খাজা উসমান হারুনীর জীবনী ও আধ্যাত্মিক কর্ম

0

খাজা উসমান হারুনীর জীবনী ও আধ্যাত্মিক কর্ম

খাজা উসমান হারুনী (রহঃ): (১১০৭ – ১২২০) ছিলেন ভারতে ইসলামের একজন প্রাথমিক আধুনিক ওয়ালি বা সুফি সাধক, শাহসুফি হাজী সৈয়দ শরীফ শাহ্ জিন্দানির উত্তরসূরি বা খলিফা, চিশতী আদেশের সিলসিলার ষোড়শ লিঙ্ক এবং সুলতানুল হিন্দ, আতায়ে রাসুল, গরীবে নেওয়াজ, শাহসুফি খাজা সৈয়দ মঈনুদ্দীন চিশতী আল সানজরী (রহঃ) পীর ও মুর্শিদ

জন্ম:
হারুনী ইরান দেশের হারুনে জন্মগ্রহণ করেন তার জন্ম ৬ই মে, ১১ই রমজান, ১১০৭ খ্রিস্টাব্দ, ৫০০ হিজরী, ৫১৪ বঙ্গাব্দে হয়েছিল। তিনি আবু নূর ও আবু মনসুর নামেও পরিচিত ।

জীবনের প্রথমার্ধ:-
তিনি যখন যুবক ছিলেন, তখন তিনি চির্ক নামে এক রহস্যবাদীর সাথে দেখা করেছিলেন। এই সমিতি তার জীবনে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। ফলস্বরূপ, তিনি একটি উচ্চতর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবন খোঁজার সিদ্ধান্ত নেন । হারুনী পরে জিন্দানির সাথে দেখা করেন, যিনি চিশতী আদেশের একজন রহস্যবাদী এবং সাধক ছিলেন এবং তার আধ্যাত্মিক শিষ্য হিসাবে নথিভুক্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন । জিন্দানি তার মাথায় চার ধারের টুপি রেখে তার অনুরোধ মেনে নেয় । জিন্দানি তাকে বলেছিলেন যে চার প্রান্তের টুপি নিম্নলিখিত চারটি জিনিসকে বোঝায়,
প্রথম হল এই দুনিয়ার ত্যাগ
দ্বিতীয়টি হল পরকালের দুনিয়া ত্যাগ
তৃতীয়টি হল নফসের কামনা-বাসনা ত্যাগ করা
চতুর্থ হল আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য সব কিছুর ত্যাগ

রহস্যময়:-
হারুনী তার আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শকের সান্নিধ্যে ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন । এই সময়কালে, তিনি তপস্বী অনুশীলন এবং প্রার্থনায় নিযুক্ত ছিলেন । সময়ের সাথে সাথে তিনি অনেক আধ্যাত্মিক কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন । জিন্দানি তাকে এগিয়ে যেতে এবং সত্যের সুসমাচার ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য পথপ্রদর্শক বলেছিলেন ।

চিশতী ধারার ঐতিহ্যবাহী সিলসিলা (আধ্যাত্মিক বংশ) নিম্নরূপ:-

  • ১. হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রহঃ)
  • ২. হযরত হাসান আল বসরী (রহঃ)
  • ৩. শাহসুফি সৈয়দ আব্দুল ওয়াহিদ বিন যায়েদ আবুল ফজল (রহঃ) (একজন প্রাথমিক সুফি সাধক )
  • ৪. শাহসুফি সৈয়দ আল ফুধাইল বিন আইয়্যাদ (রহঃ)
  • ৫. শাহসুফি সৈয়দ ইব্রাহিম বিন আদহাম (রহঃ) (একজন কিংবদন্তি প্রথম দিকের সুফি তপস্বী )
  • ৬. শাহসুফি সৈয়দ হুদাইফাহ আল মারআশি (রহঃ)
  • ৭. শাহসুফি সৈয়দ আমিন উদ্দীন আবু হুবায়রা বশরী (রহঃ)
  • ৮. শাহসুফি সৈয়দ মুমশাদ দিনওয়ারি আল আলাভী (রহঃ)
  • ৯. শাহসুফি সৈয়দ আবু ইসহাক শামী চিশতী (রহঃ) (চিশতী আদেশের প্রতিষ্ঠাতা)
  • ১০. শাহসুফি সৈয়দ আবু আবদাল চিশতী (রহঃ)
  • ১১. শাহসুফি সৈয়দ নাসির উদ্দীন আবু মুহাম্মদ চিশতী (রহঃ)
  • ১২. শাহসুফি সৈয়দ আবু ইউসুফ বিন সামান চিশতী (রহঃ)
  • ১৩. শাহসুফি সৈয়দ মওদুদ চিশতী (রহঃ)
  • ১৪. শাহসুফি হাজী সৈয়দ শরীফ শাহ্ জিন্দানী চিশতী (রহঃ)
  • ১৫. শাহসুফি খাজা সৈয়দ উসমান হারুনী চিশতী (রহঃ)
  • ১৬. সুলতানুল হিন্দ, আতায়ে রাসুল, গরীবে নেওয়াজ শাহসুফি খাজা সৈয়দ মঈনুদ্দীন হাসান চিশতী আল সানজরী (রহঃ)

