পয়গম্বরদের তাদের স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছি (ভেদতত্ত্ব)
“আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে। অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা, পথঃভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথ প্রদর্শন করেন। তিনি পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা ইব্রাহিম, আয়াত নং-৪)
এই আয়াতটি একদিকে ঈশ্বরের রাহ ও দিশার প্রতি মানবতার নিখুঁত দর্পণ, অপরদিকে আল্লাহর শক্তি, প্রজ্ঞা, এবং তার পরিচালনার প্রতি অত্যন্ত গভীর কঠোরতা এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ প্রকাশ। যখন এই আয়াতটি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা হয়, তখন এটি অত্যন্ত গভীর বার্তা প্রদান করে।
“আমি সব পয়গম্বরকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি”
– এই অংশের মধ্যে একটি মৌলিক সত্য লুকিয়ে আছে, যা হলো প্রত্যেক পয়গম্বরকে তার নিজ জাতির ভাষায় পাঠানো হয়েছে, যাতে তারা তাদেরকে স্পষ্টভাবে বুঝাতে পারেন। “ভাষা” এখানে শুধু যোগাযোগের একটি মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি আধ্যাত্মিক শক্তি, যা একটি জাতির মানসিকতা, অনুভূতি, চিন্তা এবং সৃষ্টির দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত করে। ”ভাষা” মানুষের সংস্কৃতি, তার বিশ্বাস, তার চেতনা এবং তার সম্পর্কের পথ নির্দেশ করে।
আল্লাহ যখন প্রতিটি পয়গম্বরকে তার নিজ জাতির ভাষায় প্রেরণ করেন, তখন তিনি মানবতার সর্বোচ্চ চেতনার প্রতিফলন ঘটান। ভাষার মাধ্যমে এক জাতি বা সম্প্রদায়ের আত্মাকে স্পর্শ করা যায়, তাদের মধ্যে আল্লাহর পাঠানো বার্তা এবং নীতি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে পৌঁছে যায়। ভাষা শুধু মাত্র শাব্দিক উপাদান নয়, তা “অন্তরের সাথে একাত্ম হয়ে, সেই জাতির হৃদয়ে গভীরে প্রবাহিত হয়।”
ভাষা, আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পবিত্র মাধ্যম, যা হৃদয়ের ভেতরে আলোর সঞ্চালন ঘটায়। যখন একজন পয়গম্বর তার জাতির ভাষায় আল্লাহর কথা পৌঁছান, তা একাধারে আত্মিক জাগরণের কারণ হয়, যা সেই জাতিকে আত্ম-অধ্যাত্মিকতার দিকে পরিচালিত করে।
“যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পার“
– এখানে “পৰিষ্কার বোঝাতে” শব্দটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। তা কেবলমাত্র শাব্দিক বোঝানো নয়, বরং তা একটি লোকায়ীত গোপন “সত্য- র“ আধ্যাত্মিক উপলব্ধি তৈরির দিকে ইঙ্গিত করে।
আল্লাহ পয়গম্বরদের মাধ্যমে মানুষকে সরল ও স্পষ্টভাবে সত্য, নৈতিকতা এবং দ্যুতিময় জ্ঞানের দিকে আহ্বান করেন। যতটুকু অনুশীলন এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর আদেশকে বুঝতে পারে এবং জীবনে প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়, সে ততটুকু সত্যের দিকে এগিয়ে চলে। এখানে বোঝানো মানে কেবল তথ্যের প্রকাশ নয়, বরং এর মাধ্যমে একটি সুস্পষ্ট আধ্যাত্মিক উপলব্ধি বা অভ্যন্তরীণ জ্ঞানের উন্মোচন করে।
যে সত্য পৌঁছানো উচিত, তা একধরনের “আলোকিত অনুভব” যা আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে এবং মানবজীবনে সত্যের এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করে। আল্লাহর প্রদর্শিত পথের প্রতি আনুগত্য এবং দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন, কেবল বাহ্যিক নয়, বরং অভ্যন্তরীণ মন ও আত্মার পরিপূর্ণতা।
