সুফি শাহজাহান শাহের দর্শন তত্ত্বের স্বরূপ:
দর্শন তত্ত্ব বাণী
“নিষ্কামিক মানুষ যারা, অখন্ড রয় জীবনে-আসা যাওয়া করছে তারা, ঐ মানুষ ধরতে পাই না।”
“সাউন্ডগড থাকে ঘরে, দূর্বীন ধরে দেখো তারে; কোন রূপে সে বিরাজ করে, আসে যায় সে কেউ দেখে না।”
“তারে দেখতে গিয়া, সুফিমতে খোজ গিয়া, শাস্রীয় জ্ঞান অর্জন করিয়া, তাঁর দর্শন পাওয়া যায় না।”
“শাস্রীয় জ্ঞান অর্জন করে, ব্রেইনের স্বরূপ দেখলে পরে, সাউন্ডশক্তি না দেখলে পরে,অপরূপ দেখা যাবে না।”
“যা আছে সবারই মূল, দার্শনিক পায় সবকিছুর স্বমূল, স্রষ্ঠা ধরতে হয় তাদেরই ভুল, কোন কৌশলে ধরি তারে।”
“আগম -নিগম মূল আলোচনা, প্রকাশ্য যায় না জানা, ভেদ- বিধান শাস্র কানা, জানতে হয় কৌশলে।”
“ধর্মীয়গ্রন্থের উর্ধ্বে যাইয়া, চিনদেশ পার হইয়া, আদ্যশক্তি দর্শন করিবে, অনুশক্তি জাগ্রত হইলে।”
“জ্ঞান -বিজ্ঞান দর্শন অর্জন করে, পদার্থ বিজ্ঞান ভাগ করে, রসায়ন-বায়োলজি ফিজিক্স জ্বীন ধরে, অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়া স্বরূপ দর্শন কর।”
“সাধক শাহজাহান চিহ্ন কর, অমরআত্মার স্বরপ ধরে, নিজের ঘরে মেরাজ কর, অপরূপ দর্শন এবার কর।”
“ভ্রমন্ডে অখন্ড হইলে, পূর্ণ সংযমে তারা চলে, আলো-ভ্রহ্মভাব জাগিলে, আইনুল ইয়াকীন আসে দীলে।”
“শাহজাহান পরশ পাইয়া, মুক্তির শহরে গেছে চলিয়া, অমরআত্মা অর্জন করিয়া, আছে দেহত্যাগ করিয়া।”
“শাহজাহান নাম ধরে, নিরাকার আকার ধরলা পরে, নীড় খোজিলে ভ্রহ্মের স্বরূপ পাই তোমারে, লীলানিত্য তুমি একজন।”
“জীবআত্মা ধ্বংস হবে,শাহজাহান চীরদিন রবে,শ্রীরূপে সাক্ষাৎ পাবে,অনন্তরূপে মিশে আছি।”
(সংযমের সংবিধান কিতাব)
সুফিদর্শন তত্ত্বের স্বরূপঃ
সাধক কবি শাহজাহান শাহ মস্তানের দর্শনতত্ত্বের প্রেক্ষাপট হল-অখন্ড, নিসকামী ও সূক্ষ্মমানুষ তথা অতিমানব গড়ে তুলা। এই আধুনিক ন্যানুপ্রযুক্তির যুগে আত্মার মহান বিজ্ঞানী, দর্শনের নবদ্রুতি সাধক শাহজাহান শাহ। কীভাবে জীব স্বভাবের, খান্নাস প্রকৃতির মানুষ, অতিমানবে রূপান্তর হতে পারে, তার দর্শন বিজ্ঞানভিত্তিক নিগূঢ় তত্ত্বের মাধ্যমে সহজ, সরল ও প্রাঞ্জলভাষায় ব্যক্ত করেছেন। কিভাবে মুক্তমানুষ হওয়া যায় এবং জন্মচক্রের আবর্তন থেকে মুক্ত হয়ে সূক্ষ্মমানুষ অতিমানব হওয়া যায়, তার বিস্ময়কর অভিনবর তত্ত্ব অবতরণ করেন, সংযমের সংবিধান গীতিকাব্যে। সাধক কবি দেখিয়েছেন, কীভাবে স্বীয় খুদিতত্ত্বে পরমসত্তাকে জাগ্ররত করা যায়, তারই স্বরূপ দর্শন চিত্রিত করেছেন। তিনি শুধু দর্শন সংক্রন্ত মহৎ ও উচ্চতর চেতনাতেই সমৃদ্ধ ছিলেন না। তারঁ অসামান্য সঞ্চয়ে ছিল জগৎ ও জীবনের বিবিধ প্রকার উপলব্ধি পাশাপাশি ধর্ম, সংগীত ও শিল্পের বিচিত্র ও বহুমুখী অস্তিত্বের আত্মিক বন্ধন।
