প্রার্থনার মূল সংজ্ঞা
প্রার্থনা, অধিকাংশ মানুষের কাছে, একটি মাধ্যম বা কৌশল হয়ে থাকে যা বাসনা পূরণের লক্ষ্যে ব্যবহার করা হয়। আমরা যে-কোনো দুঃখ-কষ্টে আছি, কিংবা একটি বিশেষ কিছু পাওয়ার জন্য তার কাছে আবেদন জানাই। অনেকেই মনে করেন, প্রার্থনা করতে পারলে তাদের সব মনের আশা পূর্ণ হবে। এই ভাবনা থেকেই, অধিকাংশ মানুষ তাদের প্রার্থনায় শুধু বস্তুগত চাওয়া বা আরাম-স্বাচ্ছন্দ্যই কামনা করে। কিন্তু, প্রকৃত প্রার্থনা কি শুধুমাত্র ইহকালীন লাভের জন্য?
প্রার্থনা, যদি শুধুই একটি চাইবার প্রক্রিয়া হয়, তবে এর মর্মার্থ কেমন দাঁড়ায়? যিনি সর্বজ্ঞ, তিনি তো আমাদের অন্তরের সব ভাবনা জানেন। আমাদের প্রতি তাঁর অগাধ দয়া, তিনি আমাদের চাওয়া-পাওয়ার উপর নির্ভর করেন না। তাই তাঁকে কিছু চাওয়ার জন্য কেন প্রার্থনা করব? যদি সত্যিই ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে চাই, তবে আমাদের বস্তুগত প্রার্থনার মধ্যে কি ত্রুটি রয়েছে?
এখানে প্রকৃত প্রশ্ন হলো- আমরা কখনো কি সত্যের জন্য প্রার্থনা করেছি? আমরা কি কখনো ঈশ্বরের কাছে চেয়েছি “সত্য চাই”? এই বাস্তবতা হলো, সত্য কখনো ভিক্ষা করে পাওয়া যায় না; বরং এটি স্বতঃসিদ্ধ। সত্য হল সেই পথ যা খুঁজতে হয়, উপলব্ধি করতে হয়। কিভাবে আমরা সেই পথ পাবো যদি আমরা শুধু বাহ্যিক লাভের জন্য প্রার্থনা করি?
ঈশ্বর, যিনি সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ, তাঁকে কোনো কিছু বলার প্রয়োজন নেই। তিনি সব জানেন, সব দেখেন। কিন্তু আমরা কেন বারবার ঈশ্বরের কাছে কিছু চাওয়ার চেষ্টা করি? কেন আমরা তাঁকে বলি “এটি দাও, ওটি দাও”? তাঁর কাছে তো আমাদের চাওয়ার কথা জানানো অপ্রয়োজনীয়। যদি তিনি মানুষের অশ্রুতে প্রভাবিত হন, তবে তা তাঁর পরম করুণাময়ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
বিশ্বাসীরা যে ঈশ্বরের ন্যায় বিচারকে গুরুত্ব দেন, তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে গিয়ে ভুলে যান, প্রার্থনা বাস্তবে শুধু একটি আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি করার প্রয়াস। এটি হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত হতে হবে, কোনো বাহ্যিক প্রভাব বা লাভের আশায় নয়। তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার জন্য প্রার্থনা করা এক ধরনের অবিশ্বাসের লক্ষণ হতে পারে, কারণ তাঁর ন্যায় বিচার কখনো পরিবর্তন হয় না।
তাই, প্রকৃত প্রার্থনা কখনোই শুধুমাত্র বস্তুগত চাওয়ার জন্য নয়। বরং, এটি অন্তরের গান শুনানোর এক মাধ্যম। এই গান, যে ঈশ্বরের সাথে সম্পর্ককে গহীন করে তোলে, আমাদের আত্মার প্রশান্তি এনে দেয়। বাস্তবে, প্রার্থনা করা হচ্ছে—ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আত্মসমর্পণ প্রদর্শন করা। এই কৃতজ্ঞতা আমাদের অন্তরকে শুদ্ধ করে এবং আমাদের চিন্তা-ভাবনা পরিবর্তন করে।
প্রার্থনা, ঈশ্বরের কাছে কিছু চাওয়ার বিষয় নয়; এটি আমাদের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মসমর্পণের অঙ্গীকার। এটি এমন এক প্রক্রিয়া যেখানে আমরা ঈশ্বরের নিকট নিজেকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করি, যাতে আমরা তাঁর কাছ থেকে আদর্শ পেতে পারি।
প্রার্থনা: “আত্মার সাথে পরমাত্মার সম্পর্ক” প্রার্থনা শুধুমাত্র এক ধরনের চাওয়া-পাওয়া প্রক্রিয়া নয়, এটি আমাদের আত্মিক সম্পর্কের এক নিখুঁত অভিব্যক্তি। প্রশ্ন উঠছে, প্রার্থনা কার কাছে করছি আমরা? এর উত্তর পরিষ্কার—আমিই। সুতরাং, প্রার্থনার প্রক্রিয়ায় ‘আমি’ এবং ‘তিনি’—এ দুটি ধারণা এক হয়ে যায়। কারণ, যে স্রষ্টা আমাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনি আমাদের মধ্যে বিরাজমান। “তিনি আমার কান দিয়ে শোনেন, আমার চোখ দিয়ে দেখেন,”—এই কথার মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত হয় আমাদের আত্মার গভীর সংযোগ। ঈশ্বরের উপস্থিতি এমন এক অন্তরঙ্গ অবস্থায় রয়েছে, যে আমরা তা বুঝি না। কিন্তু, প্রকৃত প্রার্থনা তখনই আমাদের মন এবং আত্মাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়, যখন আমরা বুঝতে পারি—প্রার্থনাকারী এবং প্রার্থনা শ্রবণকারী এক।
