নিষ্কাম তত্ত্ব – পর্ব ২
নিষ্কাম তত্ত্ব তৃতীয় পর্বের (দ্বিতীয় পর্ব):
“সালাতের উপর হেফাজত কর এবং মধ্যবর্তী সালাতের এবং তোমরা দাড়াও আল্লাহর জন্য বিনত হইয়া।” (২:২৩৮)।
এই সালাত তথা রবের সহিত সংযোগ প্রচেষ্টাকে সাধক তথা আমানুর উপর ফরজ করা হয়েছে। মানব জীবন চক্রটি তিনটি দৃষ্টিকোন থেকে ভাগ করা যায় যেমন: বাল্যকাল, যৌবনকাল ও বার্ধক্য কাল। একমাত্র যৌবনকালেই মানুষ উদাসীন হয়ে যায় ধর্ম কর্ম হতে, এবং আপন নফসের উপর জুলুম করতে থাকে। তাই কোরানিক দর্শন যৌবনকালের তথা মধ্যবর্তী সালাতের উপর যত্নবান তথা হেফাজতী হতে বলেছেন। এই যৌবনকালে যদি সালাত প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে বার্ধক্য কালে সালাত প্রতিষ্ঠা হওয়ার সম্ভাবনাই কম। এই আয়াতের গভীর রহস্য বুঝতে চাইলে কালান্দার জাহাঙ্গীর এর “কোরানুল মজিদ হুবুহু অনুবাদ ও কিছু ব্যাখ্যা” নামক কিতাবের ৩৬নং সুরা ইয়াসিনের ৭৭-৮০ নং আয়াতের ব্যাখ্যাটি দেখার অনুরোধ রইল।
“শাহজাহান কয় আগ বেলাতে,
ধরছি পারি ওপার যেতে;
মুর্শিদ আমার সঙ্গে থেকে,
নিও দয়াল উদ্ধার করে।”
ব্যাখ্যা: সাধক কবি তাঁর মুর্শিদের সাথে সঙ্গ করে বুঝতে পারলেন, জীবসত্তাকে রূপান্তর ঘটিয়ে পরমসত্তায় মিলনের অভিপ্রায়ে মুর্শিদের নাম ধরে কামনহর অতিক্রম করে। ওপার মুক্তির শহরে যেতে পাড়ি ধরেছেন আগ বেলাতে তথা যৌবনের প্রারম্ভে। লাধুনিক জ্ঞানে জ্ঞানী কবি, কোরানিক নিগূঢ় রহস্যের সার, সাধক কবি সাধনার বলে স্বীয় আধারে ধারণ করেন।
এই সাধক, সুফি, আরিফ, আবদাল, মজ্জুব ও মস্তানরাই হলেন সাহেবে কেতাব আব্দুহু। তাঁদেরকেই বলা হয় জীবন্ত বিজ্ঞানময় কেতাব। এই জীবন্ত বিজ্ঞানময় কেতাবকে কোরানিক দর্শনে বলা হয় জালিকাল কেতাব (হাজাল কিতাব নয়)। কোনো সন্দেহের অবকাশ নাই এই জীবন্ত কিতাবে।তাঁরা হলেন সাধারণ মানুষদের হিদায়াতের চেরাগ। এই প্রদীপ্ত চেরাগ জীবন্ত মহামানবকে যাঁরা শক্তভাবে ঈমানের সহিত ধরেছেন তাঁরাই সর্বপরীক্ষা কামিয়াব হন। এই সফলকামী সত্তাদের কোরানিক দর্শনে মুত্তাকী বলেছেন। মুত্তাকীগণ হলেন প্রকৃত নিষ্কামিক তথা সংযমী তথা হেদায়েতপ্রাপ্ত। মুত্তাকী হতে গেলে আপন নফসের সহিত জিহাদ (অস্ত্রের যুদ্ধ নয়) করতে হয়।