ভাববাদী, নীতিবাদী ও দর্শনতত্ত্বের সীমা ছাড়িয়ে, তিনি প্রেমপূজারী হয়ে পরিভ্রমণ করেন মানবজীবনের বিস্তার ও আবহের আনন্দে, এবং জীবনের সমৃদ্ধির পথে দুঃখের প্রারম্ভিকার অনুসন্ধানে। তিনি জীবনের স্বরূপ অনুসন্ধান করেছেন জিজ্ঞাসার ভিতর দিয়ে, কবি তাঁর জীবনে দৃষ্টিভঙ্গিগতভাবে এক নতুন ও মৌলিক চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। মানবজাতীর সর্বপ্রকার জিজ্ঞাসার স্বরূপ উন্মোচন এবং মানুষের প্রকৃত রূপ নির্ণয়ের প্রয়াসই ছিল সাধক কবির আজীবন সাধনা। মানুষের অন্তহীনশক্তি ও সম্ভাবনার উৎস সন্ধানের পাশাপাশি সাধক কবি ভবিষ্যৎ মানবের,উজ্জ্বল বিকাশের পথপরিক্রমার দিক নির্দেশনার আলোক শিখা জ্বালিয়েছেন।
তিনি ধর্মবিরোধী নাস্তিক্যবাদের বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি গুরুবাদী, অশিক-অলৌকিক, আধ্যাত্মিক, রুহানি শক্তিসমপন্ন ও সুফিসাধক সত্তা ছিলেন। তিনি প্রচলিত ধর্মদর্শন, জ্ঞান -বিজ্ঞান, সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্রনীতি ও প্রশাসনিক নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি সমপর্কে সমালোচনা করেন। তিনি সাম্যবাদী, মানবপ্রেমী ও ধর্মনিরপেক্ষ প্রতীক ছিলেন, যা সাধক কবির কাব্যতত্ত্ব অধ্যায়ন করলেই তা প্রতিয়মান হয়। দশইন্দ্রই শক্তির বন্ধন ছিন্ন করে, কীভাবে সূক্ষ্মমানব, অমৃতের সন্তান হওয়া যায় এবং কিভাবে বিধ্বংসী মানবসভ্যতা নবজীবন লাভ করবে, তার প্লাটফর্ম সাধক কবি বিচিত্রভাবে অংকন করেছেন। তিনি ছিলেন স্পষ্টবাদী, মানবতার প্রতি স্বভাবতই স্বতঃস্ফূর্ত কল্যাণ কামনাকারী, নির্ভিক ও সাহসের প্রত্যক্ষ প্রতীক।তাঁর গাত্রবর্ণ ছিল সুঠাম কৃষ্ণবর্ণ, সাধারন মানুষ বলতো গামা। তিনি একাকী, স্বপ্নচারী, নিবিড় ও সংগ্রামমুখর ছিলেন।
তিনি প্রচলিত ধর্মদর্শনের উর্ধ্বে গিয়ে মানবতার নবজাগরণ তথা রেনেসাঁ ঘটিয়েছেন। ঘটিয়েছেন আত্মারপূর্ণতা। তিনি কাল্পনিক স্বর্গ ও নরকের উর্ধ্বে গিয়ে পরমসত্তায় লীন হওয়ার স্বরূপ নির্ণয় করেন। কোরানিক দর্শনের সার শিক্ষা হল সংযম অর্জন করা। সাধক কবির ভাষায়”আমিত্ব ত্যাগ করিয়া, তুমি মূল তাতে স্বনির্ভর হইয়া, তারঁ(রবের) স্বভাবে স্বভাব বানিয়ে, তাকিয়ে থাক আত্মদর্শনে”। সৎস্বভাব ও সৎভাব অর্জন করাই সংযম। এই সংযমের নববিধান, সংবিধানতত্ত্ব আবিষ্কার করেন, কালজয়ী সাধক পুরুষ শাহজাহান শাহ। তিনি দার্শনিক গূঢ়- জটিল ও কঠিন মারপ্যাচে না গিয়ে সরল ও সাবলীল ভাষায় মহাবিশ্বের সমস্ত পদার্থের অনন্তকালব্যাপী পুনঃপুন প্রত্যাবর্তনের দর্শনতত্ত্ব নিয়ে, তিনি কবিতার ভাষায় তাঁর নবীন সুফিমতবাদ তুলে ধরেন।