“অতঃপর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা, পথঃভ্রষ্ট করেন এবং যাকে ইচ্ছা সৎপথ প্রদর্শন করেন”:-
এই অংশটি একদিকে “ইচ্ছাশক্তির প্রশ্ন” উত্থাপন করে, অন্যদিকে “পরিবর্তনের রহস্য” উন্মোচিত করে। “পথভ্রষ্টতা” এবং “সৎপথ”: এই দুটি সত্ত্বা আল্লাহর এক অমূল্য উপহার, যা মানুষের “স্বাধীন ইচ্ছার সাথে সম্পর্কিত”। সত্যের পথে পরিচালনার জন্য কেবল একমাত্র আল্লাহই সেই শক্তি, যিনি একজন মানুষের অন্তরে সৎপথ বা অসৎপথের বোধ সৃষ্টি করেন।
এখানে আল্লাহর “সংশোধনকারী শক্তি” বোঝানো হয়েছে। আমাদের বিশ্বাসের অনুযায়ী, আল্লাহ মানুষকে সৎপথ বা অসৎপথ প্রদর্শন করতে পারেন, কিন্তু এই পথগুলি আসলে *মানুষের নিজেদের মনস্তত্ত্ব, ইচ্ছা এবং প্রস্তুতির উপর নির্ভরশীল”। আল্লাহ ইচ্ছা করলে মানুষের পথকে অন্যদিকে মোড় নিতে সাহায্য করেন বা তাকে সৎপথে পরিচালিত করেন। এটি মানবিক জীবনের “অতীত ও ভবিষ্যতের সাথে সম্পর্ক” স্থাপন করে, যেখানে আল্লাহর ইচ্ছা ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার মধ্যে সমন্বয় ঘটে।
সৎপথের প্রতি আত্ম-অনুসন্ধান এবং “আলোর প্রতি আকাঙ্ক্ষা” যখন মানুষের হৃদয়ে প্রবাহিত হয়, তখন সে নিজেকে আল্লাহর কাছে সঁপে দেয়। আল্লাহ তার হৃদয়ে “বিশ্বাসের আলোকায়ন” করেন। যারা সৎপথ অনুসরণ করতে পারে, তাদের জন্য আল্লাহর অনুগ্রহ, প্রজ্ঞা এবং শান্তি আনা হয়, যেটি পৃথিবী এবং আখিরাতে তাদের শাসন করে।
তিনি পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময় “
– এই উক্তি আসলে আল্লাহর দুই প্রধান
গুণের প্রতিফলন ঘটায়: পরাক্রম ও প্রজ্ঞা। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, তার হাতে সমস্ত জগতের শাসন ক্ষমতা। তিনি সকল কিছুর উপরে আছেন এবং সমস্ত জ্ঞানের মালিক।
এই অংশটি “ আল-কুদরাহ (অপরিসীম শক্তি)” এবং “আল-হেকমাহ (অপরিসীম জ্ঞান)” এর সর্বোচ্চ প্রকাশ। “ ও ক্ষমতা” যেখানে আল্লাহর একক, সেখানে মানুষের পরিশ্রমের মাধ্যমে সফলতা এবং ধ্বংস একেবারে আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। সৃষ্টির পথে মানুষের প্রতিক্রিয়া আল্লাহর মহান প্রজ্ঞার সাথে মেলে এবং তা তাকে তার ইচ্ছেমতো পথ প্রদর্শন করে।
“ আল্লাহ পরাক্রান্ত এবং প্রজ্ঞাময়,”
অর্থাৎ তার সব কার্যক্রম, সিদ্ধান্ত এবং পরিচালনা সর্বদা এক মহান উদ্দেশ্য নিয়ে ঘটে। মানুষের আত্মিক উন্নতি এবং পথপ্রদর্শন শুধুমাত্র আল্লাহর প্রজ্ঞা এবং শক্তির দ্বারা নির্ধারিত হয়, যার মধ্যে মানুষের ইচ্ছা, সংগ্রাম, ধৈর্য এবং ভালোবাসা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এই আয়াতটি একদিকে আল্লাহর সকল ভাষাাবাসির পয়গম্বরদের মাধ্যমে মানবজাতির প্রতি আধ্যাত্মিক দিকনির্দেশনার গুরুত্ব প্রকাশ করে, অন্যদিকে এটা মানুষের আত্মিক মুক্তির পথে আল্লাহর শক্তি ও প্রজ্ঞার অনুপস্থিতি বুঝিয়ে দেয়। “ভাষা ও আদর্শের মাধ্যমে আলো আসার” বিষয়টি “আল্লাহর ইচ্ছা” এবং “প্রজ্ঞার সঙ্গে সম্পর্কিত” যা অবশেষে মানুষের সৎপথ বা পথভ্রষ্টতা নির্ধারণে সাহায্য করে। আল্লাহর ক্ষমতা এবং প্রজ্ঞা এই পথকে গভীরভাবে রচনা করে, যেখানে মানুষ কেবলমাত্র নিজের অন্তর্নিহিত সত্যের সন্ধানই নয়, বরং একটি উজ্জ্বল আলোর দিকে এগিয়ে চলে।
–ফরহাদ ইবনে রেহান