আদমের আগেও মানুষ ছিলো (কোরানিক দর্শন)

আদমের আগেও মানুষ ছিলো (কোরানিক দর্শন)

“প্রত্যেক নফস তথা প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে, কিন্তু প্রত্যেক প্রাণ তথা নফস মৃত্যুতে ধ্বংস হবে না।”

আল কোরানে বর্নিত রয়েছে-

  • ১. আলে ইমরান ( ৩:১৮৫ ) : “كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ…”
  • ২. আন‑আনবিয়া ( ২১:৩৫ ) : “كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ…”
  • ৩. আন‑আনকাবুত ( ২৯:৫৭ ) : “كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ…”

উচ্চারণ: “কুল্লু নাফসিন জায়িকাতুন মউত”
অনুবাদ: প্রত্যেক নফস মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিবে।

কিন্তু আল কোরানে কোনো আয়াতে নাই, “কুল্লু নাফসিন তাবাকাতুল মউত” অর্থাৎ প্রত্যেক নফস মৃত্যুতে ধ্বংস হইবে। এই মর্মে আল কোরানে কোনো আয়াত বর্নিত হয় নাই। নফস মৃত্যুতে ধ্বংস হয় না, নফস মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে। সুতরাং নফস তথা প্রাণ মৃত্যুতে ধ্বংস হবে না, বরং পরিবর্তন হবে। আবার প্রশ্ন আসতে পারে, কোন নফস মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে? কোরান জানান দিচ্ছে নফসে লাউয়ামা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আল্লাহ নফসে লাউয়ামার কসম খেয়েছেন। কিয়ামাত নফসে লাউয়ামার উপরেই হবে। নফস থেকে খান্নাস বিচ্ছিন্ন হওয়াকে বলে মৃত্যু বা কিয়ামতে ছগিরা।

নফস তথা প্রাণ একবচন, নফসের বহুবচন হলো আনফুস। নফস এক হলেও নফসের প্রকারভেদ রয়েছে।

যেমন রয়েছে:- নফসে জামাদি, নফসে নাবাতি, নফসে হাইওয়ানী, নফসে ইনসানী, নফসে আম্মারা, নফসে লাউয়ামা, নফসে মোৎমায়েন্নাহ, নফসে রাজিয়া, নফসে মারজিয়া, নফসে মূলহেমার, নফসে রহমানী, নফসে আনা ইত্যাদি। নফসের তথা প্রাণের যেহেতু প্রকারভেদ রয়েছে, তাহলে নফস প্রতিনিয়তই বিবর্তন প্রক্রিয়ায় আবর্তিত হচ্ছে। তাই নফসকে পরিশুদ্ধ করতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে। তাসাব্বুরে শায়েখ এর মাধ্যমে তাজকিয়া করতে হয়।

বিশাল সমুদ্রের জলরাশির মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। প্রাণের আবির্ভাব হয়েছে পানি হতে। পিতার পানিতে পুত্রের জনম।

উল্লেখযোগ্য আয়াত:-

আন‑আনবিয়া (২১ : ৩০)—

“أَوَلَمْ يَرَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَاهُمَا وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ…”

অনুবাদ: “অতঃপর কি তারা না দেখেছে যে আকাশ ও পৃথিবী একসাথে ছিল, তারপর আমরা তাদের আলাদা করেছি; এবং আমরা পানিতে থেকে (বা পানিকে উৎস ­রূপে) প্রতিটা জীবন্ত কিছু সৃষ্টি করেছি…”

আন‑নূর (২৪ : ৪৫) —

“وَٱللَّهُ خَلَقَ مِنَ ٱلْمَآءِ كُلَّ دَابَّةٍ…”

অনুবাদ: “আল্লাহ পানিতে থেকে প্রতিটা গতিসম্পন্ন প্রাণী সৃষ্টি করেছেন…”

আল‑ফুরকান (২৫ : ৫৪) —

“… وَهُوَ ٱلَّذِي خَلَقَ مِنَ ٱلْمَآءِ بَشَرًا…”

অনুবাদ: “… এবং তিনি পানিতে থেকে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন…”