আর এই জিহাদের শিক্ষাই আমরা পাই কোরানিক দর্শনে সুরা বাকারার জালুত আর তালুতের মাধ্যমে। জালুত হলেন খান্নাসীশক্তির বাদশা। ক্ষমতা, প্রভাব – প্রতিপত্তি, বিত্ত ভৈরব ও দুনিয়াবী রাজশক্তির আধার। অপরদিকে তালুত হলেন আল্লাহর অলি। তালুত সুঠাম ও প্রশস্তদেহের অধিকারী, অনন্তযৌবনা, খোদাভীরু, আল্লাহর হিকমতের জ্ঞানদ্বারা পরিপূর্ণ তথা লাধুনিক জ্ঞানের অধিকারী, নিষ্কামিক ও ধৈর্যশীল। অত্যাচারিত, নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, দলিত, বিষন্ন , খান্নাসিশক্তির দ্বারা প্রভাবিত মজলুমদের মহান অলিয়্যাম মুর্শিদ। মজলুম দলনেতা তালুত তাঁর অনুসারীদের নিয়ে খান্নাসী শক্তির রাজা জালুতের বিরুদ্ধে জিহাদের আহবান করেন।তালুত সম্প্রদায় জিহাদ করতে তালুতের নিকট অঙ্গীকারবদ্ধ হন। তালুত ইলহামের মাধ্যমে তাঁর অনুসারীদের সাবধান করে দেন। “হে আমার সম্প্রদায় আল্লাহ তোমাদের পরীক্ষা করিবেন নহর দ্বারা।”
পবিত্র কোরানুল মজিদে সুরা বাকারার ২৪৯ নং আয়াতে বর্নিত রয়েছে- “(ফালাম্মা ফাসোয়ালা তালুতু বিলজুনুদি কালা ইন্নালাহা মুবতারিকুম বিনাহারিন।)”
অনুবাদ: সুতরাং যখন রওয়া হইল তালুত সৈন্যসহ, বলিল, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের পরীক্ষা করিবেন একটি নহর দ্বারা।
“ফামান শারিবা মিনহু ফালাইসা মিননি” অনুবাদ: সুতরাং যে পান করিবে উহা হইতে সুতরাং সে আমা হইতে নয়।
“ওয়া মাল লাম ইয়াদ্আমহু ফাইন্নাহু মিননি ইল্লা মানিগ তারাফা গুলফাতান বিইয়াদিহি” অনুবাদ: এবং যে উহার স্বাদ লইবে না সুতরাং নিশ্চয়ই সে আমার ব্যতিক্রম যে অঞ্জলি ভরিয়া লইবে এক অঞ্জলি নিজ হাত দিয়া।
“ফাশারিবু মিনহু ইললা কালিলাম মিনহুম” অনুবাদ: সুতরাং তাহারা পান করিল উহা হইতে তাহাদের মধ্য হইতে নগন্য (সংখ্যক) ব্যতীত।
“ফালামমা জাওয়াজাহু হুয়া ওয়াল লাজিনা আমানু মাআহু কালু লা তাকাতা লানাল ইয়াওমা বিজালুতা ওয়া জুনুদিহি” অনুবাদ: সুতরাং যখন উহা (নহর) অতিক্রম করিল সে এবং যাহারা ঈমান আনিয়াছেন তাহার সহিত, বলিল, নাই শক্তি আমাদের আজ জালুতের এবং তাহার সৈন্যদের সঙ্গে।
“কালাল লাজিনা ইয়াদুন্নুনা আন্নাহুম মুলাকুল লাহি কাম মিন ফিআতিন কালিলাতিন গালাবাত ফিয়াতান কাসিরাতান বিইজনিল্লাহি।” অনুবাদ: বলিল, যাহারা মনে করিত নিশ্চয়ই তাহারা আল্লাহর সঙ্গে মোলাকাতকারী কত ছোট দল হইতে জয়ী হইয়াছে বড় দলের (উপর), আল্লাহর হুকুমে।
“ওয়াল লাহু মাআস সোয়াবিরিনা” অনুবাদ: এবং আল্লাহ ধৈর্যধারণকারীদের সঙ্গে (আছেন তথা থাকেন)।