তিনি বহুচিত্রকল্প, অসংখ্য প্রতীক, যুক্তির দ্বরা মানুষ কীভাবে চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন করতে পারে তার আদর্শ চিত্রিত করেন। তিনি আদ্যশক্তির স্বরূপ, আকর্ষণ, কারণ ও উদ্দেশ্যরূপে নীতিনিষ্ঠাকে উপস্থাপন করেছেন তত্ত্বরূপে,তার তত্ত্বে উন্মোচন ঘটে জগৎ এর সর্বপ্রকার পদার্থ ও কার্যকর মূলচক্রটি। তিনি জ্ঞান ও সত্য বিষয়ে তার গভীর অন্তর্ভেদী চিন্তাসমূহ, জগৎ ও জীবনের পূরাতন ও বর্তমান ধ্যান-ধারণা ভেঙ্গে দিয়েছেন। দর্শনচিন্তার ক্ষেত্রে নবদিগন্তের সূচনা করে এক নবতর পথের সন্ধান দেখান। সাধক কবির দর্শনের একটি লক্ষনীয় বিষয় হলো তাতে নেই কোনো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। পুরাটাই ইটারনাল এনটিটি। তিনি মানবের সর্বঅস্তিত্বের মধ্যে ইচ্ছাশক্তিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করেছেন। এই ইচ্ছাশক্তিকে বলিষ্ঠতম পর্যায়ে উর্ত্তীন করে মানুষের অস্তিত্বকে বিশাল ও সুমহান করে তোলার আহবান জানিয়েছেন।
সাধক কবির সমগ্রজীবনের অভিষ্ট প্রয়াস হল নিসকামী সূক্ষ্মমানুষ গড়ে তোলা। নিসকামী মানুষ গড়ে তোলার প্রত্যয়টিতে নির্দেশ করা হয়েছে উচ্চতর ও নতুন এক মূল্যবোধের দ্বারা রূপান্তর ঘটানো। এই মূল্যবোধে অভিষিক্ত সূক্ষ্মমানুষই মানবজাতির পথ নির্দেশ করেন। তার শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে শুভ ও কল্যানের মহত্তর লক্ষ্য নিয়ে। তাঁর কাঙ্ক্ষিত অখন্ড নিসকামী মানব হবে অতীতের সকল মহান মানবের চেয়ে মহত্তর। তিনি সামগ্রিকভাবে সূক্ষ্মমানুষের প্রকৃতি চিহ্নিত করেন জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্ব ইত্যাদি আপাত শুভ কল্যানকামী মনে অভিষিক্ত। সাধক কবি বিবর্তনের ক্রমধারার মাধ্যমেই নিসকামী অখন্ড মানুষ গড়ে তোলার প্রয়াস ব্যক্ত করেছেন এবং একই সঙ্গে একই বৃত্তে মধ্যেই দুইটি তত্ত্বের অবস্থান। দুইটি ভিন্ন ভিন্ন সত্তার সহাবস্থান থেকে আমরা পাই পরিবর্তনের মধ্যে স্হায়ীত্বের ধারণা।
উপসংহারে বলা যায় যে,মানবজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল অখন্ড,নিসকামী থেকে আত্মার পূর্ণতা সাধন করা এবং মুক্তভাবে অনন্ত অসীম প্রেমতরঙ্গে নিমজ্জিত হওয়া।
(আর এফ রাসেল আহমেদ)