প্রেমময় নজরুল।
প্রেমময় নজরুল (আসিব মিয়া)।
‘এলো ধরায় ধরা দিতে সেই সে কবি,
ব্যথিত মানবের ধ্যানের ছবি
আজি মাতিল বিশ্ব নিখিল মুক্তি-কলরোলে।’
কাজী নজরুল ইসলাম, আল্লাহর প্রেরণা প্রাপ্ত; আর্শীবাদপুষ্ট পথপ্রদর্শক। কাজী নজরুল ইসলাম নবি নন, কবি। বিশ্বসভ্যতার আদিযুগে, যুগে যুগে কালে কালে এই পৃথিবীতে মানুষে মানুষের সাম্যের জন্য, সম্প্রীতির জন্য, আত্মিকবন্ধনের জন্য বিরামহীন কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে মানুষকে আলোর পথে এনেছেন প্রেমাবতারগণ৷ এরই প্রেক্ষিতে এই ধূসর ধরার ধূলিতে পদযুগল রেখে পৃথিবীকে ধন্য-পূন্য করেছেন পবিত্র মহামানবেরা৷ তাঁরা এই অবধারিত সত্যসিন্ধুতে পাপাত্মায় বশীভূত সকল মানুষকে অগ্নিস্নান করিয়ে পূন্যমানবে পরিণত করতে গিয়ে কালের অত্যাচারী, স্বৈরাচারী, পাশবিক মিথ্যাশক্তির কারাদণ্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন।
তেমনি কাজী নজরুল ইসলামও এর ব্যতিক্রম নই। পৃথিবীর ইতিহাসে কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ প্রবন্ধটি নজিরবিহীন অসামান্য সৃষ্টিকর্ম। কবি এই প্রবন্ধে তিনি তাঁর গুপ্ত রহস্য উন্মোচন করে বলেন, “আমি কবি, অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করবার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তি দানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন। আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা, ভগবানের বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়-দ্রোহী নয়, সত্য-দ্রোহী নয়। সে বাণী রাজদ্বারে দণ্ডিত হতে পারে, কিন্তু ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তাহা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ, সত্য-স্বরূপ।”
অতএব, কবির বাণীতে সুস্পষ্ট বর্ণনা আছে তিনি আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত। আল্লাহ স্বয়ং কবির কণ্ঠে সাড়া দেন। কবির বাণী, নিঃসন্দেহে আল্লাহর বাণী। আমার সাহিত্যগুরু ড. মুহ. শহীদুল্লাহ্ আমাকে বলেছিলেন, “কবিতা আপনা-আপনি তৈরি হয় না, কবিতা নাজিল হয়। আগেরকার দিনে নবিদের উপর যেভাবে ওহি নাজিল হতো, তেমনি কবিদের উপর কবিতা নাজিল হয়। শুধু পার্থক্য এইটুকুই, কবিদের জন্য ওহি নিয়ে কোনো স্বর্গীয় দূত আসে না।”
তবে সব কবি-ই কবি নয়। শুধু কবিতা লিখলেই, কবি হওয়া যায় না। যারা আলোকপ্রাপ্ত, তারাই কবি। সুফি সাধক ড. এমদাদুল হক কাজল স্যারের রচিত বিখ্যাত ‘অনন্ত প্রেমের পত্রাবলি‘তে লিখেছেন, “পৃথিবীতে কবি ও কবিতার অভাব নেই, কিন্তু রুমি এখনো বেস্ট সেলিং পোয়েট। কারণ রুমি আল্লাহর প্রেরণা প্রাপ্ত। বাংলাদেশে গীতিকারের অভাব নেই, কিন্তু লালনই শ্রেষ্ঠ গীতিকার, কারণ তিনি আল্লাহর প্রেরণা প্রাপ্ত।”