ব্যাখ্যা: কোরানিক দর্শন কোন নহর দ্বারা তালুত সম্প্রদায়কে পরীক্ষা করেছেন? আরব সাগর নাকি লীলনদ নাকি ফুরাদ নদী? নাকি প্রেম নহর? নাকি কামনহর? কোরানিক দর্শন কোন নহর বুঝিয়েছেন তার কোনো সুস্পষ্ট বিরবরণ কোরানে উল্লেখ নেই। অধম লিখক যেটুকু গবেষণা করে বুঝতে পারলাম সেইটুকু একান্তই ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরলাম, মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়া মাননীয় পাঠকের ব্যক্তিস্বাধীনতা। জৈবিক চাহিদা কামাকর্ষণ পূর্বে ছিল, বর্তমানেও আছে, এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। মানবসভ্যতা যতই উন্নতর থেকে উন্নত হোক না কেন। এই কামাকর্ষণ আবাল-বৃদ্ধ-ভনিতা সবাইকে প্রভবিত করে। কাম নহর অতিক্রম করেই প্রেমনহরে নিমজ্জিত হতে হয়।
অর্থাৎ কামের দেশ পাড়ি দিলে, আসে মায়ার দেশ, মায়ার সাগর পাড়ি দিলে আসে অনন্ত শান্তি। এই নহর দ্বারা অধম লিখক কামনরই বুঝিতে চাই। ভৌগোলিক অবস্থানগত কোনো প্রাকৃতিক নদী নিলে, এই আয়াতের ভাবধারার সার্বজনীনতা থাকে না। চিন্তাশীল পাঠকগণ ইহা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবেন। অধম লিখকের মন্তব্য ভুলও হতে পারে কিন্তু ভন্ডামি নয়। যদি কোনো মহৎ হৃদয়বান ব্যক্তি অন্য কোনো উপায়ে এর চেয়ে ভালো তথ্য দিয়ে সর্বজনীনতা প্রমাণ করতে পারেন তাহলে আমরা ধন্যবাদ দিব। সাবধান এমন কিছু লিখবেন না অথবা বলবেন না যে পাছা দিয়ে পাহাড় ঠেলতে না হয়। হযরত তালুত তাঁর অনুসারীদের ইলহামের মাধ্যমে সাবধান করে দিয়েছেন। আল্লাহপাক তোমাদের ধৈর্যশক্তি পরীক্ষা করিবেন।
এই পরীক্ষার মাধ্যমে হযরত তালুতের ভক্তরা তিনদলে বিভক্ত হয়ে যাবে:-
- এক: হযরত তালুতের কথামতো যারা নহরের স্বাদ গ্রহণ করে নাই। তাঁরা হলেন হযরত তালুতের দলভুক্ত মুরীদ।
- দুই: যারা হযরত তালুতের নির্দেশ মোতাবেক নহরে ডুবে যাওয়ার ভয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে আজলা পরিমাণ স্বাদ গ্রহণ করেন, তাঁরাও হযরত তালুতের দলভুক্ত।
- তিন: আর যারা হযরত তালুতের নির্দেশ অমান্য করে নহরের স্বাদ আস্বাদন করল তারা হযরত তালুতের দলভক্ত নয়।
হযরত তালুতের ভক্তদের তথা অনুসারীদের মধ্যে যারা ধৈর্যধারণ করে নহরে অতিক্রম করল তথা নহরের স্বাদ গ্রহণ করেন নি, তাঁরা অতি অগ্রগামী। আর যাঁরা হযরত তালুতের নির্দেশ মোতাবেক ব্যবস্থা নিয়েছেন তাঁরাও ডানপন্থীদের দলে অন্তর্গত। কিন্তু যারা হযরত তালুতের নির্দেশ অমান্য করে নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো নহরের স্বাদ আস্বাদন করলেন তারা বামপন্থীদের দলভুক্ত হয়ে গেলন। অল্প সংখ্যাক ব্যতীত অধিকাংশ অনুসারী তথা ভক্ত হযরত তালুতের নির্দেশ অমান্য করে নহরের স্বাদে ডুবে তলিয়ে গিয়েছে।