আমরা কোরানিক দর্শন আলোকে জানতে পারলাম প্রাণের আগমন পানি হতে। এই এককোষী প্রাণ জলচর, স্থলচর, উভয়চর প্রাণরূপে বিভাজিত হয়ে অভিরাম গতিতে ছুটে চলছে। আমরা সুরা নূরের ৪৫ নং আয়াতে দেখতে পাই;-

সূরাঃ আন-নূর [24:45] —

وَٱللَّهُ خَلَقَ كُلَّ دَآبَّةٍ مِّن مَّآءٍ فَمِنْهُم مَّن يَمْشِى عَلَىٰ بَطْنِهِۦ وَمِنْهُم مَّن يَمْشِى عَلَىٰ رِجْلَيْنِ وَمِنْهُم مَّن يَمْشِى عَلَىٰٓ أَرْبَعٍ يَخْلُقُ ٱللَّهُ مَا يَشَآءُ إِنَّ ٱللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ

উচ্চারণ: “ওয়াল্লা-হু খালাকাকুল্লা দাব্বাতিম মিম মাইন ফামিনহুম মাইঁ ইয়ামশী ‘আলাবাতনিহী ওয়া মিনহুম মাইঁ ইয়ামশী ‘আলা-রিজলাইনি ওয়া মিনহুম মাইঁ ইয়ামশী ‘আলাআরবা‘ইন ইয়াখলুকুল্লা-হু মা-ইয়াশাউ ইন্নাল্লা-হা ‘আলা-কুল্লি শাইয়িন কাদীর।”

অনুবাদ: “আল্লাহ প্রত্যেক চলন্ত জীবকে পানি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। তাদের কতক বুকে ভয় দিয়ে চলে, কতক দুই পায়ে ভর দিয়ে চলে এবং কতক চার পায়ে ভর দিয়ে চলে; আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম।”

আহাদ জগতে সৃষ্টিচক্রে একশ্রেণীর প্রাণী ডিম দিয়ে বংশবিস্তার করে, আরেক শ্রেণীর প্রাণী বীজ, কান্ড বা মূলের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে, অন্যশ্রেণীর প্রাণীর নিষিক্তের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। হেজা, গেজা ও ডিম্বের মাধ্যমে প্রাণের বিবর্তন প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রাণতত্ত্বের উপর যে বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে তাকে বলে জুওলজি, এবং রয়েছে প্রাণীর শ্রেণীবিন্যাস।

ওহেদ নফস বিভক্ত বিভক্ত হতে হতে আহাদ নফসে রূপান্তরিত রয়েছে। এক নফস তথা প্রাণ বহুরূপে বিকশিত হয়ে চলছে। ফকির লালন শাহ বলতেছে চৌরাশি লক্ষ যোনী পরিভ্রমণ করে মানবরূপে এসেছি। নফস তথা প্রাণ একটিই কিন্তু প্রাণের পোশাক হলো চৌরাশি লক্ষ।

পূর্বেই বলেছি প্রাণের উৎপত্তি পানি হতে। আধুনিক জীব বিজ্ঞানীরা বলতেছে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে আনুমানিক চারশত ষাট কোটি বছর পূর্বে। পৃথিবী সৃষ্টির ষাট কোটি বছর পর প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায় পানি হতে। এই এককোষী প্রাণে বিবর্তনবাদ প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে উন্নত রূপে আসতেছে। বিজ্ঞানীরা বলতেছে মানুষের অস্তিত্ব পাওয়া যায় আনুমানিক তিনলক্ষ বছর পূর্ব হতে, এই মানুষ বিবর্তনবাদের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় পরিপূর্ণতা লাভ করে আনুমানিক দশহাজার বছর পূর্বে। যে মানুষটি সর্বপ্রথম পরিপূর্ণতা লাভ করেন তিনি হলেন আদম।

মানুষের পরিপূর্ণ রূপটির নাম হলো আদম। আদম থেকে সভ্যতা ও সংস্কৃতি আরম্ভ। আল্লাহ আদমের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, আদমই প্রথম নবি, প্রথম শিক্ষক, প্রথম গুরু। আদমের নফসের উপরে রূহ ফুঁৎকার হয়েছে। আদম মুক্তপুরুষ। মানুষের নাম আদম নয়, রূহের নাম আদম। আদমের নাম আল্লাহ। আদম ব্যতীত আল্লাহর পরিচয় নাই।

