যমে হজরত রাসূল সা. পর্যন্ত সাব্যস্ত আছে। মাঝখানে কোনো বিচ্ছিন্নতা নেই। সকল তরিকতের নির্দিষ্ট আদব ও অজিফার সূরত সরাসরি তাঁর (সা.)-এর কাছ থেকে সাব্যস্ত নয়। এই দূর্বল বান্দাহ ওয়ালীউল্লাহ দীর্ঘ সময় ধরে স্বীয় সম্মানিত পিতা শায়খে আজল শাহ আবদুর রহিম রাহ.-এর সোহবত হাসিল করেছি। তাঁর কাছ থেকে এলমে জাহেরী এবং তরিকতের আদব শিখেছি এবং তাঁর কারামতসমূহ দেখেছি। (রাসায়েলে শাহ ওয়ালিউল্লাহ রাহ.)

(২) রুহানীভাবে আমার বায়আত, সোহবত, দরবেশী, ফয়জানে তাওয়াজ্জুহ এবং তালকিনের তাআল্লুক হজরত বিশ্বনবী সা.-এর জাতে পাক থেকে হাসিল হয়েছে। এর ব্যাখ্যা হল যে, আমি “আলমে রুইয়া (স্বপ্নজগতে)-তে দেখেছি যে, আমি হজরত রাসূল সা.-এর খেদমতে হাজির হয়েছি এবং তাঁর সামনে বসা। তিনি (সা.) মেসালী সুরতের অবয়বে ফয়েজ দান করলেন।

  • প্রথম সূরতে শরীর মোবারকের উঁচু-নিচুর মধ্যবর্তী অংশসমূহে লেবাস ছিল, যার দ্বারা শরীর মাখরুতী থাকে। এই সূরত নবী করীম সা.-এর খুসূরী নিসবতের উপমা।
  • দ্বিতীয় সূরতকে জিসমে মাদুরী মনে হয়। যার একটি থালা জমিনে রাখা, যার উপর লাকড়ি পড়ে আছে। এটা ঐ সাধকগণের উপমা, যার জজবায় অতিরিক্ত হিসসা পায়নি।
  • তৃতীয় সূরত হল, কাদরী, যা দ্বিতীয় সূরতের সাথে সাদৃশ্য মনে হয়। যেমন-একটি লাকড়ি জমিনে পড়ে আছে এবং থালা তাঁর উপর আছে। (আল-ইনতিবাহ)

বর্তমান বিশ্বের জনপ্রিয় তরিকাগুলো হল, কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, মুজাদ্দেদীয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া, কলন্দরিয়া, বেকতাশিয়া, মাদারিয়া, কুবরাইয়া, মৌলভী, রাজ্জাকিয়া, নিমাতুল্লাহি, সেনুসা, শাথিলিয়া, কুবরাভিয়া, মাদিনিয়া, শাজুলিয়া, শাত্তারিয়া, ওয়ারেসী, আহসানিয়া, মাইজভান্ডারী, দেওবন্দী, তাবলিগী, মুহাম্মদী, ওয়সী, সালমানিয়া, বারিয়া- হামেদীয়া তরিকা প্রভৃতি। (সীরাতুল মাশায়েখ)

লেখা- মুহাম্মদ নাসেরউদ্দিন আব্বাসী

আরো পড়ুনঃ