খাজা উসমান হারুনীর খলিফায়ে আযম:-

  • ১. সুলতানুল হিন্দ, আতায়ে রাসুল, গরীবে নেওয়াজ শাহসুফি খাজা সৈয়দ মঈনুদ্দীন হাসান চিশতী সানজরী (রহঃ)
  • ২. শাহসুফি খাজা সৈয়দ জালাল উদ্দীন মখদুম আবদাল চিশতী (রহঃ)
  • ৩. শাহসুফি শেখ খাজা সৈয়দ নাজিম উদ্দীন সাফরি চিশতী (রহঃ)
  • ৪. শাহসুফি শেখ সৈয়দ মুহাম্মদ তুর্ক আয়মান চিশতী (রহঃ)
  • ৫. শাহসুফি খাজা সৈয়দ সাইফুল মুলক চিশতী (রহঃ)
  • ৬. শাহসুফি খাজা সৈয়দ উসমান আলী শাহ চিশতী (রহঃ)
  • ৭. শাহসুফি কাজী সৈয়দ গুদরি শাহ্ চিশতী (রহঃ)

হযরত উসমান হারুনী (রহঃ) ও হযরত খাজা সাহেবের পরস্পর পরস্পরকে অনুসন্ধান:- হযরত খাজা সাহেব দীর্ঘকাল যাবত নানাদেশে ভ্রমনের পর পুনরায় তাঁহার পীরের সহিত সাক্ষাত করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন। পক্ষান্তরে, হযরত ওসমান হারুনী (রহঃ) ও দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাঁহার প্রিয় মুরিদ হযরত খাজা সাহেবের আদর্শনে অশান্তি ভোগ করিতেছিলেন; কিন্তু এতদুভয়ের কে কোথায় আছেন তাহা ইহাদের কাহারই জানা ছিল না। তাই উভয়ই অনিদিষ্টিভাবে উভয়ের সন্ধানে নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। হযরত ওসমান হারুনী (রহঃ) তাঁহার খাদেম ফখরুদ্দীনকে সঙ্গে লইয়া প্রিয় মুরিদ হযরত খাজা সাহেবের সন্ধানে নানাদেশে ঘুরিয়া পারস্যের একটি জায়গায় উপস্থিত হইলেন।

তিনি সারাদিন পথশ্রমে ক্লান্ত হইয়া একটি বাগানের পার্শ্বে তাঁবু খাটাইয়া সেখানেই রাত্রি যাপনের ইচ্ছা করিলেন এবং খাদেম ফখরুদ্দীনকে বলিলেন, লোকালয় হইতে একটু আগুন লইয়া আস, আমরা কিছু রুটি তৈয়ার করতঃ আহার করিব। ফখরুদ্দীন কিছুদূর গমনের পর দেখিতে পাইলেন যে, একস্থানে বিরাট একটি অগ্নিকুন্ড, তাহাতে দাউ দাউ করিয়া আগুন জ্বলিতেছে। আর কতকগুলি লোক তাহার চারিপার্শ্বে ঘুরিয়া নৃত্য করিতেছে। কেহবা মন্ত্রপাঠ করিতেছে আর মাঝে মাঝে মাথা নোয়াইয়া অগ্নিকুন্ডকে প্রণাম করিতেছে। কান্ড দেখিয়া তিনি অবাক হইয়া গেলেন। কেননা ইতোপূর্বে তিনি কখনো অগ্নিপূজা দেখেন নাই। যাহা হউক ঐ লোকদের নিকট একটু আগুন চাহিলেন।

