আমরা কি মতভেদের ভিতরে নাকি মাওলার আশ্রয়ে।

আমরা কি মতভেদের ভিতরে নাকি মাওলার আশ্রয়ে।

বর্তমান বিশ্বের ৫৭ মুসলিম দেশ রয়েছে, বিশ্বের জনসংখ্যায় ২৩% মুসলিম পরিচয় দেয়। সকল মুসলিমদের আল্লাহ এক, কোরান এক ও নবি এক। এবং সুফিগণ ব্যতীত সবাই নামাজে একমত, সবাই রোজায় একমত, সবাই জাকাতে একমত, সবাই হজে একমত, সবাই কোরবানিতে একমত। তাহলে ইসলামের মধ্যে মতভেদ ঘটলো কোন জায়গায়? কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইসলাম ধর্মের মধ্যে এই ৭৩ মতের সৃষ্টি হল। সেই ঘটনাটি হলো “মাওলার অভিষেক”। এই মাওলার অভিষেক পর্ব থেকেই ইসলাম ধর্মের মধ্যে মতভেদের সূত্রপাত ঘটে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মাওলার অভিষেকের মাধ্যমেই ইসলামের পরিপূর্ণতা দান করেন। মুহাম্মদি ইসলাম পূর্ণতাই লাভ করে মাওলার অভিষেকের মাধ্যমে। এই মাওলার অভিষেকের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ ইসলামের মধ্যে যতসব দল উপদল ও নানা মতের সৃষ্টি হয়েছে। মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন “আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা।” অর্থাৎ আমি যার প্রভু, আলীও তার প্রভু। এবং আমি এবং আলি একই নূরের দুই টোকরা।

মাওলাইয়াতের ঘোষণা দেন স্বয়ং সরকারে দোআলম আবুল কাশেম হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা(সা.)। মহানবি মুহাম্মদ (সা.) – তিনি স্বয়ং আলীকে মাওলা ঘোষণা করেছেন। হযরত আলী ইবনে আবু তালিব কিন্তু নিজেকে মাওলা বলে ঘোষণা করে নি। হযরত আলী ইবনে আবু তালিব কিন্তু স্বঘোষিত মাওলা না। এই মাওলাইয়াতের ঘোষণা স্বয়ং রহমাতুল্লিল আলামীন দিয়েছেন। অথচ আল্লাহর হাবিব আল্লাহর হুকুম ব্যতীত একটি বাক্যও ব্যয় করে না। তিনি স্বীয় প্রবৃত্তি হতে একটি কথাও বলেন না। যা বলেন আল্লাহর হুকুমে অহি, রাসুলে খোদা মুহাম্মদ (সা.)- এর সিনা মোবারক থেকে রুহুল আমিন যা নির্দেশ দেন তিনি সে অনুসারে কর্ম করেন।

সুরা মায়েদা ৬৭ নং আয়াত ও সুরা আলে ইমরানের ১০৩ নং আয়াত তার সুস্পষ্ট দলিল। এবং সকল আউলিয়া কেরামগণ এই বিষয়ে একমত। সকল মুমিন, মুহসিনিন, মুত্তাকী ও সাবেরীনগণ এখানে একমত। ইহাই তাওহীদ।

মুহাম্মদি ইসলামের মাওলাইয়াত দর্শনের গভীরে প্রবেশ করলে দেখা যায় আল্লাহর পরিচয় ও দলিল হল আল্লাহর রাসুল (আ.)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন স্বয়ং ঈমান বলে পরিচয় দিয়েছন রাসুলকে। এবং রাসুল পাক (সা.)- দেখালেন মাওলারূপে আলী ইবনে আবু তালিব (আ.)- কে।

আল কোরান আরো সাক্ষ্য দিচ্ছে রাসুলের হাতের পর আল্লাহর হাত। যে রাসুলের হাতের উপর বায়াত নিলো সে যেন আল্লাহর হাতে বায়াত নিলো। যে রাসুলের মুরিদ সেই যেন আল্লাহর মুরিদ। কিন্তু এটা বলা হয় নাই যে আল্লাহর মুরিদ সে হয় রাসুলের মুরিদ। বরং বলা হয়েছে যে হয় রাসুলের মুরিদ, সে হয় আল্লাহর মুরিদ।