মূলত, যারা মানুষের কল্যাণে, মানুষের প্রয়োজনে যুগোপযোগী বাণী, মেসেজ কিংবা সত্য-বার্তার মাধ্যমে পথহারা তৃষ্ণার্ত মানবের মাঝে অমৃতসুধাসম সৃষ্টিকর্মের দ্বারা জগতের সর্বসাধারণের জন্য মঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন, তারাই কবি।
নবি মোহাম্মদ (সা.), মওলা আলী (আ.), শামস-ই-তাবরীজ, ফরিদ উদ্দিন আত্তার, রুমি, হাফিজ, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি, আমীর খসরু, বুল্লে শাহ, আল্লামা ইকবাল, মির্জা গালিব, আধুনিতে নজরুল-লালন-রবীন্দ্রনাথ, চৈতন্য, দীনহীন, সিতালং ফকির, হাছনরাজা, সদর উদ্দিন চিশতী, সৈয়দ কুতুবউদ্দিন চিশতী, মনোমোহন, তিতন শাহ, রজ্জব আলী দেওয়ান, মাতাল রাজ্জাক, আব্দুর রশিদ সরকার, আব্দুল করিমসহ প্রমুখরা প্রত্যেকেই একেকজন কবি। এছাড়াও নাম জানা-অজানা মরমী সাধু-গুরুজনেরা যুগের সাথে সমন্বয়ে কালে কালে কালের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন সত্যাগ্রহী মানুষের মাঝে।
তিনারা প্রেম ও ভাবের সংমিশ্রণে জন্ম দিয়েছেন সঙ্গীত, কবিতা-ছন্দ, প্রবন্ধ। কোনো রাজনৈতিক নেতা, কোনো দলীয় গুরু বা পথমত তৈরি করতে আসেননি তারা। প্রত্যেকে এসেছিলেন মানুষের কল্যাণে। কিন্তু ঐসব মহাত্মাদের অনুপস্থিতিতে তারই অন্ধ ভক্ত-শিষ্যরা নির্দিষ্ট ‘ট্রেড মার্কা’ লাগিয়ে দলাদলি করতে থাকে। আর কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিজেও তাই বলেছেন, “মানুষের কল্যাণের জন্য আসিয়াছিলেন যাঁহারা, তাঁহাদেরই মাতাল পশু শিষ্যেরা আজ মানুষের সর্ব অকল্যাণের হেতু হইয়া উঠিল।”
কবি কাজী নজরুল ইসলাম তিনি শুধু কবি হতে আসেননি, এসেছেন মানুষের জন্য। ভূ-ভারত যখন অত্যাচারী ইংল্যান্ডের পরাধীন, অত্যাচার-অবিচার, অসাম্য যখন মাথা নাড়া দিয়ে উঠিল, তখনই নজরুলের আর্বিভাব। তিনি ব্যথিত মানবের ধ্যানে ছবি। যখনই জগত বিভেদ বৈষম্যে দূর্বিষহ হয়ে উঠে, তখনই পুণ্যআত্মা গণ পৃথিবীতে আসেন জগত উদ্ধারের জন্য।
তেমনি নজরুলও এসেছেন সেই প্রেম নিয়ে। তাইতো কবি বলেন, “বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি- আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম- সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম…”
[ কবির এই শুভ-পবিত্র আবির্ভাব দিবসে ড. মুহ. শহীদুল্লাহ স্যারের লেখা, ‘কবি নজরুল’ কবিতাটি নজরুলের স্মরণে উৎসর্গিত। ]
কবিতা: কবি নজরুল
কবি নজরুল যদিও নয় এ যুগের নবী,
আমরা জানি সে তেজোদীপ্ত রবি।
যদিও সে নয় ভগবানের অবতার,
সে যা সৃজিছে সাধ্য নেই কোন দেবতার!
তাঁর অগ্নিবীনার উত্তাল ঝংকারে,
নিপীড়িতরা জেগে ওঠে মহাহুংকারে।
অমানুষের সাঝে উঠে রব ত্রাহি ত্রাহি,
কবি নজরুল তাই হয়েছে চিরবিদ্রোহী।