বলিলেন, আমাকের একটু আগুন দাও, উহা দ্বারা রুটি তৈয়ার করিব। তাহার কথায় লোকগুলি ভীষণভাবে চটিয়া গেল। বলিল তুমি কোথাকার বেয়াকুব? ইহা আমাদের উপাস্য দেবতা, সাধারণ অগ্নি নহে যে, তোমাকে রুটি পাক করিতে দেওয়া যায়। তুমি ভাগ এখান হইতে। এই ভাবে অগ্নি আনিতে ব্যর্থ হইয়া ফখরুদ্দীন ফিরিয়া গিয়া হযরত ওসমান হারুনী (রহঃ) এর নিকট সমস্ত বৃত্তান্ত ব্যক্ত করিলেন। তিনি খাদেমের কথা শুনিয়া অগ্নিপূজকদের নিকট চলিয়া গেলেন। তিনি তাহাদের দলপতিকে ডাকিয়া বলিলেন, তোমরা সর্বশক্তিমাণ আল্লাহতায়ালাকে ভুলিয়া গিয়া এইভাবে অগ্নিপূজা করিতেছ কেন? দলপতি বলিল, অগ্নিই আমাদের উপাস্য।

আমাদের ধর্মগ্রন্থে লিখিত আছে যে, অগ্নিপূজা করিয়া অগ্নিকে সন্তুষ্ট করিলে দুনিয়ায় তাহার কোন আশাই অপূর্ণ থাকে না এবং পরকালেও সে নরকের অগ্নি হইতে রক্ষা পাইবে। হযরত ওসমান হারুনী (রহঃ) বলিলেন, ইহা তোমাদের অত্যন্ত ভুল ধারণা। শতবর্ষ পর্যন্ত অগ্নির উপাসনা করিলেও অগ্নি তোমাদের কোন উপকার করিতে পারিবে না। কেননা তাহার মানুষের মঙ্গলামঙ্গলের ব্যাপারে কোন শক্তিই নাই। উহার রহিয়াছে শুধু আল্লাহর হাতে। আল্লাহতায়ালাই মানুষের মঙ্গলামঙ্গল করেন এবং অগ্নি তাঁহারই সৃষ্টি একটি বস্তু মাত্র। তাহা সত্ত্বেও যদি তোমরা অগ্নিকে তোমাদের ধারণা মতে জ্ঞান ও শক্তিসম্পন্ন বস্তু মনে কর, তবে আমার কথা মত তোমাদের কেহ তাহার একখানা হাত অগ্নির মধ্যে প্রবেশ করাইয়া দাও।

তারপর তোমরা অগ্নি উপাসক বলিয়া অগ্নি যদি খাতির করিয়া ঐ হাতখানা দপ্ত না করে তবে বুঝিবে যে, তোমাদের কথা সত্য। দলপতি বলিল, তাহা কিরূপে সম্ভব? অগ্নির ধর্মই হইল প্রজ্বলিত করা। সে তো যাহা কিছুই পায় তাহাকেই জ্বালাইতে পারে। হযরত ওসমান হারুনী (রহঃ) বলিলেন, না অগ্নির কখনই সেই ক্ষমতা নেই। যদি সর্ব শক্তিমান আল্লাহতায়ালা অগ্নিকে বিরত রাখেন তবেই সে জ্বালাইতে পারিবে না। যেমন আমি আল্লাহতায়ালাকে উপাস্য বলিয়া স্বীকার করি। অতএব আমি যদি অগ্নির মধ্যে প্রবেশ করি তবে তাঁহার নিদের্শে অগ্নি নিশ্চয়ই আমাকে প্রজ্বলিত করিবে না বা আমি যদি কাহারও জন্য সুপারিশ করি তবে আশা করি তাহাকেও সে দম্বীভূত করিবে না। দলপতি শুনিয়া বলিল, ইহার প্রমাণ দেখাইতে পারিলে তোমার কথা বিশ্বাস করিব। সঙ্গে সঙ্গে হযরত ওসমান হারুনী (রহঃ) অগ্নিপূজকদের একটি ছেলেকে হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করিলেন। তাঁহার কান্ড দেখিয়া অগ্নিপূজকগণ হায়। হায়। করিয়া উঠিল।