আমরা পবিত্র কোরানুল কারীমের ৫৬ নং সূরাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল একটি সুরা। এই সূরার প্রথম ছয় আয়াতে ব্যক্তি কিয়ামতের ঘটনা বর্নিত রয়েছে। ৭ নং আয়াতে মানুষকে মর্যাদা অনুপাতে তিনদলে বিভক্ত করা হয়েছে। ডানপন্থী , বামপন্থী ও অগ্রগামী তিনদলে বিভক্ত করা হয়েছে। ১১ নং আয়াত হতে ২৬ নং আয়াত পর্যন্ত অগ্রগামীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে, ২৭ নং আয়াত হতে ৪২ নং আয়াত পর্যন্ত ডানপন্থীদের বৈশিষ্ট্য বর্নিত হয়েছে, ৪৩ নং আয়াত হতে ৬২ নং আয়াত পর্যন্ত বামপন্থীদের বৈশিষ্ট্য বর্নিত হয়েছে। এই সুরাটিতে সর্বমোট ৯৬ টি আয়াত রয়েছে। বাকি আয়াতগুলো কিছু নিয়ামতের কথা স্মরণ করিয়েছেন, কিছু আয়াতের বিভিন্ন বিষয় হুমকি দিয়েছেন, কিতাবের মধ্যে যে কোরান সংরক্ষিত, এবং রব হতে নাজেল, অপবিত্র অবস্থায় এই কোরানের নূর স্পর্শ করা যায় না, একমাত্র আপন রবের গুণকীর্তন করার বিশেষ তাগিদ রয়েছে, যাতে করে আমানুগণ হাক্কুল ইয়াকীন অর্জন করতে পারে।
রূপকাতার আড়ালের কিয়ামত দর্শনটি তথা জন্মান্তরবাদ দর্শনটি অপূর্ব শৈলীতে ফুটে উঠেছে, মানুষের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবন দর্শনটি সূরা আল ওয়াকিয়াতে সুরবিস্তার ফুটে রয়েছে। এই সূরাটি বারংবার সুগভীর অনুশীলনের মাধ্যমে দৈহিক এবং আত্মিক উভয় গরিবী হালাত পরিবর্তন হবে আল্লাহ চায় তো!
“ওয়া কুনতুম আজওয়াজান সালাতান।” (৫৬:০৭) অনুবাদ: এবং তোমরা হইয়া পড় তিন দলে বিভক্ত।
“ফাআসহাবুল মাইমানাতি মা আসহাবুল মািমানাত” অনুবাদ: সুতরাং ডানদিকের অধীবাসী, ডানদিকের অধীবাসী কি? (৫৬:০৮)
“ওয়া আসহাবুল মাশয়ামাতি মা আসহাবুল মাশআমাত” অনুবাদ: এবং বামদিকের অধিবাসী, এবং বামদিকের অধিবাসী কি? (৫৬:০৯)
“ওয়াস সাবিকুনাস সাবিকুন ” (৫৬:১০) অনুবাদ: এবং অগ্রগামিরা অগ্রগামী।
ব্যাখ্যা: আমরা সূরা আল ওয়াকিয়ার (৭-১০) পর্যন্ত এই চারটি আয়াতের সামান্য রহস্য তুলে ধরবো। আমরা সৃষ্টিরাজ্যের মধ্যে আমানুদের ভিতর তিন শ্রেণির মর্যাদার মানুষ দেখতে পাই। একমাত্র মানবদেহধারী মানুষদের ভিতর কেরানিক দর্শন অনুসারে তিনস্তরের অধীবাসী দেখতে পাই।বাহ্যিক দৃষ্টির দর্শনে তাঁরা আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ মনে হয়। কিন্তু কোরানিক দর্শন জানান দিচ্ছে যে, এই মানবদেহ নামক পোশাকের অভ্যর্ন্তরে তিন কোয়ালিটির সত্তা অবস্থান করে।