আদমের বাশারের হয় মাজার বা সমাধি। আর মানুষ নফস ফেলে দিলে তার হয় কবর। আদম চৈতন্য, আদম অজয়, অমর। আদমের মৃত্যু নেই, আদম মৃত্যুঞ্জয়ী।

নফস দেহ ত্যাগ করলে, নফসবিহীন দেহকে কোনো ধর্মে পুড়িয়ে ফেলে আবার কোনো ধর্মে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। কবর দুই প্রকার যাথা: মেজাকি কবর ও হাকিকি কবর। মেজাজি কবরে মেজাজি আজাব হয় আবার হাকিকি কবরে হাকিকি আজাব হয়। কবরের আজব সত্য। ঐ যে মাটির গর্ত নামক কবরটি সেটা হলো নফসবিহীন বা প্রাণবিহীন মৃত লাশের কবর। আর জীবন্ত দেহটি হলো নফসের কবর। কবরের আজব নফস ভোগ করে, জাহান্নামের আজাব নফস ভোগ করে, আবার জান্নাতের সুখ নফসভোগ করে। মাটির গর্ত নামক কবরে কোনো ফেরেস্তা আসে না, রূপক কবরে রূপক ফেরেস্তা আসে। কিন্তু কবরের প্রশ্ন জীবন্ত দেহ নামক হাকিকি কবরেরই সমাধান করতে হবে। কবরের আজাব সত্য। কিন্তু তা মাটির গর্তে হয় না, তা হয় জীবন্ত মানব দেহে।

মানবদেহকে বলা হয় আত্মার কবর। তাই ইসলামে কবর পূজা হারাম। মাজার পূজা ইসলামে হারাম নয়।
বরং মাজার হলো ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলামে মানুষ পূজা হারাম। কিন্তু আদম পূজা নয়, নবি পূজা হারাম নয়। রূহের অধিকারী আদম। রূহ রবের আমর তথা আদেশ। তাই সমগ্র কোরানে বর্নিত হয়েছে নফস মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে। কোরানে বর্নিত হয় নাই” কুল্লু রূহিন জায়েকাতুল মউত”। প্রত্যেক রূহ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে এই মর্মে কোনো আয়াত নেই। রূহের কবর হয় না। নফসবিহীন খাঁচার কবর হয়। তাই লালন ফকির বলেছেন ” খাঁচার ভিতর অচীন পাখি কেমনে আসে যায়।” ইসলাম খাঁচা আর পাখি আলাদা করে দেখিয়েছে। খাঁচা দেহ, নফস / রূহ হলো পাখি।

পাখি খাঁচা ত্যাগ করলে পাখি নিরাকার হয়ে যায়। আল্লাহ নিরাকার, প্রকারান্তে আত্মাও নিরাকার। নিরাকারের কবর হয় না, সাকার দেহের কবর হয়। সাকার আদমের দেহের হয় মাজার, আর সাকার মানুষের হয় কবর। নফস কাঁচা, রূহ কাদিম, অনাদি সত্তা। তাই কোরানে আদমকে সিজদা করতে বলছে। নাস/ ইনসানকে নয়।

সূরাঃ আল-হিজর [15:29] —

فَإِذَا سَوَّيْتُهُۥ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِن رُّوحِى فَقَعُوا۟ لَهُۥ سَٰجِدِينَ

উচ্চারণ: “ফাইযা-ছাওয়াইতুহূওয়ানাফাখতুফীহি মিররূহী ফাকা‘ঊ লাহূছা-জিদীন।”

অনুবাদ: “অতঃপর যখন মানুষকে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় পরিপূর্ণ করে নেব এবং তাতে আমার রূহ থেকে ফুঁক দেব, তখন তোমরা তার সামনে সেজদায় পড়ে যেয়ো।”

নিবেদক: 
আর এফ রাসেল আহমেদ ওয়ার্সী
আরো পড়ুনঃ