তাহারা ভাবিল যে, লোকটি অজ্ঞতা এবং জেদের বশে বৃথাই অকালে প্রাণ হারাইল। এমন রেওকুফ ও নির্বোধ কোথাও দেখা যায় না; কিন্তু লোকটি যে তাদের ছেলেকে লইয়া আগুনে ঢুকিল এজন্য তাহারা ক্রোধে ও ক্ষোভে অস্থির হইয়া গেল। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আল্লাহর অপূর্ব মহিমাবলে হযরত ওসমান হারুনী (রহঃ) ঐ ছেলেটিকে লইয়া স্মিতহাস্যে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় অগ্নিকান্ডের মধ্য হইতে বাহির হইয়া আসিলেন। অগ্নিপূজকগণ এই দৃশ্য দেখিয়া বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে তাঁহার দিকে তাকাইয়া রহিল। বলা বাহুল্য যে, এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করিয়া মুহূর্তে উহাদের মনোভাব পরিবর্তিত হইল এবং তন্মহূর্তে একসাথে প্রায় চারিশত লোক অগ্নিপূজা পরিত্যাগ করিয়া হযরত ওসমান হারুনী (রহঃ) – এর হস্তে ইসলাম গ্রহণ করিল । হইতে অন্যত্র চলিয়া যাইতেন। তিনি যখন সফরের মধ্যে থাকিতেন, তখনও রাত্রি জাগিয়া ইবাদাত ও যিকির-আযকারে বিরত হইতেন না। একাধারে দীর্ঘদিন এক অজুতেই এশার নামায ও ফজরের নামায আদায় করিতেন। তদুপরি প্রত্যহ রোযা রাখিতেন এবং সামান্য পানি ও একটি মাত্র রুটি দ্বারাই ইফতার করিতেন। দিবা-রাত্রির মধ্যে দুইবার করিয়া কোরআন শরীফ খতম করিতেন।

অপরদিকে হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) তাঁহার পীরের সন্ধানে বাহির হইয়া যখন আফগানিস্তানের অর্ন্তগত হারীতে অবস্থান করিতেছিলেন। তখন তাঁহার বিভিন্ন গুণাবলী বিশেষতঃ কাশফ ও কারামাতের কথা বিশেষ ভাবে প্রচালিত হইয়া যাওয়ায় চারিদিক হইতে অসংখ্য লোক দলে দলে তাঁহাকে দেখিতে আসিতে লাগিল; সুতরাং বাধ্য হইয়া তাঁহাকে অতি তাড়াতাড়ি হীরাত শহর পরিত্যাগ করিয়া সবজা শহরে চলিয়া যাইতে হইল। ঐ শহরের শাসনকর্তা ছিল জনৈক শিয়া সম্প্রদায়ের লোক। সে হুজুরে পাক (দঃ) এর প্রতি বিদ্বেষ ভাব পোষণ করিত। শাসনকর্তা তাহার প্রধান চারিজন সহচরের নাম রাখিয়াছিল, হযরত সিদ্দিকে আকবর (রঃ), হযরত ফারুকে আযম (রঃ), হযরত উসমানে যীন নূরাইন (রঃ), হযরত আলী কারামাল্লাহ্ (রঃ) । শহরে এই ঘোষণা জারী করিয়া দিয়াছিল যে, কোন লোক যেন তাহার সন্তানদের এই চারিটি নামের কোন একটি নাম না রাখে। তারপর যদি ঐরূপ নাম রাখিত তবে তাহাকে সে শিরচ্ছেদ করিয়া ফেলিত। হযরত খাজা সাহেব একদা ঘুরিতে ঘুরিতে ঐ শাসনকর্তার একটি বাগানে যাইয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন।