সুতরাং মানুষ দেখতে আমারই মতো, এই বাক্যটি সবচেয়ে বড় ধোঁকা।তার চেয়ে বড় কোনো ধোঁকা কোরানিক দর্শনে আছে কি না, আমরা জানি না। প্রথম স্তরের অধিবাসীগণ জাগ্রতরূহের অধীকারি, যারাঁ দুনিয়ার মোহমায়ার নেশা হতে মুক্ত, অখন্ড, নিষ্কামিক ও অতিসূক্ষ্মমানব যাঁরা আল্লাহর ইশকের সাগরে নিমজ্জমান। তাঁরাই আল্লাতে বাকা, তাদের সত্তাই আল্লাহর জাতনূরের মাজার।তাঁরাই আল্লাহর রবরূপ আমরারূপে।তাঁরাই আল্লাহর প্রকৃতি, তাঁরাই আল্লাহর গুপ্তভেদ রহস্য, তাঁরাই সাহেবে বেলায়াত, সাহেবে আল কেতাব, রাসেখুল ফিল এলেম, যা পূর্ব হতেই প্রাপ্ত এই রকম গুনসমপন্ন খাসুল খাস পর্যায়ে অলি, মজ্জুব, মস্তান, আরিফ ও আবদাল যা আব্দুহু মর্তবায় উর্ত্তীণ অতি অগ্রগামী।
কোরানিক দর্শনে বর্নিত অগ্রগামীদের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
“উলাইকাল মুকাররাবুন।” (৫৬:১১) অনুবাদ: উহারাই তাহাঁরা সবচাইতে নিকটে।
মন্তব্য: উহারা কারা? উহারাই হলেন জালিকাল কিতাব। যারাঁ মুত্তাকীদের তথা জান্নাতিদের কেবলা। যাঁরা “সুম্মা দানা ফাকানা কাবা কাওসাইনে আও আদনা” (৫৩:৮-৯)। অর্থাৎ; অর্থাৎ আব্দুহু পার্যায়ের আরিফ, আবদাল ও মস্তানগণ।
“ফি জান্নাতিন নাঈম।” (৫৬:১২) অনুবাদ: নিয়ামতের জান্নাতের মধ্যে।
মন্তব্য: কোরানিক শব্দ জান্নাত। বাংলা পরিভাষায় শান্তিময় পরিবশ।কোরানিক শব্দ জান্নাত দিয়ে কিছু আয়াতে উদ্যান বা বাগান বুঝায়, কিছু আয়াতে শান্তিময় পরিবেশ বুঝায়, আবার কিছু আয়াত দিয়ে নাজাত তথা মুক্তি বুঝায়। সত্য মুমিন হবে যাঁরা তাদের মধ্যে আপনিই খোলবে জান্নাতের দ্বার। এই জান্নাত অর্জন। এই জান্নাত সিয়াম, যাকাত, কোরবানী ও যাকাতের মাধ্যমে অর্জন করে নিতে হয় আপন নফসের উপর। আপন নফস পরিতৃপ্ত তথা সন্তুষ্ট হলে, আপন নফস জান্নাতের স্বাদ আস্বাদন করতে থাকে। যদিও জান্নাত একটি। কিন্তু তার স্তর হয়েছে আটটি। আপনদেহের মধ্যে এই আটটি দ্বার সাধক তার রবের কৃপায় অর্জন করতে থাকে। সুতরাং আপন নফসের বাহিরে জান্নাতও নাই আবার জাহান্নামও নাই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই আসমান ও জমিন যথাযথভাবে সৃষ্টি করছেন, যাতে প্রত্যেক নফসকে তার কর্মফল দেওয়া যেতে পারে। যারা আপনদেহের বাহিরে জান্নাত জাহান্নাম খোঁজে তারা বোকা।
“সুললাতুম মিনাল আউয়ালীন” (৫৬:১৪) অনুবাদ: এবং পূর্ববর্তীগনের মধ্যে হইতে বড় দল।
মন্তব্য: অর্থাৎ ডানপন্থীগণের মধ্যে হইতে একটি বড় দল, অগ্রগামী দলে উত্তীর্ণ হতে পারে। ডানপন্থী দল হলো জান্নাতি দল তথা মুমিন ও মুত্তাকীদের দল।
“ওয়া কালিলুম মিনাল আখেরিন” (৫৬:১৪) অনুবাদ: এবং পরবর্তীগনের মধ্যে হইতে কম সংখ্যক।