প্রার্থনা, শুধুমাত্র একটি অভ্যন্তরীণ সমর্পণ। এটি কোনো বাহ্যিক কষ্ট বা চাওয়া পূরণের জন্য নয়, বরং এটি আত্মার প্রশান্তির একমুখী সংযোগ। যখন আমরা প্রার্থনায় কিছু চাই, তখনও মনে রাখতে হবে—‘যাহা চাই, তা পাওয়ার পরই বুঝা যায়, “যাহা চাই, ভুল করে চাই”।’ আমরা পৃথিবীর সুখ-সুবিধা চেয়ে থাকি, কিন্তু যখন তা পেয়ে যাই, তখন তা আমাদের মনের শান্তি আনতে পারে না। কারণ, আমাদের চাওয়ার প্রকৃত উদ্দেশ্য কখনোই সম্পূর্ণ নয়।
নজরুলের কবিতাটি এক গভীর চিন্তার পরিচায়ক—“আরতির থালা তসবির মালা, আসিবে না কোনো কাজে, মানুষ করিবে মানুষের সেবা, আর সব কিছু বাজে।” এটি প্রাথমিক স্তরের প্রার্থনার বর্ণনা। ঈশ্বরের সেবা যখন শুধুমাত্র বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠান পরিসমাপ্তি হয়, তখন তা এক ধরনের অঙ্গভঙ্গির সাথে সীমাবদ্ধ থাকে। যারা এখনো নিজেদের পশুত্ব বিসর্জন দেয়নি, তারা বাহ্যিক প্রার্থনা করে, কিন্তু তাদের হৃদয়ের প্রার্থনা তখনো প্রাথমিক স্তরে থাকে—অর্থাৎ, “ঈশ্বরকে ভালোবাসা মানে নিজেকে ভালোবাসা, নিজের পরিবারকে ভালোবাসা, প্রতিবেশীকে ভালোবাসা।” এটাই মনুষ্যত্বের প্রকৃত দাবি।
যতই আমরা এই স্তর পার করি, ততই আমাদের প্রার্থনা গভীর হয়। দ্বিতীয় স্তরের প্রার্থনা হলো একাত্মতা অনুভব করা—“আমার হৃদয় তোমাকে দিলাম, আমি তোমার হয়ে গেলাম, তুমি আমার হলে কিনা সে ভাবনা আমার নেই।” এটি তখনই সম্ভব যখন আমরা মানবিক স্তরে উন্নীত হই এবং আমাদের হৃদয় সত্যিকারভাবে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত হয়।
তৃতীয় স্তরের প্রার্থনা হলো ‘হৃদয়ের সম্প্রদান’। এখানে কোনো শর্ত থাকে না, এখানে নিঃশর্ত সমর্পণ ঘটে। সমর্পণ মানে হলো একে অপরের মধ্যে মিশে যাওয়া—অথবা একাকার হয়ে যাওয়া। এক্ষেত্রে, আমি এবং তুমি কোনো ভেদাভেদ নেই। যখন এই অবস্থান আসবে, তখন আর কেউ কারো কাছে কিছু চাইবে না। যেখানে আমি এবং তুমি এক, সেখানে সকল চাওয়া-পাওয়া অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়।
প্রার্থনা তাই দুটি আত্মার একত্রীকরণের প্রক্রিয়া। এটি শুধু এক স্রষ্টার কাছে কিছু চাওয়া নয়, বরং এটি আমাদের হৃদয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি যেখানে ‘আমি’ এবং ‘তিনি’ এক হয়ে যান। যখন সত্যিকার অর্থে এই সম্পর্ক স্থাপন করা যায়, তখন প্রার্থনা হয়ে ওঠে আত্মা এবং পরমাত্মার একটি নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ—যা আরবিতে “আকিমুস সালাহ” বলা হয়।
যখন সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে কোনো তফাত থাকে না, তখন হৃদয় উন্মুক্ত হয়ে যায়। সকল চিন্তা, অনুভূতি, এবং প্রতিটি পদক্ষেপ সত্যের পথে চলে আসে। এভাবে, যখন আমরা একে অপরের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করি, তখন আমাদের প্রার্থনা পূর্ণতা পায় এবং তা আর কোনো চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তখন ঈশ্বর জানেন আমাদের প্রয়োজন—এটি কোনো বাহ্যিক প্রশ্নের নয়, বরং এটি এক অন্তর্দৃষ্টির অভিজ্ঞতা যা শুধু আত্মার গভীরে প্রতিধ্বনিত হয়।
প্রার্থনা তাই শুধুমাত্র “কিছু চাওয়া” নয়, এটি আমাদের আত্মা এবং স্রষ্টার মধ্যে এক গভীর সম্পর্কের ইঙ্গিত। যেখানে দুইটি আত্মা একে অপরকে অনুভব করে, একে অপরকে চেনে, একে অপরের সাথে একাকার হয়ে যায়।
–ফরহাদ ইবনে রেহান
জানুয়ারি ১৮, ২০২২