ঘটনাক্রমে শাসনকর্তা নিজের বাগানে অপরিচিত লোক দেখিয়া ক্রোধে অগ্নিশর্মা হইয়া পড়িল। সে বলিল, কাহার হুকুমে তুমি এখানে আসিয়াছ? প্রাণের আশা থাকিলে এই মুহূর্তে এখান হইতে চলিয়া যাও। হযরত খাজা সাহেব লোকটির কথা শুনিয়া ও অবস্থা দেখিয়া তাহার প্রতি জ্বালালী নজরে দৃষ্টিপাত করিলেন। সেই দৃষ্টির তেজ সহ্য করিতে না পারিয়া লোকটি থর থর করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে ভূমিতে লুটাইয়া পড়িল। লোকটি বুঝিতে পারিল যে, এই ব্যক্তি কোন সামান্য লোক নহে। তাঁহার দৃষ্টির তেজেই এ অবস্থা ঘটিয়াছে। এইরূপ মনে করিয়া সে তখনই তাঁহার নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করিল ও খাঁটি দিলে তাঁহার নিকটে তওবাহ করিয়া ইহার পর হযরত ওসমান হারুনী (রহঃ) ঘটনাস্থল হইতে বিদায় গ্রহণ করতঃ তাঁহার গন্তব্যস্থলের দিকে যাত্রা করিলেন। তাঁহার অভ্যাস এইরূপ ছিল যে, কোথাও তাঁহার অধিক প্রশংসা আরম্ভ হইলে বা অনেক লোক তাঁহার নিকট আসিয়া ভীড় করিতে থাকিলে তিনি তাড়াতাড়ি সেখানে সুপথে ফিরিয়া আসিল।

অতঃপর সে তাঁহার নিকট দীক্ষাগ্রহণ করতঃ কালক্রমে একজন বিখ্যাত অলীরূপে গণ্য হইলেন। অতঃপর হযরত খাজা সাহেব তথা হইতে বিদায় গ্রহণ করতঃ উশনগরে চলিয়া গেলেন। তথাকার বহুসংখ্যক লোক তাঁহার নিকট মুরীদ হইয়া ফায়েজ ও বরকত লাভ করিল। উশনগরে আবা হাফিজ নামক মাদ্রাসায় কুতুবুদ্দীন নামক জনৈক অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র অধ্যয়ন করিতেন। তিনি হযরত খাজা সহেবের সুনাম সুখ্যাতি ও গুণাবলীর কথা শুনিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাত করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন।

অবশেষে তিনি স্বীয় ওস্তাদের অনুমতি লইয়া হযরত খাজা সাহেবের সহিত সাক্ষাত করিলেন। তাহাকে দেখামাত্রই তাঁহার মনে এক অনির্বচনীয় ভক্তি ও শ্রদ্ধার ভাব জাগরিত হইল; সুতরাং তিনি তখনই তাঁহার নিকট মুরিদ হওয়ার বাসনা জানাইলেন। পক্ষান্তরে, হযরত খাজা সাহেব (রহঃ) ও হযরত কুতুবুদ্দীনের চেহারায় এমন একটি প্রতিভার নিদর্শন লক্ষ্য করিলেন যে, তাঁহার উপরে তাঁহার বিশেষ আকর্ষণ এবং স্নেহের উদয় হইল।

হযরত খাজা সাহেব ও হযরত উসমান হারুনী (রহঃ) এর পরস্পর সাক্ষাত লাভ:-
হযরত খাজা সাহেব (রহঃ) বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করিতে করিতে যখন তিনি নিশাপুর আসিলেন, অপরদিকে তাঁহার পীর হযরত ওসমান হারুনী (রহঃ)-ও প্রায় একই সময় নিশাপুরে প্রত্যাবর্তন করিলেন। এই সংবাদ হযরত খাজা সাহেবের কর্ণগোচর হইলে তিনি আর মুহূর্তে মাত্র বিলম্ব না করিয়া পীরের সহিত সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে দ্রুত রওয়ানা হইলেন। যথাসময়ে উভয়ের মধ্যে সাক্ষাত ঘটিল এবং উভয়েই আনন্দে আত্মহারা হইয়া পরস্পরে আলিঙ্গনাবন্ধ হইলেন । দুই জনের চক্ষু হইতে আনন্দাশ্রু ঝরিতে লাগিল।

ভ্রমণ:-
হারুনী প্রচারের জন্য ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি বুখারা, বাগদাদ , ফালুজা , দামেস্ক , ভারত এবং মক্কা ও মদিনা সহ অনেক দেশ ও শহর পরিদর্শন করেন। তিনি উমরাহ হজ্ব পালন করেন ।

প্রায় সব শহরেই তিনি সুফি ও দরবেশদের কাছে যেতেন । ঊশ যাওয়ার পথে ওশের শেখ বাহাউদ্দিনের সাথে দেখা হয় । বাদাকশানে পৌঁছে তিনি বাগদাদের জুনায়েদের একজন পরিচারকের সাথে সাক্ষাৎ করেন।