মন্তব্য: সুরা আল ওয়াকির তিনদলের মধ্যে প্রথমে তথা ৮ নং আয়াতে ডানপন্থীদের কথা বর্নিত হয়েছে। পরের আয়াতে তথা ৯ নং আয়াতে বামপন্থীগণের কথা বর্নিত হয়েছে। কোরানিক দর্শন আলোকে বামপন্থীগনকে তৃতীয় স্তরে অধিবাসী বলা হয়েছে। অগ্রগামিদলে তথা প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় শ্রেণি তথা ডানপন্থীদল থেকে একটি বড় অংশ অগ্রগামিদের দলে উত্তীর্ণ হতে পারে। এই ডানপন্থীদের কথা তিন স্তরের প্রথমেই বলা হয়েছে।সুতরাং ডানপন্থীগণ হলেন পূর্ববর্তীদল। এবং বামপন্থীগণ হলেন পরবর্তী দল। বামপন্থীদল হতে কম সংখ্যক অগ্রগামি দলে তথা প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পারে। কোরানিশ দর্শনের প্রতিটি শব্দ চয়ন বিজ্ঞানভিত্তিক সাজানো এবং অংকের হিসাবের ন্যায় মিলে যায়।
“আলা সুরুরিম মাওদুনাতিম” অনুবাদ: স্বর্ণখচিত আসনের উপরে।
মন্তব্য: জান্নাতে অতিব উত্তম তথা মর্যাদাপূর্ণ নন্দনশীল স্থানে উপবিষ্ট, যা মনোমুগ্ধকর নিত্যান্দের পরিবেশ। রূপকার্থে স্বর্ণখচিত আসনের সহিত উপমা দেওয়া হয়েছে।সুরা কাহাফ, সুরা আর রহমানে, এই একই আয়াতগুলো সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন আমার পীর ও মুর্শিদ কালান্দার মাওলা জাহাঙ্গীর।
“মুত্তাকিয়িনা আলাইহা মুতকাবিলিন” (৫৬:১৬) অনুবাদ: তাহার উপর হেলান দিয়া মুখামুখি হইয়া বসিবে।
মন্তব্য: মুহাম্মদি অনন্ত সুন্দর্যের আসনে হেলান দিয়া মুখামুখি হইয়া বসিবে।
“ইয়াতুফু আলাইহিম ওয়াল্ দানুম মুখাল্ লাদুন” (৫৬:১৭)। অনুবাদ: চিরন্তন যুবকেরা তাহাদের উপর তোয়াফ করিবে।
মন্তব্যঃ ডানপন্থীগণ অগ্রগামিদের উপর তোয়াফ করিবে।ডানপন্থীগনই ঐশ্বীজ্ঞানে যৌবনপ্রাপ্ত। তাঁরা নফসে মোৎমায়েন্নাহর মধ্যে অবস্থানকারী।এই অগ্রগামিদের ডানপন্থীগণ তোয়াফ করে এবং করিবে।
“বিআক্ওয়াবিও ওয়া আবারিকা, ওয়া কাসিম মিম মািলিন”( ৫৬:১৮)। অনুবাদ: পানপাত্র ও কলসসহ এবং প্রবাহিত সরাব হতে ভরা পেয়ালা।
মন্তব্য: রূপকতার আশ্রয় নিয়ে আল্লাহপাক উপমার মাধ্যমে সাবলীলভাবে বুঝিয়ে দিশেছেন যে, আরিফ আবদালগণ হলেন সরাবে শাহেন শাহ। তাঁরা হলেন প্রেম সরাবের ভান্ডার। কাউসারের দাতা। যখন তাঁরা তাদের প্রেম সরাবের ধারা প্রবাহিত করেন, তখন তোয়াফকারীগণ নিজেদের প্রানপাত্র পরিপূর্ণ করেন এবং জীবের কল্যানের জন্য কিছু লাধুনিক তথা ইরফানি উলুম ধরে রাখেন।
“লা ইউসাদ্দাউনা আনহা ওয়ালা ইউনজিফুন” (৫৬:১৯)। অনুবাদ: উহা হইতে না মাথা ঘুরাইবে এবং না জ্ঞানহারা হইবে৷
