সংগীতজ্ঞদের জন্য এনে দিও মিষ্টি মধু।

সংগীতজ্ঞদের জন্য এনে দিও মিষ্টি মধু।

ভালো মন্দ বুঝি না, জানি না। লেখাটি খানিকটা ‘সাইকিডেলিক’ মনে হতে পারে। আধো জাগরণে, আধো চেতনে, অতি প্রত্যুষে পবিত্রতার স্পর্শে এই বইটি লেখার সুযোগ গ্রহন করেছি। ত্রুটির সম্ভাবনা থাকবে, তেমনি সম্ভাবনা চকিত স্পর্শ পাবার। যা চেয়েছি তা এতে নেই, যা চাইনি তা এতে আছে। যা চাওয়ার মুহুর্তেই কলমের আগায় এসে গেছে তা আমার চাওয়া হতে পারে না। যিনি লিখিয়েছেন তার কথা তাহলে এগুলো। এমন কি ব্যাক্তি যার হাত দুয়ে এত কথা লিখিত হওয়ার? এর তাৎপর্য বুঝিনি এখনো বুঝিনি।

সমস্ত মানবমণ্ডলি এক জাতি, একই কথা বার বার মস্তিষ্কের চারধারে কে বলে যাচ্ছে, তাও বুঝি না। মাঝে মাঝে মাথাটাকে ঝেড়ে নিচ্ছি, আবার কে যেন বলে যাচ্ছে, তোমরা সবাই এক জাতি, এক জাতি, এক জাতি। নিকটবর্তী ধ্বংসের মাঝে বাস করে, আলাদা আর কতদিন থাকবে? এবার এক হয়ে যাও। একাকী নয়, এক সাথে চিন্তা করো। বিরাট কম্পনে সব যখন একাকার হয়ে যাবে তখন আর আলাদা পৃথিবীর স্বপ্নে বিভোর হয়ো না। এক হও, এক হও, এক হও। এক পৃথিবীর ভাবনায় নিজেকে নিয়োজিত করো।

হৃদয়ের মধ্যে একসঙ্গে বেজে উঠেছে একশটি যন্ত্র। সেই বেজে উঠার মত হৃদয় কি আমার। ভিয়েনার যখন সিমফনি অর্কেস্ট্রা শুনতে হাজির হয়েছিলাম ত্রিশ বছর আগে বিষ্ময়ে দেখি এক সঙ্গে শত বেহালা বেজে উঠেছে, অন্যদিকে শতটি ফ্লুট, কখনো ধীরে, কখনো একাকী, কখনো সমস্বরে বেজে ওঠে হাজার শ্রোতার মনে কম্পনের সৃষ্টি করছে। পিনপতনের শব্দ নেই কোথাও। শতবাদ্যের সঙ্গে মিল খুঁজে পাই রুমির। তখন তার তবলা ও ঢোলকের অশ্রুত ধ্বনির সঙ্গে একাত্ম হই।

প্রতি প্রাতে বাজাও তোমার যন্ত্র এমনি করে,
হ্যা আমার অরুপ এমনি করে, ঠিক অমনি করে।
তোমার সনতুর রেখে আসো ভেনাসের কাছে ওহে চন্দ্র;
প্রবেশ করো, ঠিক এমনি করে, তোমার পাঁ দুলিয়ে আনন্দের সাথে,
ঠিক এমনি করে যখন জনতা চায় মিশকের সুগন্ধ।।

তোমার চুলের বেণী খুলে দিও নৃত্যের ভঙ্গিতে, ঠিক এমনি করে
যদি ইচ্ছারাজি দুলাতে না চায় একবারও তোমার সাথে-
ঘোরানোর চাকতিতে জ্বালিয়ে দিও আগুন, এমনি করে
আজ সে মহা সম্মেলনের দিন, হে ভালোবাসা আমার হাতটি ধরো।
এবং আমাকে নিয়ে যাও রাজকীয় উৎসবে ঠিক এমনি করে।।

[দিওয়ান নম্বরঃ ১৯৫৩ : ১, ৩-৬]

রুমির কবিতা বিষ্ময়ে হতবাক করে দেয় পাঠককে। ফারসিতে এটি কেমন হবে কল্পনা করুন। ইংরেজিতেই যখন এত সুন্দর, বাংলায় ও মন্দ নয়। যদিও গদ্যে ছন্দে অনুবাদ করেছি। কবির অন্তরে কি খেলা করছে? এটি কি ভিতরের সঙ্গীত না বাইরের? একজন আলোচক দেখিয়েছেন যে তার ছন্দের প্রতি দূর্বলতা আছে সত্যি, কিন্তু হদয় ও ঢোলকের মিলটি কাকতালীয় নয় মোটেও। চোখ, কান, হদয় মিলিত হয়ে সঙ্গীতের মাধুর্য এনেছে দিওয়ানে। ভিতর ও বাহির একাকার। প্রতিটি দিওয়ানই সৌন্দর্যমন্ডিত হতে হবে? হ্যা তাই। পরেরটি পড়িঃ

‘হে আল্লাহ সঙ্গীতজ্ঞদের জন্য এনে দিও মিষ্টি মধু
যেন তারা বাজিয়ে চলে তবলা ও ডোল অবিশ্রান্ত,
হাত দিয়ে যা বাজায়, তা তো তাদের দেহশক্তি
সত্য সুন্দর আলো ঢেলে দাও, বাজনার জোড়ে
তোমারই সঙ্গীতে যেন তারা ভরে দেয় আমার কানযুগল
শত দৃষ্টি দান করো তাদের অন্তরে, খালি চোখে মহারাজকে দেখার।
পায়রার মত মিষ্টি প্রেমের বোলতান
তোমার দয়া দুয়ে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত করো তাদের
সিফাত গাইতে গাইতে তোমার, তাদের বোধ যেন হয় শানিত
প্রতিদানে, দিও কিছু মারহাবা; তোমার তরফ থেকে।

কে বলে জীবন পরিকল্পিত? মসনবী জুড়ে পরিকল্পনার অভাব শনাক্ত করলে বলতে হয়, যখন যা মন চায়, যখন যা মনে এসেছে, তাই লিখেছেন কবি। পরিচ্ছেদের ভাগ করে তার কাব্য বিষয়ভিত্তিক হয়ে একটার পর একটা আসতে পারতো। ছয় খন্ডে নানান জায়গায় নানান বিষয়, একই কথা বারবার নানান প্রসঙ্গে এসে গেছে। মসনবীকে যদি বলা হয় পারস্য ভাষার কোরআন, তা হলে কোরআনে ও আল্লাহ যা বর্ণনা করেছেন তারই ইচ্ছা অনুসারে। যখন আল্লাহর যা মনে হয়েছে তা তিনি বয়ান করেছেন নবীকে, কখনো একবার, কখনো দুইবার, কখনো বারবার। একই কথা বারবার কেন? বান্দাদের বুঝাতে, যাতে তারা ভুল না করে। বান্দাদের বুঝানোর জন্যে কাব্যের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন বান্দাদের অনুসরণের। প্রভু বলেছেন, আমরা শুনছি। এটাই আমাদের অনুশাসনের পুস্তক। আল্লাহর চেয়ে সুন্দর পরিকল্পনা আর কার হতে পারতো? গ্রন্থটিকে একবারই পরিবেশন করলেই বা আপত্তি কি ছিল? কেনই বা দীর্ঘ তের বছর ধরে একটি গ্রন্থের প্রকাশ, তার প্রিয় রাসুলের জবানী দিয়ে জিবরাইলের মাধ্যমে।

সূত্রঃ রুমির অলৌকিক বাগান।

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel