হকিকতে তরিকত।
তরিকা বা তরিকাহ শব্দটি আরবি যার অর্থ দাঁড়ায় পথ, পথের ধারা,সুফিবাদের মতাদর্শ, অথবা আধ্যাত্মিকতার চরম সত্য সন্ধানে চেষ্টায়রত রাস্তা ইত্যাদি।মোট কথা গুরুর আশ্রয়ে থেকে সাধকের সাধন পদ্ধতিকে তরিকা বলে।যেমন একজন শুদ্ধ পীর, গুরু, মুর্শিদ, শিক্ষক, শাইখ ইত্যাদ। (প্রতিটি শব্দের হাকিকী অর্থ একজ শুদ্ধ পথ প্রদর্শক) অর্থাৎ স্পষ্ট বলা যায় একজন চরম সত্য প্রাপ্ত ব্যাক্তি (আল্লাহ হুকুম আহকাম, গুন যার মধ্যে বিদ্যমান থাকে)। যিনি আধ্যাত্মিকতার শিক্ষা দানের মাধ্যমে শিক্ষক রূপে (হক তথা হাকীকি সত্য) আল্লাহ প্রাপ্তির নির্দিষ্ট পথের সন্ধান দিয়ে থাকেন তিনি গুরু। একজন সিদ্ধ গুরুর আশ্রয়ে থেকে, শরিয়তের সকল হুকুম মেনে, হাকীকতের সন্ধানে, আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর রত যাত্রিকে তরিকত বা তরিকাহ পন্থি বলা হয়ে থাকে। ইসলামে বেশ কিছু প্রসিদ্ধ তরিকা রয়েছে কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, মোজাদ্দেদিয়া, ওয়াইসিয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া ইত্যাদি এছারাও অসংখ্য তরিকা রয়েছে। প্রত্যেক তরিকার নিজস্ব কিছু নিয়মনীতি থেকে থাকে। যাহা ঐ তরিকা পন্থিদের পালন করতে হয়।
তরিকার কর্মঃ
(গুরু শব্দটি ব্যাবহার করলাম) আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুল (সাঃ) বিধান শরিয়তের সকল কানুন মেনে চলা ইসলামের শরিয়ত অর্থাৎ আইন। এই আইন সকল ইসলাম ধর্মাবলম্বী মুসলিমের তথা তরিকা অনুসারীর জন্যও বটে। কিন্তু একজন গুরু তার শিষ্যকে শরিয়তের শিক্ষার পাশাপাশি তরিকার বা তাসাউফের শিক্ষা দান করে থাকেন। যে শিক্ষায় গুরু বেলায়েত প্রাপ্তির জ্ঞান অর্জিত শিক্ষা দিয়ে থাকেন। এই শিক্ষার মাধ্যমে শিষ্য তার আত্মোন্নতির পথকে প্রশস্ত করেন। আল্লাহর গুন, রূপ, মহিমায়, মহিমান্বিত রূপে রূপান্তর হয়ে যান। ইসলামে কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত শরিয়ত বা আইন। গুরু প্রত্যেকটি আইনের স্থম্ভ থেকে তরিকার শিক্ষা দিয়ে থাকেন। যেমন নামাজের মূর্ত ভাব থেকে বিমূর্ত ভাবটি অনুধাবণ করা, রোজার মূর্ত ভাব থেকে বিমূর্ত ভাবটি অনুধাবণ করা, হজ্জের মূর্ত ভাব থেকে বিমূর্ত ভাবটি অনুধাবণ করা ও যাকাতের মূর্ত ভাব থেকে বিমূর্ত ভাবটি রূপান্তর করা। এই ভাবে গুরুর নিকট হতে প্রতিটি শিক্ষার মূর্ত ও বিমূর্ত (দৃশ্যটি থেকে অদৃশ্যটি) ভাবটির সুক্ষ্ম স্পষ্টতা লাভ করাই তরিকার কর্ম।
সুফি তরিকাঃ
একজন সুফির নির্দিষ্ট কোন তরিকা নেই। সুফি সকল তরিকার সাদৃশ্যতা বহন করে। সুফির কোন জাত, ধর্ম গোত্র, বংশ নেই সার্বজনীন এবং সকল সৃষ্টির। সুফি গুরু মাওলানা রুমি (রঃ) উনার পরিচয় দিতে গিয়ে বলছেন আমার তরিকার নাম ‘প্রেম’। তুলনা করেছেন কাদায় আটকে পড়া গর্দভের পন্ডশ্রমের সঙ্গে। রুমি বিশ্বাস করেন, প্রেম থেকেই সকল কিছুর সৃষ্টি। বিশ্বের সকল কিছু ছোট বড়, বস্তু প্রাণী জগতের মিলন বিরহের বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ঐশী প্রেমের বিকাশ ও পূর্ণতা পরিদৃশ্যমান। প্রেমের ধর্ম সকল ধর্ম থেকে স্বতন্ত্র, প্রেমই শক্তি, প্রেমই সত্য, প্রেমই নিত্য, প্রেমই সকল রোগের নিয়ামক।
রুমির চমৎকার কথা, তিনি লিখেছেন; আত্মার প্রতি যে জুলুম করে সে-ই জালিম সে শুধু মানব ধর্মের বিরুদ্ধে নয় মানব সংস্কৃতির যথাযথ বিবর্তনের পথেও বিরাট বাধা। রুমি (রঃ)সর্বজনীন ভালোবাসার কথা যেমন বলেছেন তেমনই নিজের পরিচয় ও দিয়েছেন উদার ভাষায়; আমার সত্যিকার পরিচয় উদ্ঘাটনে আমি পরোমাত্রায় সমর্থ নয়। আমি মসুলমান নই, ইহুদি নই, নই খৃষ্টান কিংবা অন্য কোন ধর্মের অনুসারী। পাচ্য কিংবা প্রতিচ্য কোথাও নেই আমার জন্মভূমি। নিসর্গ নিলয় কিংবা মুক্ত আকাশ নয় আমার স্বপ্নচারিতার স্থান। আমার স্বদেশ নয় চিন কিংবা হিন্দুস্তান, নাম-গোত্রহীন স্থান পাত্রবিহীন অপরুপ মঞ্জিল, যে প্রেম সচেতন মানবআত্মা, সে-ই অদৃশ্য -লোকেরই আমি পেতেছি চিরস্থায়ী আসন। (সুফি তত্ত্ব ও প্রমিত পাঠের অনুশীলন প্রফেসর মোহাম্মদ আবুল খায়ের)
তাই সকল তরিকায়-ই সুফির প্রেমের বাণী ও প্রেমের সৌন্দর্যের বর্ণনা প্রকাশ করে।
লেখা- সাদিকুল ইসলাম।