মন্তব্য: প্রেমসরাপ তথা সুরাবান তহুরা পান করিলে কারোর মস্তিষ্কের বিকার ঘটবে না এবং তাঁরা ধীর স্থির হয়ে যাবে। দুনিয়ার মোহগ্রস্তা তাদের মাতাল করতে পারবে না। আর এই সুরাবান তহুরা, মানবদেহের বাহিরে পাওয়া যায় না, কামনার বিষ পান করলে প্রেমামৃত সাধুর নফসের উদগীরণ হয়। এই কামের বিষ যারা পান করতে পরেছেন তাঁরাই আপনদেহে দেবত্বের বিকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁরাই অমরপুরে চলে গেছেন, একদম ভয়মক্ত হয়ে গেছেন, সমনকে জয় করেছেন। তারাই সত্যের ঢংকা বাজিয়েছেন।
“ওয়া ফাকিহাতিম মিম্মা ইয়াতাখাইয়ারুন” (৫৬:২০) অনুবাদ: এবং ফলসমূহ যাহা হইতে তাহারা বাছিয়া লইবে।
মন্তব্য: তোয়াফকারী যুবকগণ আরিফ, আবদাল ও মস্তানদের নিকট্য হতে যে জ্ঞানামৃত ফল বানীরূপে বের হয় তা হতে সাধকগন তাদের যা প্রয়োজন তা তাঁরা তাদের পানপাত্র অনুসারে গ্রহণ করে।
“ওয়া লাহমি তাইরিম মিমমা ইয়াশতাহুন” (৫৬:২১) অনুবাদ: এবং পাখির গোশত যাহা হইতে তাহারা পছন্দ করিবে।
“ওয়া হুরুন ইননু” (৫৬:২২) অনুবাদ: এবং বড় বড় , সুন্দর ও উজ্জ্বল চোখের হুরেরা।
“কাআমসালিল লুলয়িল মাকনুন “(৫৬:২৩) অনুবাদ: লুকায়িত মুক্তার মতো।
“জাজায়াম বিমাকানু ইয়ামালুন” (৫৬:২৪) অনুবাদ: পুরস্কার ওই বিষয়ে রহিয়াছে ( যাহা) তাহারাঁ করিত।
“লা ইয়াসমাউনা ফিহা লাগওয়াও ওয়ালা তাসিম” (৫৬ঃ২৫)। অনুবাদ: তাহারা শুনিতে পায় না উহার মধ্যে বাজে কথা এবং পাপের কাথাও না।
“ইললা কিলান সালামান সালামা” (৫৬:২৬)। অনুবাদ: একমাত্র কথাটি শান্তি, শান্তি।
কোরানিক দর্শনে ডানপন্থীগণের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
“ওয়া আসহাবুল ইয়ামিনি, মা আসহাবুল ইয়ামিন” (৫৬:২৭)। অনুবাদ: এবং ডানহাতের অধিবাসী, ডান হাতের অধিবাসী (বলতে) কী (বুঝায়)?
“ফি সিদরিম মাখদুদিন” (৫৬:২৮)। অনুবাদ: কাটাঁবিহীন বরইগাছগুলির মধ্যে।
মন্তব্য: অগ্রগামীরা হলেন প্রথম শ্রেণির অধিবাসী। আর ডানপন্থীগণ হলেন দ্বিতীয় শ্রেণির অধিবাসী। ডানপন্থীগণ তাঁরা নিয়ামত প্রাপ্ত দলেরই অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা হলেন হকপন্থী পীর, ফকির, আলেম, মুমিন ও সুফিমন্ডীগণ। ২৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা যায় যে, একজন সাধক তার আপন নফস হতে ষড়রিপু নামক মায়ার কাটা হতে মুক্ত অবস্থা বুঝায়। অর্থাৎ প্রশান্ত নফসের অধিকারী সাধক।
“ওয়া তালহিম মানদুদিন” (৫৬ঃ২৯)। অনুবাদ: এবং স্তরে স্তরে কলাগাছগুলি।
মন্তব্য:কলাগাছ যেমন ডালপালামুক্ত সরল প্রকৃতির ন্যায় দেখা যায়।তেমনিভাবে খান্নাসবিহীন একজন সাধক কলাগাছের ন্যায় সরল প্রকৃতির অধিকারী।
“ওয়া জিললিম মামদুদিন “(৫৬:৩০)। অনুবাদ: এবং বিস্তৃত চায়া।
মন্তব্য: বিস্তৃত ছায়া বলতে একজন সাধক সর্বময় আরামদায়ক প্রশান্তিময় পরিবশের মধ্যে অবগাহোন করেন।
“ওয়া মায়িম মাসকুবিন” (৫৬:৩১)। অনুবাদ: এবং প্রবাহিত পানি।
মন্তব্য: সুরাবান তহুরা অথবা হাউজে কাউসারের ধারা।
“ওয়া ফাকিহাতিন কাসিরাতিল” (৫৬:৩২)। অনুবাদ: এবং প্রচুর ফল।
মন্তব্য: গুরুর জিহবা শিষ্যের কর্ণ বীজমন্ত্র লাগাতে হয়। যে ফল খাইলে অমর হইবে আমল করে খাইতে হয়। লিঙ্গ-যোনী সঙ্গম হইলে আচানক এক ফল ধরিবে।কামভাবে লিপ্তহলে ফলেমূলে বিনষ্ট হবে। অর্থাৎ জ্ঞানামৃত লাধুনিক এলমকে রূপক ভাষায় ফল বলা হয়েছে।
“লা মাকতুআতিন ওয়ালা মামনুআতিন” (৫৬:৩৩) অনুবাদ: শেষ হইবে না এবং মানা করা হইবে না।
“ওয়া ফুরুশিম মারফুআতিন” (৫৬:৩৪) অনুবাদ: এবং মহিমান্বিত বিছানা।
মন্তব্য: মহিমান্বিত বিছানা বলতে রূপকার্থে আনন্দঘণ পরিবেশ বুঝায়।
“ইননা আনশানা হুননা ইনশাআ” (৫৬:৩৫) অনুবাদ: নিশ্চয়ই আমরা তাদের সৃষ্টি করিয়াছি, বিশেষভাবে আমরা সৃষ্টি করিয়াছি।
“ফাজাআলনা হুননা আবকারান” (৫৬:৩৬) অনুবাদ: সুতরাং আমরা তাহাদিগকে কুমারী বানায়াছি।
“উরুবান আতরাবাল” (৫৬:৩৭)। অনুবাদ: অতিপ্রিয় সোহাগিনী, সখী তথা প্রেমিকা।
” লিআসহাবিল ইয়ামিন”( ৫৬ঃ৩৮)। অনুবাদ: ডান হাতের অধিবাসীদের জন্য।
“সুললাতুম মিনাল আউয়ালিনা” (৫৬:৩৯)। অনুবাদ: পূর্ববর্তীগণের মধ্যে হইতে বড় দল।
“ওয়া সুললাতুম মিনাল আখেরিন” (৫৬:৪০)। অনুবাদ: এবং পরবর্তীগণ হইতে বড় দল।
মন্তব্য: ডানপন্থীগণকেও আরিফ আবদালগণও বেশি মুহাব্বত করেন। আবার অনুরূপভাবে বামপন্থীদের মধ্যে হতে বড় দল ডানপন্থীদের পছন্দ করেন।
কোরানিক দর্শনের বামপন্থীগণের বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ :
“ওয়া আসহাবুশ শুমালি মাআসহাবুশ শিমাল” (৫৬:৪১)। অনুবাদ: এবং বাম হাতের অধিবাসীরা, বাম হাতের অধিবাসী বলতে কী বোঝায়?
“ফি সামুমিন ওয়া হামিমিন”( ৫৬:৪২) অনুবাদ: লু হাওয়া এবং গরম পানির মধ্যে।
মন্তব্য: লু হাওয়া কে উত্তপ্ত কাম বাতাস অর্থে এবং গরম পানিকে উচ্ছিত বীর্য অর্থে নেওয়া হল।
“ওয়াজিললিম মিন ইয়াহমু মিন” (৫৬:৪৩)। অনুবাদ: এবং কালো ধোঁয়ার ছায়ার মধ্যে।
মন্তব্য: কামভাব জ্ঞানকে আবৃত করে রাখে। কুয়াশায় যেভাবে সূর্যকে ঢেকে রাখে, ধোঁয়া যেভাবে আগুনকে ঢেকে রাখে, কামনার মোহ সাধকের অন্তরের নূরী কোরানকে ঢেকে রাখে। যার কারণে সাধকগণ নূরী কোরানকে স্পর্শ করতে পারে না।নূরী কোরান তখনই স্পর্শ করা যাবে যখন নফসের উপর থেকে কামের প্রভাব দায়েমি সালাতের মাধ্যমে মুক্ত করতে পারবে। বামপন্থীগণ কামাতুর পরিবেশে কামমোহের কালো ধোঁয়ার মধ্যে সফরত থাকে।
চলবে…
নিবেদক: আর এফ রাসেল আহমেদ