একমাত্র মাওলা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। আল্লাহকে মাওলারূপে মানতে গেলেই রাসুল রাখবে। আল্লাহর গুণাবলি ও স্বভাব চরিত্র হল রাসুল। আর রাসুল বলেছেন আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা। আল্লাহ এবং রাসুলকে এক ও অভিন্নরূপে দেখার নাম ঈমান। আল্লাহ এবং রাসুল আলাদা মনে মনে এই চিন্তা মনে মনে করলেই কুফর। আল কোরানে সুরা নিসার ১৫১ নং আয়াতে বর্ণিত রয়েছে আল্লাহ এবং রাসুল আলাদা মনে মনে চিন্তা করলেই কাফের। অর্থাৎ রাসুলকে আল্লাহরূপে দেখার নামই ঈমান। রাসুলকে মানুষরূপে জ্ঞান করলে হবে কাফের। আর রাসুল বলছেন আমি এবং আলী একই নূর। রাসুল থেকে আলীকে আলাদা মনে মনে চিন্তা করলেই আমি দ্বীন, ঈমান থেকে খারিজ।

যে আলীকে মাওলারূপে মেনে নিয়েছে তারই ঈমান পরিপূর্ণতা পেয়েছে। আল্লাহ, মুহাম্মদ ও আলী তিন হলেও মূলে কিন্তু জাত নূর মাওলা। এই মাওলার নূরের বলয়েই আসমান – জমিন পরিব্যাপ্ত।

অবুদিয়াত, বেলায়াত, কুতুবিয়্যাৎ, গাউসিয়াত, ইমামাত, খেলাফাত, রেসালাত, নবুওয়ত আশ্রয় নিয়েছে মুহাম্মদ (সা.) – এর মাওলাইয়াতের মধ্যে। কারণ, মহানবি সকল নবিদের কেন্দ্র। তিনি সকল রাসুলদের কেন্দ্রবিন্দু, সকল আউলিয়া অবতারদের কেন্দ্রবিন্দু, সকল ইমামদের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি যেহেতু মাওলাইয়াতের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছেন, এবং মুমিন, মুহসিনিন, মুত্তাকী ও সাবেরীনগণও মাওলাইয়াতের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে।

একমাত্র ইবলিশ মাওলাইয়াত দর্শন মানে না। ইবলিশ শয়তান বনি আদমের প্রকাশ্য শত্রু, তাই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঈমানদারগণকে বিশেষ তাগিদ দিচ্ছে মাওলার আনুগত্য করার জন্য এবং মাওলার আশ্রয়ে থাকার জন্য। কেননা আল কোরানের দর্শন আউয়াল, আখের, জাহের ও বাতেনের সমন্বিতরূপ রেখা।

আল কোরান মানুষকে আহ্বান করেছেন আল্লাহর পরিচয় জানার জন্য, আল্লাহর নিদর্শনসমূহ পাঠ করার জন্য, শিক্ষা নেওয়ার জন্য, আল্লাহ বিশেষ তাগিদ দিচ্ছে মানুষকে ঈমান আনার জন্য। আবার আল কোরানে নবি ইব্রাহিম ও নবি ইয়াকুব (আ.)- তাঁদের সন্তান ও মুরিদগণকে বিশেষ নসিহত করছেন তারা যেন মুসলমান (আত্মসমর্পণ) হয়ে মৃত্যুবরণ করে, মুসলিম না হয়ে যেন কবরে না যায়। এই আত্মসমর্পণেই আসে শান্তি, এই আত্মসমর্পণের মধ্যেই মিলে মুক্তি। এই আত্মসমর্পণেই মধ্যেই যুক্তির অবসান হয়। আল্লাহর রহমত রেজেক প্রাপ্ত হয়।