তার ভ্রমণের সময়, তার সাথে ছিলেন খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী, যিনি তার টিফিনের ঝুড়ি বহন করতেন।
সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশের শাসনামলে হারুনী ভারত সফর করেন; হজের জন্য আরবে ফেরার আগে। ভারতের বিহারশরিফের কাছে বেলচিতে তিনি অবস্থান করেন এবং প্রার্থনা করেন ।

মৃত্যু:-
হারুনী ৩রা ডিসেম্বর, ৫ই শাওয়াল, ১২২০ খ্রিস্টাব্দ, ৬১৭ হিজরী, ৬২৭ বঙ্গাব্দে তিনি মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর উরস প্রতি বছর শাওয়ালের ১৫ ও ১৬ তারিখে বিহার শরীফ নালন্দার বেলচিতে অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর আশীর্বাদ সমাজের প্রতিটি স্তরের এবং প্রতিটি চিন্তাধারার লোকেরা আমন্ত্রিত। 21 শতকের প্রথম দিকে এটি ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত তার প্রকৃত সমাধি মক্কায় ছিল। বেলচির মাজারটি হল উসমানী চিল্লাহ (একটি চিল্লা হল একটি দাফনবিহীন স্মৃতিসৌধ)। এই মাজারটিকে উসমানের আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক এবং তাঁর আশীর্বাদের উত্স হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

চিল্লা শরীফ:-
জানা যায়, হারুনীর একজন মুরিদা ওয়ালিয়া তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে তার মৃত্যুর পর তার কবর তার পায়ের নীচে থাকবে, কিন্তু অবশেষে হারুনী আরবের মক্কায় মারা যান । তার প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য, হারুনী আবারও বেলচিতে উপস্থিত হন এবং মুরিদাকে তার মাজার তৈরি করার আদেশ দেন এবং তার মৃত্যুর পরে, তাকে বেলচিতে হারুনীর মাজারের নীচে সমাহিত করা হবে। তাঁর চিল্লার পাশে ওয়ালিয়ার সমাধি নির্মিত হয়েছিল। গত 650 বছর ধরে, প্রতি বছর একটি বার্ষিক উরস অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

প্রথম উরস অনুষ্ঠানটি শাহসুফি সৈয়দ ফরিদ উদ্দীন মখদুম তাভায়েলা বুখশ (রহঃ) (প্রথম সাজ্জাদানশীন) দ্বারা স্মরণীয় (উৎপত্তি) হয়েছিল। তার মাজার চাঁদপুরা, বিহার শরীফে রয়েছে। তিনি ছিলেন নূর ইব্রাহিমের পুত্র ( নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার ভাগ্নে ) এবং ফরিদ উদ্দীন তাভায়েলা বুখশ বিহারে চিশতি নিজামী আদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি ছিলেন নূর কুতুবে আলম পাণ্ডবীর ভাতিজা ও শিষ্য। তিনি আলাউল হক পাণ্ডবীর (মখদুম আশরাফ জাহাঙ্গীর সিমনানীর পীর) শিষ্য ছিলেন।

তিনি আখি সিরাজ আইনে হিন্দের শিষ্য ছিলেন এবং তিনি নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার (মেহবুব ই ইলাহী) শিষ্য ছিলেন। উসমান হারুনীর চিল্লার সম্মানিত বিবরণ আজমীরের 19 শতকের শেষের দিকের সুফি নেতা ও হারুনীর খলিফা গুদরি শাহ এর রচিত “মইন উল কুল” বইতে উল্লেখ করা হয়েছে।

বার্তা এবং শিক্ষা:-
হারুনীর মতে, একজন মহান ব্যক্তি হলেন তিনি, যিনি তৃপ্তি, আন্তরিকতা, আত্মত্যাগ এবং সর্বোপরি ত্যাগের চেতনার মতো গুণাবলীতে সমৃদ্ধ । তিনি বলেছিলেন যে অহং একটি শত্রু, কারণ এটি যুক্তিবাদী চিন্তা, বিজ্ঞ কর্ম এবং একটি সুখী জীবনের অনুমতি দেয় না । তিনি জোর দিয়েছিলেন যে একজন মানুষ যতক্ষণ না মানুষকে ভালোবাসে, ততক্ষণ তার পক্ষে আল্লাহকে ভালোবাসা অসম্ভব

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel

Comments

Please enter your comment!
Please enter your name here