গবেষণায় পরিষ্কার ফুটে উঠেছে একমাত্র আহলে সুফফা তথা আহলে হক তথা সুফি সাধকরাই মাওলাইয়াতের মধ্যে আছেন। কারণ, ইসলামের ৭৩ ফেরকার মধ্যে সুফিগণ মূলকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। বাকি ৭২ ফেরকা মাওলাকে পরিপূর্ণ মনে- প্রাণে হৃদয়ে স্থান দিতে পারে নাই। তারা ঈমান ফেলে দিয়ে আমলকে আঁকড়িয়ে ধরেছে। ঈমান না থাকলে আমলের যে দুই পয়সার মূল্য নেই, তা তারা জানে। আগে মাওলার প্রতি ঈমান, পরে আমল। ঈমান না থাকলে আমলের দুই পয়সার মূল্য নেই। ঈমানের সাথে আমল করতে হয়। গুরুকে সাথে নিয়ে আমল করতে হয়, ঈমান ব্যতীত আমিল নিষ্ফল।

ইসলামের ৭২ ফেরকা নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ও কুরবানিতে এক।  আমালিয়াতের মধ্যে তাদের কোনো দ্বিধা ও দ্বিমত নেই। কিন্তু তারা মাওলা মানে না। এই ৭২ দল যদি মাওলা মানতো তাহলে সকলে একমতের হতো। যেহেতু সুফিগণ ব্যতীত সবাই মনগড়া বিধানে চলে, তাই তারা পথভ্রষ্ট ও গোমরাহের দল। তাদের ঈমান নেই। যার ঈমান আছে সে মাওলার ইচ্ছামত চলে। যাদের ঈমানে সন্দেহ আছে তারা নিজেদের মনগড়া বিধানে চলে। চলমান মাওলাইয়াত না মানলে আপনার মনগড়া বিধানে এবাদত, বন্দেগি ও আমলের কোনো মূল্য নেই।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল কোরানে ঘোষণা করছে- “আল্লাহ যাহা নাজিল করিয়াছে তদানুসারে যাহারা বিধান দেয় না, তারা ফাসেক, কাফের ও জালেম।” যারা আলীকে মাওলা মানে না তারা জালেম, কাফের ও ফাসেক। কারা কুফরি ও শিরিকের মধ্যে রয়েছে যারা নিজে নিজে অনুমানে আল্লাহতে ঈমান এনে আমল শুরু করে দেয়, এবং নিজেদের মনগড়া বিধানের পূজা করে।

সুফিগণ ব্যতীত ইসলামের কোনো দলই গুরুর ধ্যান করে না। যে ইবাদতে মুর্শিদের ধ্যান নেই, সে ইবাদত শয়তানের ইবাদত। যারা যুগের রাসুল বা অলির নিকট বায়াত গ্রহণ না করে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, হজ করে, জাকাত দেয় সাদকার আড়াই শতাংশ ও কুরবানি দেয় তারাই মূলত জাহান্নামি, অভিশপ্ত শয়তানের দল।

শয়তান আল্লাহ মানে কিন্তু মাওলা মানে না। সুতরাং জীবনেও তারা আহলে বায়াত ও আউলিয়াদের প্রশংসা পূর্ণভাবে করে না। একজন মুমিন যে মাওলার চেহারা, একজন মুত্তাকী যে মাওলার চেহারা, একজন ধৈর্যশীল যে মাওলার চেহারা, একজন মুহসিনিন যে মাওলার চেহারা ইহা কয়জন উপলব্ধি করে। এই চারজনের সাথে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যে রবরূপে থাকেন। এই চারজনের যে কোনো একজন হতে মুখ ফিরিয়ে নিলেই আপনি ইসলাম হতে প্রথমেই বাদ। অতএব ইবাদত বন্দেগী না করলেও চলবে। সুতরাং ইসলাম পূর্ণতা লাভ করছে মাওলাইয়াতের মধ্যে। সুতরাং মাওলার কৃপা ব্যতীত নাজাতের কোনো পথ নাই।

নিবেদক:
আর এফ রাসেল আহমেদ, (লেখক ও গবেষক)

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel